ফটোগ্রাফীর শুরু দিকে যে পাখির ছবিগুলি প্রথমে তুলেছিলাম তারমধ্যে মুনিয়া প্রজাতির তিলামুনিয়া প্রথম পাখি ছিল। তিলা মুনিয়া ছাড়া সে পর্যন্ত আর কোন মুনিয়া পাখির ছবি তোলা হয়নি। সময়টা ছিলো ২০০৯ সাল। প্রথম তিলামুনিয়া তোলা হয় ঢাকার শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন জুড়ে ছিমছাম একটা পরিবেশ ছিলো । ছোট্ট পরিসরে ছাত্রদের গবেষনার জন্য প্রায় ৫ বিঘা জমির একটি মাঠে কৃষির আবাদ হতো। ধান, গম, ভূট্টা, তিল, সরিষা থেকে শুরু করে হরেক জাতের ফসল আবাদ হতো। মূলতঃ এটা ছিলো কৃষি অনুষদের ছাত্রদের ব্যাবহারিক ক্লাশ ও গবেষনা। সেই সময় বার্ড ফটোগ্রাফীর প্রতি বাচ্চাদের খুব একটা জোক ছিল না। হাতে গোনা কয়েকজন বার্ড ফটোগ্রাফী করতো। অবসর সময়ে প্রায়ই আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখির ছবি তুলতে যেতাম। সেই সময় আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে ২৫ প্রজাতি পাখির ছবি তোলা ছিলো। পাখিদের অভয়ারণ্য বললেও ভুল হবে না। এখন আর সেখানে পাখির কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। প্রায়ই পাখি শূন্য। তার মূল কারন হচ্ছে, আধুনিক প্রযুু্ক্তির ছোঁয়া আজ মাঠেও পড়েছে।
পরবর্তীতে গত ৬ বছর ধরে ঢাকার উত্তরায় দিয়াবাড়িতে নিয়মিত মুনিয়া প্রজাতি পাখির ছবি তুলে আসছি।
তিলা মুনিয়াবাদামি রঙের Estrildidae (ইস্ট্রিল্ডিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Lonchura (লঙ্কুরা) গণের অন্তর্গত এক প্রজাতির ছোট ছটফটে তৃণচর পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ১১.৫ সেমি ডানা ৫.৬ সেমি, ঠোঁট ১.৩ সেমি, পা ১.৫ সেমি, লেজ ৩.৮ সেমি ও ওজন ১৩.৬ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পুরো পিঠ জলপাই-বাদামি। কোমরে সাদা ডোরা থাকে। লেজ-উপরি ঢাকনি লালচে-কমলা। লেজ খাটো ও সূচালো এবং লালচে-কমলা রঙের। থুতনি কালচে। বুকের উপরের অংশ তামাটে এবং দেহতল সাদা। বগলে ও পেটে কালো আঁশের মত তিলা থাকে। এর ত্রিকোণাকার ঠোঁট স্লেট কালো। চোখ কমলা-বাদামি। পা ও পায়ের পাতা স্লেট রঙের। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা একই রকম; তবে পুরুষ পাখির দেহতল ও থুতনি স্ত্রী পাখির তুলনায় গাঢ়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ বাদামি; দেহতল লালচে-পীত ও হালকা পীত বর্ণ। ঠোঁট শিঙ বাদামি ও চোখ বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের অনেকসময় অপ্রাপ্তবয়স্ক কালোমাথা মুনিয়া বলে মনে হয়।
তিলা মুনিয়া ফসলের খেত, মাঠ, নলখাগড়ার বন, বাগান ও ঝোপে ঝাঁকে ঝাঁকে বিচরণ করে। মাঝে মাঝে ১০০ বা তারও বেশি পাখির ঝাঁক দেখা যায়। মাটি, ঘাস বা ধানের মধ্যে এরা খাবার খোঁজে। এদের ঠোঁট খাটো ও বেশ শক্ত। ধান বা অন্যান্য শস্যদানা মুখে রেখেই তা থেকে শক্ত খোসা ছাড়িয়ে নিতে পারে। এছাড়া ঘাসবীচি, রসালো ফল ও কীটপতঙ্গও খায়। অন্যান্য মুনিয়া ও বাবুইয়ের সাথে দল বেঁধে এরা ঝোপ, আখখেত বা ঘাসবনে রাত কাটায়। সচরাচর শ্রুতিকটু স্বরে ডাকে: কিটি-কিটি-কিটি….., কিটি-ইইইইই…., কি-কি-কি-কি-কি-টিইই…., চিক্, ট্র্যাট-ট্র্যাট।
মে-সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। খেজুরগাছের পাতার আড়ালে, লতার ঝোপে, বাবলা, ঝাউ, কেয়া, কান্তা, দেবদারু বা অন্যান্য ঝোপাকৃতির গাছে ২ থেকে ৫ মিটার উঁচুতে গোলাকৃতির বাসা বোনে। ঘাস-লতা-ধানের পাতা, পালক ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর, নরম ও তুলট বাসার ভিত্তি রচনা করে। কাশফুল দিয়ে চারপাশটা মুড়ে নেয়। বাসার ভেতরে থাকে কাশফুলের গদি। বাসায় ঢোকার জন্য গোপন সরু পথ বানায়, যেন শত্রুরা না দেখে। এছাড়া কার্নিশের নিচে বা খালি কার্টনেও বাসা করে। স্ত্রী মুনিয়া চার থেকে দশটি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। ডিমের মাপ ১.৬ × ১.১ সেমি। স্বামী-স্ত্রী মিলে ১৩ থেকে ১৬ দিন তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাবা-মা উভয়ে মিলে ছানাদের পরিচর্যা সহ সংসারের যাবতীয় কাজ করে থাকে। ছানাগুলি উড়তে শিখলে বাবা-মা’র দায়িত্ব পালন শেষ হয়।
শহুরে মানুষের কাছে পোষা পাখি হিসেবে তিলা মুনিয়া বেশ জনপ্রিয়। খাঁচাবন্দী মুনিয়া রাস্তাঘাট ও পোষা পশুপাখির দোকানে বিক্রি হয়। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিক্রেতারা এদের গায়ে নীল, হলুদ, সবুজ বা উজ্জ্বল রং লাগিয়ে দেয়, যা গোসল করালেই উঠে যায়। বাংলাদেশে গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এদের জাল দিয়ে ধরে টঙ্গী, ঢাকার কাঁটাবন ও অন্যান্য স্থানে প্রচুর সংখ্যায় বিক্রি করা হয়। সেজন্য বর্তমানে বাংলাদেশে এদের অবস্থা বেশ খারাপ।
বাংলা নামঃতিলা মুনিয়া
ইংরেজী নামঃ Scaly-breasted Munia
বৈজ্ঞানিক নামঃLonchura punctulata
ছবিগুলি ঢাকার দিয়া বাড়ি ও শেরে বংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলা।
মুনিয়ার প্রজনন ক্ষেত্র ধীরে ধীরে আমাদের নিজেদের জন্যই বিলুপ্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় এই পাখি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রত্যেকের সচেতনতা জরুরি। আমার মনে হয় বন বিভাগ এই বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নিতে পারে।
লাল মুনিয়ার মতো তিলা মুনিয়াও দেখতে খুবই সুন্দর। চমৎকার পোস্ট ভাই।
যদিও এখনো এই তিলা মুনিয়া হুমকির মুখে নয়। তারপরও মানুষ যদি মুনিয়া প্রজাতি পাখির খাঁচায় পোষা বন্ধ না করে তাহলে একদিন এরা চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের দেশ থেকে। মানুষ নিজ থেকে যদি সচেতন না হয় তবে তাকে ঘাড় ধরে সচেতন করা যায় না।
শুভ কামনা রইলো ভাইজান।
পুরোপুরি একমত আপনার সাথে। এমন করেই তো অন্যান্য পাখি ও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অসচেতনতার কারণে। চমৎকার বর্ণনা আর চমৎকার ছবিতে আবার ও মন জুড়িয়ে গেল। ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা নিরন্তর
আমি যেখানে থাকি সেখানে খাঁচায় পোষা কিছু পাখি ছাড়া অন্যান্য স্বাধীন পাখি বলতে চড়ুই, শালিক, দোয়েল আর মাঝে মাঝে টুনটুনির দেখা পাই। বাইরে গেলে ভিন্ন কিছু পাখির দেখা মেলে, তাও ক্ষণিকের দেখা।
আপনার পোস্ট গুলোর কারণে নিজ দেশের এবং পরিযায়ী সহ বিদেশি পাখি গুলো সম্পর্কে শুধু বিস্তারিত জানতে পারছি না, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতেও পারছি। এই জানাশোনা, পরিচিতির ব্যাপ্তি বাড়িয়ে রাখার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ ভাইজান।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত পাখি থাকতো!
মুনিয়া পাখির কোনো প্রজাতি প্রাকৃতিক অবস্থায় দেখিনি কখনো, যা দেখেছি সবই খাচায়।
তিলামুনিয়া দেখতে খুবই সুন্দর।
জানলাম এই পাখিটি সম্পর্কে।
এমন পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
শুভ কামনা।
২৫টি মন্তব্য
কামাল উদ্দিন
আমার বাড়ির সামনের তালগাছে এই তিলা মুনিয়াদের বসবাস। অবসরে দূরে থেকেও আমি ওদের সাথে নিরবে কথা বলে চলি।
মুনিয়াদের নিয়া আমার পোষ্ট
শামীম চৌধুরী
বাহ। দারুনতো কামাল ভাই। আপনিও তবে পাখিদের ভাষা বুঝেন।
কামাল উদ্দিন
ওদের ছুটোছুটি বা কর্মব্যস্ততা দেখতে আমার খুবই ভালোলাগে, ভাষা বোঝতে হলে আরো অনেক দূর এগোতে হবে ভাই, শুভ রাত্রি।
শামীম চৌধুরী
তারপরও আপনার পাখিপ্রেম দেখে আমি উৎফুল্ল ভাই। এমন নেশা থাকুক আজীবন।
তৌহিদ
মুনিয়ার প্রজনন ক্ষেত্র ধীরে ধীরে আমাদের নিজেদের জন্যই বিলুপ্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় এই পাখি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রত্যেকের সচেতনতা জরুরি। আমার মনে হয় বন বিভাগ এই বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নিতে পারে।
লাল মুনিয়ার মতো তিলা মুনিয়াও দেখতে খুবই সুন্দর। চমৎকার পোস্ট ভাই।
শামীম চৌধুরী
যদিও এখনো এই তিলা মুনিয়া হুমকির মুখে নয়। তারপরও মানুষ যদি মুনিয়া প্রজাতি পাখির খাঁচায় পোষা বন্ধ না করে তাহলে একদিন এরা চিরতরে হারিয়ে যাবে আমাদের দেশ থেকে। মানুষ নিজ থেকে যদি সচেতন না হয় তবে তাকে ঘাড় ধরে সচেতন করা যায় না।
শুভ কামনা রইলো ভাইজান।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
পুরোপুরি একমত আপনার সাথে। এমন করেই তো অন্যান্য পাখি ও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অসচেতনতার কারণে। চমৎকার বর্ণনা আর চমৎকার ছবিতে আবার ও মন জুড়িয়ে গেল। ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা নিরন্তর
শামীম চৌধুরী
ধন্যাবাদ দিদিভাই
শুভ কামনা রইলো।
সুপায়ন বড়ুয়া
নানুষ শখের বসে
এই সুন্দর তিলা মুনিয়া পাখি
খাঁচায় বন্দী করে জীবন বিপন্ন করে তোলে।
ভাল লাগলো ভাইজান। শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
কথায় আছে না,
তোমাদের খেলা আমাদের মৃত্যু।
ভাল থাকবেন দাদা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আগেরটা ছিলো লালমুনিয়া।
এখনকার টা তিলা মুনিয়া।
খুবি সুন্দর বর্ণনা।
এমন পাখি আজকাল দেখা যায়না দু এক জায়গা ব্যতীত।
বিলুপ্তির পথে প্রায়।
ভালো লাগলো জেনে, দাদা।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ দাদাভাই।
শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
কতো পাখি! কতো অজানা!
আমি আকাশে পাতিয়া কান! পাখি ভাই শোনাবে পাখির সাতকাহন।
শুভকামনা।
শামীম চৌধুরী
কান পেতে আছে বোন
চলছে আমার সাতকাহন।
শুভ কামনা আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
আমি যেখানে থাকি সেখানে খাঁচায় পোষা কিছু পাখি ছাড়া অন্যান্য স্বাধীন পাখি বলতে চড়ুই, শালিক, দোয়েল আর মাঝে মাঝে টুনটুনির দেখা পাই। বাইরে গেলে ভিন্ন কিছু পাখির দেখা মেলে, তাও ক্ষণিকের দেখা।
আপনার পোস্ট গুলোর কারণে নিজ দেশের এবং পরিযায়ী সহ বিদেশি পাখি গুলো সম্পর্কে শুধু বিস্তারিত জানতে পারছি না, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতেও পারছি। এই জানাশোনা, পরিচিতির ব্যাপ্তি বাড়িয়ে রাখার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ ভাইজান।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
৩৭৬ প্রজাতি আমাদের দেশীয় পাখি। আশা করি সবগুলি পাখির পরিচিতি তুলে ধরবো। আপনিও ভাল থাকবেন সাবিনা আপু। দোয়া রইলো। দোয়া চাই।
ছাইরাছ হেলাল
খাঁচায় এ পাখি দেখেছি অনেক, প্রকৃতির আবদ্ধ সৌন্দর্য হিসাবে।
আপনার কাছেই এমন সুন্দর জানলাম, যেমন জানতে পারি সব সময়।
শামীম চৌধুরী
জানানোর সুযোগ করে দেবার জন্য কৃতার্থ ভাইজান।
শুভ কামনা রইলো।
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর শামীম দা
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ কবি দা।
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
অতুলনীয় প্রকাশ
শুভকামনা রইল কবি
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ কবি দা।
জিসান শা ইকরাম
শেরে-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত পাখি থাকতো!
মুনিয়া পাখির কোনো প্রজাতি প্রাকৃতিক অবস্থায় দেখিনি কখনো, যা দেখেছি সবই খাচায়।
তিলামুনিয়া দেখতে খুবই সুন্দর।
জানলাম এই পাখিটি সম্পর্কে।
এমন পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
পাখি বিক্রিতেও রং! কি অবস্থা আমাদের।
শুভ কামনা রইলো। শুভ সকাল।