কলকাতার মধ্যে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে মিসেস সোলায়মান, নবাবজাদা নসরুল্লাহর মেয়ে ইফফাত নসরুল্লাহ, বেগম আক্তার আতাহার আলী, সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদিকা নুরজাহান বেগম, বেগম রশিদ, রোকেয়া কবীর এবং মন্নুজান হোস্টেলের ও ব্র্যাবোর্ন কলেজের মেয়েরা খুবই পরিশ্রম করেছেন। রাতদিন রিফিউজি সেন্টারে এরা কাজ করতেন মেয়েদের ভিতর, আমাদের করতে হত পুরুষদের মধ্যে। রাতে অসুবিধা হত, তবুও হাজেরা মাহমুদ আলী, হালিমা নূরুদ্দিন আরও কয়েকজনকে সারারাত পরিশ্রম করতে দেখেছি। কলকাতার অবস্থা খুবই ভয়াবহ হয়ে গেছে। মুসলমানরা মুসলমান মহল্লায় চলে এসেছে। হিন্দুরা হিন্দু মহল্লায় চলে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার জায়গা ছিল একমাত্র এ্যাসপ্লানেডে, যাকে আমরা চৌরঙ্গী বলতাম। এখন অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। বেশ কিছুদিন কোনো গোলমাল নাই। হঠাৎ এক জায়গায় সামান্য গোলমাল আর ছোরা মারামারি শুরু হয়ে গেল। শহীদ সাহেব সমস্ত রাতদিন পরিশ্রম করছেন, শান্তি রক্ষা করবার জন্য। কলকাতায় চৌদ্দ-পনের শত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজন মুসলমান, অফিসারদের অবস্থাও প্রায় সেই রকম। শহীদ সাহেব লীগ সরকার চালাবেন কি করে? তিনি আরও একহাজার মুসলমানকে পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলে তদানীন্তন ইংরেজ গর্ভনর আপত্তি তুলেছিলেন। শহীদ সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে তিনি রাজী হন। পান্জাব থেকে যুদ্ধ ফেরত মিলিটারি লোকদের এনে ভর্তি করলেন। এতে ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাগজগুলি হৈচৈ বেশি করল।
কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হল নোয়াখালীতে। মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করল এবং আগুন লাগিয়ে দিল। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হল বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা। বিহার প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় মুসলমানদের উপর প্ল্যান করে আক্রমণ হয়েছিল। এতে অনেক লোক মারা যায়, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। দাঙ্গা শুরু হওয়ার তিন দিন পরেই আমরা রওয়ানা করলাম পাটনায়। বহু সেচ্ছসেবক রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। অনেক ডাক্তারও কলকাতা থেকে গিয়েছিল। আমার কলকাতার এক সহকর্মী মিস্টার ইয়াকুব, খুব ভাল ফটোগ্রাফার, সে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছে। ঘুরে ঘুরে অনেক ফটো তুলেছিল বিহার থেকে। জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন ও আমি যেদিন যাই সেদিন জনাব ফজলুল হক সাহেবও পাটনায় রওয়ানা দিলেন। শহীদ সাহেব পাটনায় মুসলিম লীগ নেতাদের খবর দিলেন যে কোন সাহায্য প্রয়োজন হলে বেঙ্গল সরকার দিতে রাজি আছে। বিহার সরকারকেও তিনি একথা জানিয়ে দিলেন।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-৬৮-৬৯)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পর্ব-৫৪
১০টি মন্তব্য
ইঞ্জা
মনে হচ্ছে যেন নিজেও আছি তাদেরই দলে, এতো বড় লেখা লিখছেন সময় নিয়ে তার জন্য অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যৌগ্য আপনি আপু, শুভকামনা
মারজানা ফেরদৌস রুবা
লিখাটা যে উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করেছিলাম, সে উদ্দেশ্য যে খুব একটা কাজে লাগছে না সেটা গত এক বছরেই বুঝে গিয়েছি। তবে এখনো লিখে যাচ্ছি দেশের বাইরে অবস্থান করা লোকজন হয়তো পড়তে পারছে।
ইঞ্জা
আপু আপনার লেখাটা ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় যা আমরা জানছি, অনুপ্রেরণা পাচ্ছি, আপনি লিখে যান, পাশে আছি।
মোঃ মজিবর রহমান
সেবক হতে না পারলে রাজনিতির খাতায় নাম লেখাই বেমানান।
সঙ্গে আছি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
রাজনীতির মূলই তো হচ্ছে মানুষের সেবা। সেজন্যে তখনকার সময়ে তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ছিলো অসামান্য কিন্তু এখন রাজনীতিকে ঠকবাজরা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে বলেই মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে না।
জিসান শা ইকরাম
হিন্দু মুসলিম বিভেদ তখন থেকে যে শুরু হয়েছিল, তা আর কখনোই বন্ধ হবে বলে মনে হয়না।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বৃটিশরা যে বিষ ভারতীয় উপমহাদেশে ঢেলে গিয়েছিলো জনমভর তা চলতেই আছে, কখনও সীমাহীন বেড়ে যায়, কখনো কিছুকাল থেমে থাকে, এই।
শুন্য শুন্যালয়
সেই বিষ এখনো আছে, তবে সেই মহান ওঝা, সেবক আমাদের মাঝে আর খুঁজে পাওয়া যায়না।
নিহারীকা জান্নাত
স্বাধীনতার এত বছর পরও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছেই।
নীলাঞ্জনা নীলা
সাধে কি আর বলা হয় ব্রিটিশি বুদ্ধি?
বাঙ্গালী আর মানুষ হলোনা।
রুবা’পু তোমার এই পোষ্টটা খুব মন দিয়ে পড়ি আর মনে হয় আমি যেনো সেই সময়ে চলে গেছি।
চোখে ভাসে সেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা আর ধর্মের নামে মানুষ হত্যা।
সামনের শনিবারের অপেক্ষা আবার শুরু হলো।
ভালো থেকো। -{@