গ্রামের মেয়ে আমি । গ্রামের আলো, বাতাস, গাছের ডালের ছায়া, পাখির ডাক, পুকুরের পানি, মাটির গন্ধ, বিলের শাপলা-শালুক, মেঠো পথ সব আমায় টানে। অনেক বছর পর এবার ছুটির প্রায় সময়টা গ্রামে কাটিয়েছি। গ্রামের নিটোল সৌন্দর্য্য খুবই নিবিড়ভাবে উপভোগ করার জন্য এই কয়েকটা দিন ইন্টারনেট কানেকশন হতে দূরে ছিলাম। সেই গ্রাম আছে কিন্তু সেই মানুষগুলো শুধু বদলে গিয়েছে। তাদের মনে ভর করেছে আধা শহুরে মানসিকতা, ঘরে ঘরে টিভিতে ভেসে উঠছে দেশীয় ও বিদেশী চ্যানেলের ছবি। আগের দিনে ছেলেরা বাহারী রঙের লুঙ্গি পড়ে মেঠো পথে ঘুরে বেড়াত- আর এখন দেখলাম প্রায় ছেলেরা হাফ প্যান্ট,জিনস পরে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের চোখে মুখে সেই আয়েসী ভাবটা নেই বরং ভর করছে ব্যস্ততা। কারো কারো মোবাইলের ফেবু’র পাতায় মগ্ন অবস্থায় দেখলাম। আগে গাছ হতে শাক সবজি তুলেই রান্না করা হতো, কি স্বাদ ছিল সেই রান্না করা তরকারীতে- আর এখন বেশির ভাগ বাজার হতে কিনে আনে। আগে বাড়িতে কোন অতিথি এলে গাছ হতে ডাব পেড়ে ডাবের পানি, মুড়ি, গুড়, চিরা, খই, গুড়ের পায়েস নাস্তা হিসেবে খেতে দেয়া হতো কিন্তু এখন বতলের পানি, চানাচুর, বিস্কুট, নডুলস আরো কত কি দেয়া হয়– তবে আন্তরিকতার রকমফেরেও পরিবর্তন লক্ষণীয় –। আগের দিনগুলোতে গ্রামের সবাই আমাদের পুকুরে এসে গোছল করতো। কলকাকলীতে মুখর থাকতো চারটি পুকুর ঘাট। বউঝিরা পুকুর ঘাটে বসে একে অপরের সাথে কত সুখ দুঃখের কথা কইতো। এখন পুকুরটি প্রায় সময় ফাঁকা পড়ে থাকে- পুকুরকে শূন্যতায় গ্রাস করেছে- এখন প্রায় বাড়িতে পানির কল চাপ দিলেই ঝরঝরিয়ে পানি পড়ে, পুকুর ঘাটে গোছল করার আর দরকার পরে না। দুপুর গড়ালেই আমাদের দুটি টিউব ওয়েলে লাইন পড়ে যেত-বউ/ঝিয়েরা পানি কালেকশণ করে নিয়ে যেত- কত কথার মেলা বসতো এখানে, এখন প্রায় সময়ই টিউব ওয়েল ফাঁকা পরে থাকে কারণ প্রায় সবার বাড়িতে এখন টিউবওয়েল। বিলে কত শাপলা শালুক কিন্তু খুব কম মানুষকেই শাপলা আর শালুক কুড়াতে দেখলাম। খালে বিলে এই সময় মাছ মারার হিরিক লেগে যেত, আর এখন খুব অল্প মানুষই খালে বিলে মাছ ধরছে-তারা এখন ব্যাগ নিয়ে বাজার হতে মাছ কিনে ফ্রিজে রেখে দেয়।পেশা পরিবর্তনের হিরিক গ্রামেও ছুঁয়ে গিয়েছে, ধোপা জেলে আর নাপিত/নরসুন্দরদের দেখলাম আগের পেশা পরিবর্তণ করে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। কোন কোন নাপিত তাদের সনাতন পদ্ধতি পরিবর্তন করে শহুরে স্টাইলে দোকান দিয়েছে। গ্রামের ঝোপজঙ্গল সব উজাড়, বাঁশ ঝাড়গুলোও জীর্ণ শীর্ণ। তারপরও গ্রামের মানুষদের মাঝে আতিথিয়তার কমতি নেই। চাঁদনী রাতের সময়গুলো ছিল খুবই উপভোগ্য ছিল।
চাঁদনী রাত: সন্ধার আকাশে এক ফালি চাঁদ বাঁশ ঝাড়ের ওপারে আলতো করে ভেসে উঠে। চাঁদের আনন্দে ঝিঝি পোকা গান শুরু করে দেয়। বাঁশ ঝাড় দুলতে থাকে-হরেক রকমের পাখিগুলো তাদের বাসায় বসে কত কথায় মসগুল হতে থাকে। আর আমরা মাটির উঠাণে মাদুর পেতে বসে ঝাল মুড়ি, মুড়ির মোয়া, লাড়ু, খই, পিঠা, খেজুরের গুরের পায়েস খাওয়ার উৎসবে মেতে উঠি। গল্পের আসরে আড্ডা জমাতে চাঁদ নারিকেল গাছের মাথায় এসে বসে-। আমরা গল্পে গল্পে সেই শৈশবে হারিয়ে যাই-। কত জমানো কথা, কার আগে কে বলবে। বড়সি দিয়ে মাছ ধরা, নৌকা বাওয়া, দুপুরে ঝাপ দিয়ে পুকুরের শান্ত পানিকে অশান্ত করা, ডুব সাঁতার, চড়ুই ভাতি, ঈদ আর পূজার কত কাহিনী এসে ভীড় করে মনের পর্দায়। কথায় কথায় রাত বাড়ে। চাঁদ আড্ডায় খুশি হয়ে তার আলো আরো বাড়িয়ে দেয়। বিলের রকমারি মাছের ঝোল, ভর্তা, মাছ ভাজা, ডাল আর শাক-সবজি দিয়ে রাতের খাবারে অমৃতের স্বাদ পেতাম–। ঘুম পাড়ানীর যাদুর কাঠির ছোয়ায় সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। আমি জানালা দিয়ে দেখতাম জোৎস্মা ঝরে ঝরে পড়ছে মাটিতে, গাছের ডালে, শস্যের ক্ষেতে। চাঁদ উকি মেরে আমায় দেখতো- এক মুঠি জোৎস্মা আমার তরে পাঠিয়ে দিত- আমি আর চাঁদ জেগে আছি, মাঝে মাঝে হুতোম পাখির ডাক, বাঁশ ঝারে পাখির ডানা ঝাপটানি। দূরের বিলে শাপলা হাসছে-শাপলাও জেগে আছে!! ভোরের আগেই ক্লান্ত চাঁদ তার তলপী তলপা গোছাতে শুরু করে- জোৎস্মাগুলোকে পরম যত্মে গুছিয়ে নিয়ে দূরের দেশে যাত্রা করে। মোরগের ডাকে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। ঘুম পাড়ানীরা গ্রামের সহজ সরল মানুষের চোখ হতে ঘুম কেড়ে নেয়—বাঁশ ঝাড়ে মেতে উঠে পাখির কলতান।
৩২টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
গ্রাম বন্দনা ভালই লাগলো
এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন শীল।
মানুষের মন পালটিয়ে গেছে।
সময়ের সাথে সাথে। আগের মত ভাইয়ে ভাইয়ে মিল নাই, মানুসে মানুসে দন্দই বেশি।
সব মিলিয়ে ভাল লাগলো দিদি।
স্বপ্ন নীলা
এবার গ্রামে যেয়ে ভীষণ খারাপ লেগেছে — কেমন যেন মেকি মেকি অনেক কিছুই — শহরকে অনুকরণ করতে যেয়ে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে —
আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাকেও ধন্যবাদ।
স্বপ্ন নীলা
শুভকামনা
স্বপ্ন
এখন আর সেই গ্রাম নেই আপু। গ্রাম গুলো এখন ছোট ছোয় শহর হয়ে গিয়েছে। ভালো লেগেছে লেখা।
স্বপ্ন নীলা
ঠিক বলেছেন– গ্রামে এখন শহুরে বাতাস বইছে —সেই মনভোলানো পরিবেশ আর নেই —
শুভকামনা রইল
স্বপ্ন
@ছোট
স্বপ্ন নীলা
মরুভূমির জলদস্যু
নাই নাই সেই আগের দিন আর কোথাও নাই।
স্বপ্ন নীলা
এখন আর আগের দিন নেই — সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে — মনে পড়ে সেই আগের স্মৃতিগুলো———–
শুভকামনা রইল
রিমি রুম্মান
গ্রাম সুন্দর ছিল, যখন সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না। আমেরিকাতে “আমিষ কাউনট্রি” নামের একটা জায়গা আছে, যেখানে গ্রামের ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে। পর্যটকরা সে এলাকা দেখতে যায়। আমিও গিয়েছিলাম। ক্ষেতে গরু… রাখাল… সন্ধ্যায় বাড়িঘরে মোমবাতি কিংবা হারিকেন… টঙ্গের দোকান …। সবমিলে অন্যরকম এক অনুভূতি নিয়ে ফিরেছি সেদিন।
স্বপ্ন নীলা
ওহ্ আপনার বর্ণনায় আমেরিকার গ্রামকে দেখতে পেলাম———অসাধারণ আপু——
শুভকামনা রইল
সীমান্ত উন্মাদ
হেই দিন কি আর আছে আফা দিন বদলাইছে না । তবু গ্রামে এখনো চাঁদ দেখতে পাওয়া যায় তার আপন রুপে। কিছুটা মেঠো পথ এখন আছে বাঁকি তাই না হয় সান্তনা হয়ে থাক শহুরে হৃদয়ে। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা নিরন্তর।
স্বপ্ন নীলা
এখনো চাঁদ দেখতে পাওয়া যায় গ্রামে– দেখা যায় অবারিত আকাশ — বদলের হাওয়া লেগেছে গ্রামে – এটা যুগেরই দাবী —
শুভকামনা রইল
কৃষ্ণমানব
সময় পরিবর্তন হয়েছে ।
বাস্তবিক ক্রম ধারায় বদলে গেছে মানুষের বিশ্বাস ।।।
কিন্তু দেখেন , ঐ যে রাতের কালো আকাশটা ,
তার বুকে অবলিলায় ঘুমিয়ে আছে নিস্তব্ধ চাদঁটা ।।
সেটি কি আদৌ পরবর্তিত হয়েছে ?
পরিবর্তনের ক্রমধারায় ভালোবাসার ও পরিবর্তন হয়েছে ।
সে যাই হোক , আগের দিনগুলিই আসলে সেরা সময় ছিলো ।।
ফিরে পাওয়া যাবেনা , জোৎসনা রাতে মায়েল কোলে শুয়ে , জ্বীন পরীর গল্প ।।
সাংসারিক ব্যাস্ততায় কে কখন কোথায় হারিয়ে যায় ।
এসব যত ভাবি বুকটা খুব ফাকা লাগে ।
মনে হয় , কি থেকে ও কি নেই .,
দৃষ্টি সীমার অন্তরালে কোথাও কেউ নেই ! 🙁
স্বপ্ন নীলা
আপনার মন্তব্য যতই পড়ছিলাম মনোযোগ দিয়ে -ততই অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম — দারুন লিখতে পারেন আপনি —
হ্যা গ্রামেও পরিবর্তন এসেছে- এটা সময়েরই দাবী —তারপরও এখনো যা বাকী আছে সেটাই বা কম কিসে —
শুভকামনা রইল
নুসরাত মৌরিন
গ্রামগুলো অনেক বদলে গেছে,এখন আর আগের মত গ্রাম ভাল লাগে না।আগে একসময় সন্ধ্যা নামলেই ঝি-ঝি পোকা,আর জোনাকিদের মেলা দেখতাম গ্রামে গেলে।বাড়ির দাওয়াইয় বসলে মনে হতো যেন আকাশটা তারার ভারে দু-হাত নিচে নেমে এসেছে…।
কিন্তু এখন গ্রামের ও যেন শহর হওয়ার ইচ্ছা কিছুই আর আগের মত নেই।ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট,রাস্তায় ধোঁয়া উড়িয়ে চলে মোটর গাড়ি…।এটাই হয়ত হওয়ার কথা ছিল কিছুই তো আর পিছিয়ে থাকবে না,গ্রামেও তাই নগরের প্রবেশ।
স্বপ্ন নীলা
ঠিক তাই আপু– গ্রামও পিছিয়ে নেই, সব কিছুই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় — নগর ধীরে ধীরে গ্রামে প্রবেশ করছে— কষ্ট লাগে যখন দেখি গ্রামের সুন্দর ও নিজস্ব সংস্কৃতিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে — তারপরও গ্রামে গেলে এখনো ভালো লাগে —
ভাল থাকবেন সব সময়
ছাইরাছ হেলাল
বেশ নস্টালজিক হয়ে আছেন দেখছি, হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের আধুনিকতা কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই।
শত ইচ্ছে হলেও আমারা ফিরে যেতে পারিনা ফেলে আসা আমাদের ছোট্ট সোনার গাঁয়ে।
স্বপ্ন নীলা
হেলাল ভাই— হুম সেই গ্রাম মনে মনে খোজ করছিলাম যে গ্রামে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম– কিন্তু এখন সেই গ্রাম আছে কিন্তু সেই প্রাণ আর নেই— আধুনিকতা গ্রাস করেছে গোটা গ্রামকে— বার বার মন ফিরে যায় সেই হারানো সব দিনগুলোতে —
ভাল থাকেন সব সময়
জিসান শা ইকরাম
নিজে লিখলেন
আর আমাকেও নিয়ে গেলেন আমার গ্রামের সেই সব দিনগুলোতে
সোনালী সেই শৈশব, স্মৃতি কাতরতা–
সব এখন স্বপ্নের মত মনে হয়।
নেই এখন আর কিছুই, পাল্টে গিয়েছে সব।
খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
শুভ কামনা।
স্বপ্ন নীলা
জিসান ভাই — সব কেমন পাল্টে গেল — মানুষগুলোর মনও যে এত দ্রুত পাল্টে যাবে তা আমি ভাবতেও পারি নাই — মনে বাস করছে এখন আধা শহুর আর আধা গ্রাম —গ্রামের কালচারগুলোতেও শহুরে ছোঁয়া লেগেছে —
আন্তরিক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা রইল
ব্লগার সজীব
ভালো লিখেছেন আপু। আর এক প্রজন্ম পরে এমন আর কেউ লেখার প্লটই পাবেনা।
স্বপ্ন নীলা
গ্রামের কত কিছুই যে মনে পড়ে ভাই — বার বার পিছন ফিরতে ইচ্ছে করে, কত মধুর সেইসব দিনগুলো —মনে হয় সব থাক, সব সময়ের জন্য থাক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেখুক জানুক শিখুক —
ভাল থেক ভাইয়া
আন্তরিক শুভকামনা রইল
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সময়ের বিবর্তন।ভাল লাগল মনে পড়ে গেল সেই আম কুড়ানোর দৃশ্য আর মনে পড়ে যায় আমার কৈশরের দূরন্তপনা যা ইটের দেয়ালে এখন তার বসবাস।
স্বপ্ন নীলা
গ্রামে যেতে ইচ্ছে করে বার বার — শেকড়ের টানেই ছুটে যাই গ্রামে —-আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে ভীষণ
আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল
মেহেরী তাজ
কল্পনায় দেখে এলাম সব আপনার সাথে। ভালো লিখেছেন আপু।
স্বপ্ন নীলা
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু ——— ভাল থাকবেন সব সময়
বনলতা সেন
অনেকদিন পরে এসেও আপনার লেখা পড়ে কোথায় যেন ফিরে গেলাম ।
হারিয়েও গেলাম ক্ষাণিকের জন্য ।
স্বপ্ন নীলা
আন্তরিক ধন্যবাদ আপু —- ভাল থাকবেন সব সময়
সোনিয়া হক
মনির ভাইয়ার পোষ্টে আপনার ব্লগের লিংক ধরে এখানে এলাম। খুবই সমৃদ্ধ এক ব্লগ। কত ভালো ভালো লেখক এখন সোনেলায়। এমন গ্রাম আর নেই আপু, আছে শুধু আমাদের স্বপ্নে। -{@ (y)
স্বপ্ন নীলা
খুবই ভাল লাগলো আপু —। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ আমার ব্লগ পাড়ায় আসার জন্য
আসলেও সেই গ্রাম আর নাই —
শুভকামনা রইল