আর একটু দূরত্বের মাপটুকু….. এই যেমন আর এক হাত পরিমান হলেই আড়াই হাতের দূরত্ব মিটে গিয়ে ছুঁয়ে দেয়া যেত লাগোয়া বিল্ডিংয়ের বেড রুমের জানালার থাই গ্লাসের কাঁচ। একেবারে আনকোরা ১১ তলা ভবনের সমান সমান ফ্লোর। দুই ছেলের শোবার ঘরের বারান্দায় বিশাল থাই গ্লাস সাঁটানো থাকে প্রায় সময়। বেশি সময় খোলা রাখে। কাজে সাহায্যকারী ফেরদৌসী প্রায়ই স্থান সংকুলানের কারনে আমার কাপড় এখানে এনে মেলে দেয়। আমার বেডরুম লাগোয়া বারান্দা উপযুক্ত নয় কাপড় মেলে দেবার জন্য। মেয়ের বারান্দা আর এই ছেলেদের বারান্দাই যা সম্বল।
– এই ভাবী!! আপনি কি এই বাসার ভাবী?
থতমত শব্দটার আমি ঠিক যথাযথ অর্থ বুঝিনা।
ওই সবাই বলে!!! তাই আমিও বলি আরকি!
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কোনো ধারনাই ছিলোনা নতুন ফ্লাটে ইতিমধ্যে জনমানব বসতি গড়তে চলে এসেছেন। এক মুহুর্ত আঁচ করার চেষ্টা করলাম…. আমাকে ঠিকঠাক লাগছে তো দেখতে? ফকিন্নির মত লাগছে নাতো? আমার বদনাম আছে…. খুব অগোছালো থাকি সবসময়। মাঝে মাঝে ছেলে মেয়ে ধমক টমক দেয়, বন্ধু বান্ধবি হুট হাট চলে এলে আর আমি সামনে পরে গেলে চোখ গুলো কেমন কটমট করে তাকায় আমার দিকে। অথচ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে এমনভাবে যেন বন্ধু বান্ধবি বুঝতে না পারে। আমিও মুখে হাসি ঝুলিয়ে/ টেনে রেখে সংকোচে সিঁটিয়ে থাকি। নাহ্…. মোটামুটি পরিধেয় সালোয়ার স্যুটে অন্তত কাজের বুয়া/ খালা তো মনে হচ্ছে না নিশ্চই! নইলে পাশের নতুন ফ্লাটের স্থুলাকার কাপ্তান( এটারে কি পোষাক বলে আমি ঠিক জানিনা।কাপ্তানই বলতে শুনেছি সবাইকে) পরিহিতা রমনী প্রথমেই ‘ ভাবী’ বলে সম্বোধন করতেন না নিশ্চই!! রুমটা আলো আঁধারিতে ডুবন্ত। বাইরের আকাশে ঠাঁসা মেঘ।ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মেয়েটা আমার এখনো নিজের রুমে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমে আছে। ছেলেরা একটাও ঘরে নেই। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আমি মেয়ের বারান্দার গাছে পানি দেই,নয়তো মরা পাতা বাছি। এলোভেরা গাছদুটোকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছি। তাকিয়ে থাকি অনেক্ষন। রিপটিং করা উচিৎ। অথচ মাটির অভাবে করা হচ্ছে না। মানি প্লান্টের লতাগুলো খুব বাড়া বেড়েছে। কিছু নতুন টব কেনা উচিৎ। হচ্ছেনা… লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, চলাফেরায় কড়াকড়ি।যাচ্ছেতাই অবস্থা। ছেলেদের ঘরে ঢুঁকলাম….. ছোটছেলে পরিপাটি করে ঘর গুছিয়ে রাখে প্রতিদিন। আমাকে দেখতে হয়না এসব। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখি গিজগিজে বিল্ডিংয়ের কোনাকাঞ্চি দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে…… তখনই আওয়াজ…..
: জি,, আমি…..
— এই বারান্দার ঘরটা কী আপনার?
: না,,, এ ঘরটা আমার দুই ছেলের।
— ওও,,, কিসে পড়ে ওরা?
প্রাথমিক পরিচয় কি এমনে হয়? কি জানি বাপু! উনি আমার ছেলদের খোঁজ নিচ্ছেন আগেই। কয় ছেলে মেয়ে আমার তাও জিজ্ঞেস না করে, ছেলেরা কে কোন ক্লাশে পড়ে তা জানতে চাইছেন আগে।
: বড় ছেলে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে জয়েন করলো কিছুদিন হলো। আর ছোট ছেলে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে তেজগাঁও কলেজে।
এটুকু বলেই চুপ করলাম।
আলেআঁধারে মটু ভাবীর কপালের ভাঁজ চোখ এড়ালো না। গলায় মোটা চেন, কানে ভারী ঝুমকো, আর হাতে মোটা স্বর্নের বালা দেখে আমি বড্ড হাঁসফাঁশ করছি। এরকম গয়নার দোকান নিয়ে সবসময় ঘোরাফিরা করেন কি করে কেউ ঘরের মধ্যে? এমনি চুড়িও পরে থাকতে পারিনা আমি, চুলার কাছে গেলে চুড়িও আগুনে গরম হয়ে ছ্যাঁকা দ্যায় আমারে। কানে কিছু পরলে বার বার হাত যায় কানে, এক্ষুনি খুলে ছুঁড়ে ফেলি এরকম মনে হয়। আর গলায়??? বড় ছেলেটা পিচ্চি থাকতে চেন ধরে,কানের দুল ধরে খালি টানাটানি করতো। চেনতো কোথায় খুলে পরে গ্যাছে!! খুঁজেই পাইনি আর। তারপর থেকে সেইযে সব খুলে রাখি! কোথাও যেতে হলে টুকটাক স্থান বুঝে পরি, নয়ত তাও পরিনা। এইসব ভাবীদের সামনে আমি বড্ড ক্যালাস টাইপ ভাবী*। কি আর করা!!
— দ্যাখেন ভাবি…. এই রুমটা আমার দুই মেয়ের। আমার মেয়েরা এখানে থাকে। আপনার ছেলেদের একটু সামলে থাকতে বলবেন…… কোনোরকম ঝামেলা যেন না হয়।আগে থাকতেই সতর্ক হওয়া ভালো। আমার মেয়েরাও বড় আপনার ছেলারাও বড়, পাশাপাশি বারান্দা….. আপনিও ছেলেদের বুঝিয়ে দেবেন, আমিও আমার মেয়েদের বুঝিয়ে বলব। দেখেন আগের দিনে এসব বারান্দা, পাশাপাশি ছাদ, পাশাপাশি জানলায় চোখাচোখি, হওয়া, তারপর মুচকি হাসি, তারপর চিঠি চালাচালি তারপর প্রেম পিরিতি বহুত কিছু হইয়া যাইত। তারপর মারামারি কাটাকাটি নয়তো বিয়া…. আমি বাপু আগেই বলে রাখি এইসব যেন আমার আপনার ছেলে মেয়ের মধ্যে না হয়……
আমি হতবাক…… জলহস্তি মহিলা গড়গড় কইরা কি কইলো প্রত্থম ধাক্কাতেই??? আমি তো হা….. এর জবাবে আমার কি কওয়া উচিৎ!!
: আপনারে ভাই আমি শতভাগ নিশ্চয়তা তো দিতে পারুম না! আমার বড় পোলারে কমুনে আপনার সতর্কবানী, আর ছোট পোলারে কমুনে বাবা তুই কিন্তু এহনো বড় হওনায়……
১২টি মন্তব্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা কি অবস্থা। ছেলের মা হয়ে এমন শাষানি খেতে হলো? শুনেই নিতেন তাদের মেয়েরা কি রাই গ্রুপের কেউ কিনা! কিছু মহিলা থাকে এমনিই কথা বলতে জানে না।
চেনা বামুনের পৈতা লাগে না। আমিও অবাক হই এতো গহনা পরে ঘুমায় ক্যামনে। আমাদের আপু এমনিই সুন্দর।
বন্যা লিপি
হাহাহা…… আমার পোলারা তো কেষ্ট কালা না, তাহার মেয়েরা রাই গ্রুপের হইলেও আমার পোলাগো পটাইতে পারব বইলা মনে হয়না।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বেশ জম্পেশ লিখলেন, দিদি।
শেষাংশে এসে দারুণ লাগলো।
আপনারে ভাই আমি শতভাগ নিশ্চয়তা তো দিতে পারুম না! আমার বড় পোলারে কমুনে আপনার সতর্কবানী, আর ছোট পোলারে কমুনে বাবা তুই কিন্তু এহনো বড় হওনায়…
হাহাহা😂
বন্যা লিপি
আমিও মজা নিতে জানি, কি বলো দাদাই😃😃
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ঠিক বলেছেন আমিও ঘরে থাকলে কিছুই পড়ে চলাফেরা করতে পারিনা। এসব পড়ে মানুষ ক্যামনে ঘুমায়, ঘরের কাজ সামলায় বুঝিনা। এসব মহিলারা আসলে অন্যকে দেখিয়ে মজা নিতে চায়। অহংকার আর ঈর্ষা এদের রগে রগে। মেয়ের মা হয়ে যে শাষানি দিলো ওরে বাপরে! ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন
বন্যা লিপি
আমিও তো চামে চিকনে শাসানী দিয়েই দিলাম দিদি!!
হালিমা আক্তার
মেয়েদের নিয়ে এত ভয়। শেষের অংশটা খুব ভালো লাগলো। শুভ কামনা।
বন্যা লিপি
এখন তো আমারও ভয় লাগতাছে আফা। আমার পোলাগো না আবার ইজ্জতের হ্যাম্পার হয়।
আরজু মুক্তা
ছেলের মা একটু ভাব নেন।
বন্যা লিপি
হ….. উনি আমার চক্ষু খুইলা দিলো। এইবার তো ভাব লওয়া শিইক্খাই ফালামু
রেজওয়ানা কবির
শেষটায় না হেসে পারলাম না🥰 হায়রে হায়!কোন কার্টেসী মেইনটেইন ছাড়াই একদম ডিরেক্ট একশন, এই যদি হয় মা তবে বোঝা যাচ্ছে মেয়েরা শাসনে কত অসহায় 😭। শুভকামনা আপু।
বন্যা লিপি
অর্থাৎ…. শেষটায় আপনি হাসার কারন খুঁজে পেলেন। যাক তাও ভালো।
শুভ কামনা।