আমাদের কিভাবে দেখা হয়েছিল?
সেই প্রথমবার? নতুন কাউকে দেখার অনুভূতিতে প্রগলভ হওয়ার সেই মুহুর্তগুলো কেমন ছিল? এমন একজন… যাকে দেখলে ভালোলাগার ডানায় ভর করে ঝড়ো বাতাসে পরমশূন্য অনুভূতিতে হাল্কা হলুদ পাতার মত এলোমেলো ভেসে বেড়াতে মন চায়! সবারই কি এমন কিছু মুহুর্ত থাকে না?
আমার ও ছিল।
আমি তো আমিই। আর ও হল ‘ও’।
সেই সময়ে আমরা দুজনে কিন্তু ‘আমরা’ হতে না পেরেও অদৃশ্য এক পলকা বাঁধনে কিভাবে যেন মানসিকভাবে কাছে ছিলাম। তারপরও প্রতিটি বিরূপ পরিস্থিতি এবং খারাপ সময়গুলোতেও ‘ও’ আর আমি ‘আমরা হয়ে যেতাম। দুজনের আলাদা জগত-পরিবার এবং প্রকৃতি-প্রবণতা স্বত্বেও কিছু মিল তো অবশ্যই ছিল।
‘ও’ আমাকে বুঝত। সময়ে আমার সাথে ঝুঝত। দূরে থেকেও অনুভূতিতে আচড়ে খামচে বিপর্যস্ত করে তোলার এক আশ্চর্য স্কখমতা ওর ছিল।
যা বলছিলাম। ‘ও’র সাথে আমার প্রথম দেখা হবার দিনটির কথা।
তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছি। নতুন পরিবেশ-মানুষ, নতুন চিন্তাভাবনা পুরনো কিছু কাছের মানুষদের সান্নিধ্যে খুব আনন্দে কেটে যাচ্ছিল।
তখন নতুন মোবাইল নিয়েছি। ঐ সময়ে খুবই দামী ছিল মোবাইল। আজকের মত সবার কাছে ছিল না। মোবাইলেই ওর সাথে ‘ক্রস-কানেকশন’ দ্বারা প্রথম কথা হল। ভুলে অচেনা একজন ‘ও’ হিসাবে প্রথম কথা হল। ইথারে ভেসে আসা একটি জড় বস্তুর ভিতর দিয়ে সেদিন যে প্রাণের শাব্দিক পরশ হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল- সে কি আজও ভুলবার! জীবনে চলার পথে তখন একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা ভী…ষ…ণ ভাবে অনুভব করছিলাম। এমন একজন সাথী… একেবারে হুমায়ুন আহমেদ এর গল্পের নায়িকার মত। যে অনুভূতিতে দীঘির শান্ত জলের প্রশান্তিময় সন্তরণের প্রগাড় অনুভবের উপলব্ধি এনে দেয়! আমাকে আমার সকল সম্পর্কগুলোকে সহই অণুক্ষণ ভাবে… কাছে থাকার চমৎকার কিছু উপলব্ধিতে মনকে আপ্লুত করে তোলে। এমনই একজনকে দিবানিশি এ মন ভাবতো। কাঁদত। খুঁজত।
দিনগুলো এমনই ছিল ঐ সময়ে আমার।
কিভাবে যেন রাতের পর রাত ‘ও’র সাথে মোবাইলে কথা বলে বলে সেই অপরিচিতা একজন আমার পরিচিত ‘ও’ হয়ে গেল। আমি ডুবে গেলাম ওর মাঝে। সে থেকে ‘ও’ হবার পরে ‘ও’ ও কি আমার ভিতরে ডুবছিল না? একেবারে ভেসে না গিয়ে ধীরে ধীরে আমরা কাছে আসছিলাম। কিন্তু ভিন্ন অবস্থানে থেকে। তখনো সামনা সামনি আমাদের দেখা হয়নি। তবে আমরা দুজন নিজেদের যার যার ছবি এঁকে অন্যকে দিয়েছিলাম। ‘ও’র ছবি নিয়ে মোবাইলে কথা বলে বলে ‘ও’কে নিয়ে ভাবতাম কেবলি।
দুজনে দুই ভিন্ন শহরে তখন। তবে দূরত্ব ছিল মাত্র দুই ঘন্টার। দুটো সীমান্তবর্তী শহরে একেবারে প্রান্তসীমায় ছিলাম দুজনে।
দুটি হৃদয়
এক যুবক আর এক যুবতী
যারা এক হতে চাচ্ছিল।
মনে পড়ে সেই দিনের কথা…
প্রতিদিনের মতো সেদিনও একই সময়ে ঘুম থেকে উঠলাম। বিছানায় শুয়েই চিন্তা করলাম আজকের প্ল্যান কি কি। ভোর রাতে একটু শীত করাতে বিছানার চাদরটাই শরীরে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। রুমমেট ফজরের আজান দিতেই মসজিদে চলে গেছে। এখনো ফিরেনি। বুঝলাম রেডিওতা ছাড়া নেই এজন্যই।
রুমে আমি একা।
একটু একটু শীত এখনো করছে। উঠে রেডিওটা ছাড়লাম। যদিও একটা টিভি রয়েছে। তারপরও প্রতিদিন রেডিওতে সকাল সাতটার নিউজ শোনাটা এখন নেশার মতো হয়ে গেছে। এটা শুরু হলেই কীভাবে যেন ঘুম ভাঙ্গে।
একটা অ্যালার্ম ঘড়ির কাজ করে এখন রেডিওর এই খবরটি।
অফিসে এসে অন্যদের থেকে জানলাম আজ পহেলা ফাল্গুন!
মেয়েরা বাসন্তি রং এর শাড়ি পড়ে এসেছে। কলিগদের ও ফাগুনের আগুন রাঙা পোষাক! আর আমি কিনা এসেছি মান্ধাতার আমলের সেই চিরাচরিত ফুল হাতা পোলো শার্ট পরে?
মনের ভিতর একটু অভিমানের জমাট কুয়াশা অনুভব করলাম।
‘ও’ একবার ফোন ও তো করতে পারত!
কেন করল না?
মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার মনে করলাম ফোন করি। পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দিলাম। দৃঢ় চোয়ালে হৃদয়ের রুক্ষতা প্রকাশ পেল।
থাকুক সে একা… তার মত।
এগারটা পর্যন্ত একটানা কাজের ভিতরে ডুবে থাকলাম।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করেই যাচ্ছিল। দুবার জেনারেল ম্যানেজারের রুমে ডাক পড়ল। জটিল কিছু ইস্যুতে নতুন করে নোট দিলেন। সেগুলো দ্রুত শেষ করার নির্দেশ পেয়ে আবার নিজের কেবিনে। কাগজগুলো টেবিলে সব এলোমেলো।
ঠিক আমার মনটার মতই।
বার বার মোবাইলের কী-গুলো একটি বিশেষ নাম্বারে প্রেস করার জন্য মনটা নিশপিশ করছে। কিন্তু ঐ যে কাঠখোট্টা মনের একাংশ জমাট বেঁধে রয়েছে!
অভিমানী মন!!
সিকিউরিটি ফোন করল।
‘স্যার, আপনার একজন গেস্ট এসেছে। ‘
‘ কোথায় এখন?’
‘ গেস্ট রুমে…’
‘আচ্ছা আমি আসছি।’
কে হতে পারে? কোনো সাপ্লাইয়ার? আজকাল অপরিচিত বিভিন্ন নতুন সাপ্লাইয়ার এসে প্রায়ই বিরক্ত করছে। সেরকমই কেউ হবে হয়ত।
তবে গেস্ট রুমে যেয়ে যাকে দেখলাম…
এতোটা আশা করিনি। হৃদয়ে একটা মিশ্র অনুভুতি খেলা করে গেলো। আনন্দ চেপে ভ্রু কুঁচকে বললাম
‘তুমি?’
‘হ্যা, আমি… কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি?’
বাসন্তি রঙের শাড়ি পরা ‘ও’কে কেমন স্বপ্নের রাজকন্যার মত লাগছে! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
‘কি হল? হা করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই নাও… তোমার ফতুয়া। পরে ছুটি নিয়ে নাও। আমি রিক্সা নিয়ে এসেছি…’
‘এতো দূর থেকে রিক্সায় করে এসেছ!?
‘ওমা, এতোদূর কোথায়?সেই স্টেশন থেকে। তোমাকে নিয়ে আজ সারাদিন রিক্সায় ঘুরব।’
১০ মিনিট পর…
হাইওয়ে দিয়ে রিক্সায় করে আমি এবং’ও’ ফাল্গুনের প্রথম দিনে সোনাঝরা রোদ্দুর মেখে নিয়ে চলছি। বাতাসে ‘ও’র চুলগুলো উড়ে এসে আমার মুখে লাগছে! অন্য সময় হলে হয়তো আমার বিরক্ত লাগত। আজ লাগছে না। ‘ও’র একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বললাম,
‘আমাকে ভালোবাসো?’
‘জানি না…’
বলেই হাসলো…অন্য সময় এই হাসির কি অর্থ হতো আমি জানি না। কিন্তু আজ কেন জানি আমার সকল উত্তর লুকিয়ে প্রকাশমান ছিল সেই হাসিতে। মিষ্টি একটি মেয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল… পরম নির্ভরতায়… সকল ভাললাগা আর আবেগে মাখামাখি হয়ে ‘ও’র হৃদয়টাই দিয়েই যেন আমাকে ধরে রেখেছে। ফাগুনের প্রথম দিনে বসন্ত ছুঁয়ে গেলো আমাদের চকিতে… সেই ছিল আমাদের প্রথম প্রহর!!
৬টি মন্তব্য
আবু জাকারিয়া
ভালই লাগল কাহিনীটা। খুব সহজ ভাষায় উঠে এসেছে।
মামুন
অনেক ধন্যবাদ।
ব্লগ সঞ্চালক
”৫/ সোনেলা পোস্ট ফ্লাডিং নিরুৎসাহিত করে। একজন ব্লগার দিনে একের অধিক পোস্ট না দেন , সোনেলা এটি প্রত্যাশা করে। ২৪ ঘন্টায় কোন ব্লগারের একাধিক পোস্ট হলে , একটি রেখে অন্য সব পোস্ট খসড়ায় রেখে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে ব্লগার ইচ্ছে করলে পরেরদিন খসড়ায় জমাকৃত পোস্ট পুনঃ পোস্ট দিতে পারবেন।”
https://sonelablog.com/tac
মামুন
দুঃখিত এটাই প্রথম হল। তাও ভুলে। ১০ঃ৩৬ অপরাহ্ন কে ভুলে ১০ঃ১৬ সকাল মনে করেছিলাম। আপনি আমার শেষ পোষ্টটি ডিলিট করে দিন। আমি ২৪ ঘন্টা পার হলে আবার পোষ্ট করবো।
ছারপোকা
ভাল লেগেছে ।নিয়মিত লিখতে থাকুন ।
মামুন
ধন্যবাদ।