
৪ঠা জুলাই ছিল আমারিকার নাগরিকদের জন্যে একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন। দেশটির ২৪৫ তম স্বাধীনতা দিবস। প্রায় দুই যুগ আগে আমি যখন এ দেশের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করি, তখন জেনেছি, নাগরিকত্বের পরীক্ষায় পাশ করতে হলে এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানাটা অত্যাবশ্যকীয়।
যেহেতু দিনটি আমেরিকার নাগরিকদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, তাই ঐতিহ্যগতভাবে আমেরিকার নাগরিকরা দিনটি উদযাপন করে থাকে কুচকাওয়াজ আর আতশবাজির মাধ্যমে। বহু বছর যাবত দেখে এসেছি নিউইয়র্কে দুপুর থেকেই মানুষ দলে দলে সপরিবারে নদীতীরে সমবেত হতে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে হাজার হাজার উৎসুক চোখ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আঁধার ঘন হয়ে এলে আকাশ কাঁপিয়ে আতশবাজি হবে সেই আশায়। কেউ নদীর ধারে, কেউ ব্রিজের উপরে। কেউ হাত ধরাধরি করে দাঁড়ায়, কেউবা কয়দিন আগেই জন্ম নেয়া শিশুকে বুকে জড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে। পুরো পরিবেশটা কেমন সহজ, সরল এবং স্বতঃস্ফূর্ত থাকে। আমরাও আমাদের আমেরিকায় জন্ম নেয়া এবং বেড়ে উঠা সন্তানদের নিয়ে নদীতীরে গিয়েছি প্রতিবার। সুবিধাজনক স্থানে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। কখনোবা সন্তানরা আতশবাজি দেখার সুবিধার্থে বাবার কাঁধে চড়ে খাঁখাঁ রোদ্দুরে অপেক্ষায় থেকেছে। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলে দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে নিউইয়র্কের আকাশ আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। আতশবাজির মুহুর্মুহু শব্দে শিশুসহ সমবেত সকলে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছে। সন্ধ্যার আতশবাজি দেখা, একফালি চাঁদের মুগ্ধতা, আর রক্তিম গোধূলি, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!
সেই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে এবার বন্ধুদের বিশাল বহর নিয়ে গিয়েছিলাম মন্টাক। মন্টাক, নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড উপদ্বীপের শেষপ্রান্তে অবস্হিত একটি গ্রাম। যেখানে রয়েছে লাইট হাউজ মিউজিয়াম। বাতিঘরের গা ঘেঁসে আছড়ে পড়ে সমুদ্রতরঙ্গের ফেনা।
অন্যবারের তুলনায় এবারের স্বাধীনতা দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অতীতে নাইন ইলেভেন সহ একাধিক বিপর্যয় নেমে এলেও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন থেকে বিরত থাকতে হয়নি দেশটির নাগরিকদের। কিন্তু ভয়াবহ করোনা মহামারির থাবায় লণ্ডভণ্ড আমেরিকা প্রথমবারের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই দিবসটি উদযাপন থেকে বিরত থেকেছে গতবছর। আমরা মহাসমারোহে, মহাগৌরবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে পারিনি। বর্ণাঢ্য প্যারেড হয়নি। আতশবাজির উৎসব হয়নি। শপিংমলে মূল্যছাড়ের আহ্বানে হুমড়ি খেয়ে পড়েনি মানুষ। অগণন প্রাণহানি আর পাহাড়সম ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানো দেশটি ব্যাপকভাবে আশাবাদী হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিল এবারের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিকল্পনা ছিল, এবার ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবসের আগেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের। দেশের নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, “আমরা যদি সকলে মিলে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে এটা করতে পারি, তাহলে আপনাদের নিজের পরিবারের, বন্ধুদের সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের দারুণ সুযোগ রয়েছে।” তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। নাগরিকরা সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবে এগিয়ে এসেছে। টিকা দিয়েছে। আমরা সত্যিই করোনা ভাইরাস থেকেও স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছি।
প্রতিবছর স্কুল কলেজ গুলোয় গ্রীষ্মের ছুটি থাকায় এদেশের সকলের কাছে স্বাধীনতা দিবস একরকম উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। সরকারি ছুটির এই দিনটির সঙ্গে মিলিয়ে আগে পরে আরও কয় দিন ছুটি নেয় অভিভাবকরা। সন্তানদের নিয়ে দূর-দুরান্তে ঘুরতে চলে যান। দিবসটিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ কোটি আমেরিকান বাড়ির বাইরে দর্শনীয় স্থান কিংবা অন্য অঙ্গরাজ্যে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন। আমার এদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা, সদ্য হাইস্কুল গ্রাজুয়েশন করা সন্তানের কাছে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে তার ভাবনা জানতে চাইলে জানায়, ‘ নিজের জন্মদিনের চেয়েও আমেরিকার জন্মদিন পালন আমার কাছে বেশি আনন্দের। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভৌগলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ বাক এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জনেরও দিবস এটি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্যে কাজ করার স্বাধীনতা।’
সত্যিই অসাধারণ এক দেশ আমেরিকা। এ দেশে আমি আমার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছি। ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতার মানবিক এই দেশটিকে ভালো না বেসে পারা যায় না। এই দেশে আমরা মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ করে ঈদের নামাজ আদায় করি। রমজান পালনসহ নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করি। প্রশাসন এবং জনগন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এইদেশে চলতি পথে, বাসে, ট্রেনে শারীরিক, মানসিকভাবে অক্ষম মানুষ কিংবা বয়োবৃদ্ধদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সকলে। এই মানবিক দৃষ্টিকোণটুকু দারুণভাবে আবেগাপ্লুত করে। এই যে সন্তান অসুস্হ হলে রাত-বিরাতে নির্ভয়ে একাকি ড্রাইভ করে ছুটে যাই হাসপাতালে, সময়মত চিকিৎসা সেবা, ঔষধ নিয়ে নির্ভার ফিরে আসি ঘরে, এমন দেশকে ভালো না বেসে উপায় কী! ভালোবাসি এই দেশের সবুজ প্রান্তর, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, পাহাড়, নদী, হ্রদ। ভালোবাসি সাগর, সবুজ অরণ্য। মাতৃভূমি বাংলাদেশের পর এটি আমার দ্বিতীয় ভালোবাসার দেশ। যে দেশের প্রগাঢ় স্বাধীনতা আমায় টানে ভীষণভাবে। আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান এর একটি লেখা প্রবলভাবে হৃদয়ে ধারণ করি। তিনি লিখেছিলেন, “আমি খোলা রাস্তায় বের হলাম একটি সুস্থ ও স্বাধীন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। এটাই কি আমেরিকা নয়?”
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের দেশ আমেরিকার ২৪৫তম স্বাধীনতা দিবসে ডঃ মার্টিন লুথার কিং এর একটি উক্তি না বললেই নয়। তিনি বলেছিলেন, ” আমেরিকান স্বপ্ন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এবং এই স্বাধীনতা দিবসে আমাদের নতুন করে মনে করা উচিত- প্রতিটি মানুষ মর্যাদা আর মূল্যের উত্তরাধিকার।” সকলকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
কুইন্স, নিউইয়র্ক
৭টি মন্তব্য
তৌহিদুল ইসলাম
পশ্চিমারা বরাবরই নিজেদের সভ্য হিসেবে প্রমাণ করেছে। তাদের সবকিছু সিস্টেমিক ওয়েতে নিজেরাই পরিচালনা করে এবং জনগন তা মেনে চলে বিধায় তারা সভ্য। আমাদের দেশেও একদিন এরকম হবে।
শুভেচ্ছা রইলো আপু।
রিমি রুম্মান
এই দেশের কাছে আমার অনেক ঋণ। দেশটিকে নিয়ে আরো লিখবো আশা করছি।
তৌহিদুল ইসলাম
পড়ার অপেক্ষায় রইলাম আপু।
মনির হোসেন মমি
বিদেশটা ভাল লাগে তাদের নিয়ম শৃংখলা এবং সহমর্মিতার কারনে।জেনে ভাল লাগল একটা বিধর্মী দেশে সকল ধর্মের সমান মর্যাদা।
ভাল থাকবেন।সুস্থ থাকবেন।
আরজু মুক্তা
অনেক কিছু জানলাম।
শুভ কামনা আপি
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত আমেরিকা সম্পর্কে লেখা পোষ্টে ভালোলাগা অনেক অনেক।
আমেরিকার করোনা থেকে মুক্ত হয়েছে সে দেশের জনগনের সহযোগিতা এবং সরকারের দৃঢ়তার কারনে। যা আমাদের দেশে নেই। দেশের গ্রামের ৯৫% জনগন করোনা নামে যে একটি প্রানঘাতি রোগ আছে তা বিশ্বাস করেনা। অবাদে চলাচলের কারনে এবার আক্রান্ত হচ্ছে গ্রামের মানুষ বেশী।
জীবন যাপন কত সুন্দর হতে পারে তা আমেরিকা সহ উন্নত বিশ্বে না থাকলে বুঝা যাবে না। নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ইত্যাদি এসব দেশেই আছে।
প্রবাসে ভালো থেকো দিদি ভাই।
হালিমা আক্তার
স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। সে দেশের সরকারের পাশাপাশি জনগণ আইন মেনে চলতে প্রস্তুত।যার ফলে সবকিছুতে দ্রুত সফলতা লাভ করতে পারে। আমাদের দেশে মানুষ মরে গেলে, লাশ নিয়েও রাজনীতি চলে। ধর্মের দোহাই দিয়ে অসচেতনতা তো আছেই। ভালো থাকুন। নতুন লেখার অপেক্ষায় রইলাম।