পরে ময়রা ও মাধাইগঞ্জে ক্যাম্প খুললাম। এই দুই ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার মোহাজের দেওয়া হয়েছিল। অনেক শিক্ষিত ভদ্র ফ্যামিলিও এসেছিলেন। মোহাজেরদের আর আসানসোল এরিয়ায় জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা এর পরে বিষ্ণুপুর, অন্ডাল ও বর্ধমানেও কিছু কিছু মোহাজের পাঠালাম। আমার সাথে যে সমস্ত কর্মী ছিল, আহার নিদ্রার অভাব ও কাজের চাপে প্রায় সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই অনেককে পূর্বেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমারও জ্বর হয়ে গিয়েছিল। এই সময় মোহাম্মদ আলী ও এ.এফ.এম. আব্দুর রহমান মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা বেগম সোলায়মান, ইফফাত নসরুল্লাহ ও আরও কয়েকজন কর্মচারীসহ আসানসোলে আসেন। আমাকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিল। আমিও আসানসোলে তাঁদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাঁদের নিয়ে ক্যাম্পগুলি দেখান হয়েছিল। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁদের সাথেই কলকাতা রওয়ানা হয়ে আসতে বাধ্য হলাম। বেগম সোলায়মান আমার শরীর ও চেহারার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।
দেড় মাস পরে আমি কলকাতায় হাজির হলাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে। বেকার হোস্টেলে এসেই আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার জ্বর মোটেই ছাড়ছিল না। শহীদ সাহেব খবর পেয়ে এত কাজের ভিতরেও আমার মত সামান্য কর্মীর কথা ভুলেন নাই। ট্রপিক্যাল স্কুল অব মেডিসিনের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে আমার জন্য সিট ঠিক করে খবর পাঠিয়ে দিলেন। পনের দিন হাসপাতালে ছিলাম, তিনি ফোন করে প্রিন্সিপালের কাছ থেকে খোঁজ নিতেন। সেই জন্যই প্রিন্সিপাল আমাকে দেখতে আসতেন। আমি ভাল হয়ে আবার হোস্টেলে ফিরে এলাম।
আসানসোলে ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এবং নিজ হাতে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম, পরবর্তী জীবনে তা আমার অনেক উপকার করেছিল, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে। এই সময় মনস্থির করলাম, আমাকে বিএ পরীক্ষা দিতে হবে। ড. জুবেরী আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন, তাঁর সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি বললেন, “তুমি যথেষ্ট কাজ করেছ পাকিস্তান অর্জন করার জন্য। তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না। তুমি যদি ওয়াদা কর যে এই কয়েক মাস লেখাপড়া করবা এবং কলকাতা ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাবা এবং ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেই এসে পরীক্ষা দিবা, তাহলে তোমাকে আমি অনুমতি দিব।” তখন টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি ওয়াদা করলাম, প্রফেসর তাহের জামিল, প্রফেসর সাইদুর রহমান এবং প্রফেসর নাজির আহমদের সামনে। আমি অনুমতি নিয়ে আমার এক বাল্য বন্ধু ও সহপাঠী— তার নাম ছিল শেখ শাহাদত হোসেন, ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেছে, এখন হাওড়ার উল্টোডাঙ্গায় চাকরি করে, ওর কাছে চলে গেলাম, সমস্ত বইপত্র নিয়ে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-৭০ ও ৭১)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পর্ব-৫৭)
১০টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
যদি মননিবেশ হয় কাজে, সকলে করবে স্নেহ, ভক্তি সন্মান তাতে নাই কোন সন্দেহ, তাই তাঁকে সবাই বিশ্বাস করত। তাই শিক্ষক তাঁকে পরিক্ষার জন্য অনুমতি দিল। ভাল লাগলো আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এটাই সত্য। প্রাপ্তির আশা নিয়ে নয়, শুধুমাত্র মানবিকতা নিয়ে নাওয়াখাওয়া ভুলে মানুষকে যিনি সেবা দিয়ে গেছেন তিনিই তো হবেন মানুষের নেতা।
মোঃ মজিবর রহমান
ঠীক তাই আপু।
নীহারিকা জান্নাত
পড়ছি আর জানছি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু।
জিসান শা ইকরাম
মহান নেতার আত্মজীবনী পড়ছি আর ভাবছি, কিভাবে একজন নেতা জনতার হৃদয়ে স্থান করে নেন।
শুভ কামনা আপনার জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
জনতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বলে।
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু তোমার এই ধারাবাহিক পড়ছি আর ভাবছি আজকের নেতারা যদি অমন হতো!
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সেই আশা নিয়েই তো লিখতে শুরু করেছিলাম গো, প্রজন্ম জানুক মহাকালের একজন কিংবদন্তীর নেতা হয়ে উঠতে গেলে কতোটা জনবান্ধব হতে হয়।
নীলাঞ্জনা নীলা
কোনো একদিন এমন নেতা আসবে দেখে নিও।