ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদররা? বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়জি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ করতাম। এর কারণও যথেষ্ট ছিল। একসাথে পড়ালেখা করতাম, একসাথে বল খেলতাম, একসাথে বেড়াতাম, বন্ধুত্ব ছিলো হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সম্মান পেত হিন্দু মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি যখন কোনো হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, আমাকে অনেক সময় তাদের ঘরের মধ্যে নিতে সাহস করত না আমার সহপাঠীরা।
একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিলো। আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসতো। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদোকাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, “ননী কি হয়েছে?” ননী আমাকে বলল, ” তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।” বললাম, “যাব না, তুই আসিস।” আরও অনেক হিন্দু ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন একথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। কারণ আমাদের বাড়িতে হিন্দুরা যারা আসত প্রায় সকলেই আমাদের শ্রদ্ধা করত। হিন্দুদের কয়েকটা গ্রামও ছিল, যেগুলির বাসিন্দারা আমাদের বংশের কোনো না কোনো শরিকের প্রজা ছিল।
হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তারা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন। একথাও সত্য মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত হিন্দু হিসাবে নয়, প্রজা হিসাবে। এই সময় যখনই কোন মুসলমান নেতা মুসলমানদের জন্য নায্য অধিকার দাবি করত তখনই দেখা যেত হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুনী সম্প্রদায়ও চিৎকার করে বাধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও ‘পাকিস্তান’ সম্বন্ধে আলোচনা ও বক্তৃতা শুরু করার পূর্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গালি দিয়ে শুরু করতেন।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ২৩ ও ২৪ )
১৭টি মন্তব্য
খসড়া
ধন্যবাদ
মারজানা ফেরদৌস রুবা
-{@
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত সহজ সাধারণ ভাবে হিন্দু মুসলমানদের পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ক্রোধকে বর্ননা করেছেন বঙ্গবন্ধু।
দেখতে দেখতে ১৮ টি পর্ব লিখে ফেললেন,
মনে হয় এই তো সেদিন,
আসলে শুরু করাটাই আসল, বড় কাজ এক সময় আর বড় মনে হয়না।
আলাদা করে ধন্যবাদ আর দিলাম না প্রিয় ব্লগার।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সর্বদা পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
লিখতে যখন শুরু করেছি শেষ হবে একদিন।
আপনার মাধ্যমে মডারেটদের প্রতি অনুরোধ রইলো যেহেতু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ একটি সিরিজ প্রকাশনা এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক তাই কষ্ট করে প্রতিটা সিরিজের পূর্বেকার লিঙ্কটা সংযোগ করে দিলে পাঠকের বিশেষ উপকার হয়। সম্ভবত আমি ট্যাব থেকে প্রকাশনার কাজটা করছি বলে অনেক চেষ্টার পরও লিঙ্ক সংযোগ দিতে পারি না।
আবারও ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
মডারেটরগন লিংক যুক্ত করে দিচ্ছেন তো, দেখলাম।
ট্যাবেও পারা যায় লিংক দিতে।
শিখে যাবেন আশাকরি।
রিমি রুম্মান
সবগুলো পর্বই পড়া হয়। মন্তব্য করা হয়না যদিও। ছেলেকে স্কুলে কিংবা কোচিং এ দিয়ে গাড়িতে বসে বসে তথ্যবহুল এই আত্মজীবনীটি পড়ি। শুভকামনা জানবেন, আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল লাগলো অধিকার আদায়ে সংগ্রাআমী বাংলার অবিসংবাদী নেতাকে।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু
মারজানা ফেরদৌস রুবা
জয় বাংলা………
জয় বঙ্গবন্ধু।
দীপংকর চন্দ
ধৈর্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
জানবেন শুভকামনাও।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনুপ্রেরণা যুগিয়ে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হিন্দু মুসলমানদের এমন সামাজিক বাধা এখনো বিদ্যমান।চলুক -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বৃটিশরা এর বীজ বপন করে গেছে, যা আজও বিদ্যমান।
ধন্যবাদ।
ব্লগার সজীব
বঙ্গবন্ধু মনে প্রানে একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন, অথচ মৃত্যুর পরে তাকে মুসলিম বিরোধী হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের একটি বিশাল অংশ এ কথা বিশ্বাসও করেছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ভ্রান্ত কিছু ছড়িয়ে দেয়া ধারণা মলিনের বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রকাশের এমন গুরুভার হাতে নিয়েছি। মানুষ জানুক, কতোখানি গুনে গুণান্বিত থাকলে একজন মানুষ কিংবদন্তী হয়ে উঠতে পারেন। বইটা অনেক বড় (৩০০ পেজ) বলে বই বিমুখ বাঙালী সহজে হাতে নিতে চাইবে না। এখান থেকে বা ফেবু থেকে কেউ যদি ২/৪ টা পর্বও পড়ে তো এখানেই কষ্টের সার্থকতা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু চলুক। আছি সাথে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
🙂 থাকুন। ধন্যবাদ।