অস্ট্রেলিয়ায় আজ আমার প্রবাস জীবনের ৯ বছর পূর্ণ হলো। বেশ অভিমান নিয়েই দেশ ছেড়েছিলাম।
সময়ের সাথে সাথে অভিমান গুলো হারিয়ে আবার মায়া সে জায়গা দখল করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে আর ২৩ দিন পর আবার দেশে ফিরবো। অনেক তো হলো। ক্যানবেরার রাস্তায় সকাল সন্ধ্যা ট্যাক্সিক্যাব চালিয়ে এই ক বছরে বেশ ভালোই টাকা জমিয়েছি। দেশে ফিরে আজীবন পায়ে পা তুলে কাটাতে পারবো।
মনের মধ্যে এসব এলোমেলো চিন্তা নিয়ে হুট করে এক যাত্রীর আহবানে ব্রেক কষতে হলো। গ্লাস নামিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো।
এ তো বর্ণা!!!
সেই ট্রেডমার্ক তিল আর জোড় ভ্রুতে ওকে চিনতে আমি ভুল করিনি। তবে চেহারায় সেই চিরচেনা হাসিটি মিসিং। দুটো বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে ও গাড়িতে উঠে বসলো।
ও কি আমাকে চিনতে পেরেছে?
মনে হয় না।
আমি ওর গন্তব্যস্থানের দিকে গাড়ি ছোটাতে লাগলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে স্মৃতিগুলো আমার মস্তিষ্কে ইঁদুর বেড়াল খেলা শুরু করে দিয়েছিলো। চলে গেলাম ১৬ বছর আগের সেই স্কুল জীবনে।
স্কুলের সেরা সুন্দরী বর্ণা ছিলো সিনিয়র জুনিয়র প্রায় সবারই প্রিয় মুখ। অনেকের অনেক রকম ফ্যান্টাসিও ছিল ওকে নিয়ে। কিন্তু ভিন্ন ধর্মের হওয়ার কারণে আমরা মুসলিমরা কিছুটা হতাশ ছিলাম। তবে আমি হাল ছাড়লাম না। সুন্দরী বর্ণাকে আমার প্রেমে পড়তেই হলো। যদিও এর জন্য নিজের শরীরে সামান্য কাটাকুটি করতে হয়েছিলো। যেটা দেখিয়ে ওকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করেছিলাম। হাতে সেই B লেখা আজও স্পষ্ট। বছর দুয়েক চুটিয়ে প্রেম করেছিলাম। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই মেয়েটি আমাকে যথেষ্ট ভালোবেসেছিলো। আর আমার কারণে অনেক অত্যাচারও সহ্য করেছিলো।
নিজের একমাত্র কন্যা এক মুসলিম ছেলের সাথে প্রেম করছে শুনে ওর ব্রাহ্মণ বাবা বেশ আঘাত পেয়েছিলেন। এরপর প্লান করলেন, ওকে বারাসাত ওর মাসীর কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এটা টের পেয়ে বর্ণা আমাকে বলেছিলো ওকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। এমনকি নির্দিষ্ট দিনে ও ব্যাগ গুছিয়ে আমার জন্য অপেক্ষাও করেছিলো। কিন্তু আমার ভালবাসা ভয়ের কাছে হেরে গিয়েছিলো। শুনেছিলাম ও আমার জন্য সেখানে প্রায় ২ ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলো। এরপর ফিরে গিয়েছিলো।
কয়েকদিন পরে ভারতীয় এক যুবকের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে শুনেছিলাম। এর বছরখানেক পর ও স্বামী সহ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে সেটাও জানতাম। কিন্তু ওর সাথে এভাবে দেখা হবে সেটা ভাবিনি কখনো।
“এখানে থামুন ” বলে ও আমাকে থামতে বললো।
গাড়ি থেকে নেমে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ও বাচ্চাদুটো নিয়ে বাসার ভেতরে গেল, আর দু মিনিটের মধ্যে ফিরেও এলো। এসে আমাকে অবাক করে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো তনয়?”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে”
ও বললো, “যার জন্য আমার জীবনটা আজ এমন হয়েছে তাকে ভুলি কি করে?”
এই বলে ও অনেকটা জোড় করেই আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে গেলো। রুমে ঢুকেই এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের ছবি দেখিয়ে বললো, ” ও সৌমিত্র, আমার হাসবেন্ড। যদিও তিন বছর আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর যে মেয়ে দুটো দেখলে, ওরা হলো সৃষ্টি আর মিষ্টি, আমার জমজ মেয়ে। ওদের আকঁড়েই বেঁচে আছি এখন”
স্পষ্ট দেখলাম ওর চোখে পানি চিকচিক করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে ও বললো, ” তুমি বসো আমি চা বানিয়ে আনছি”
একটু পরেই ও চা নিয়ে ফিরে এলো। আমি মাথা নিচু করে চা এ চুমুক দিচ্ছি এরমধ্যে ও জিজ্ঞেস করলো, “চিনি ঠিক আছে? তুমিতো আবার চিনি বেশী খাও” এই বলেই সেই ট্রেডমার্ক হাসি।
আমি মুগ্ধতা লুকাতে পারলাম না। এর পর ও বললো, “আজ যে নাচের স্কুলের সামনে থেকে আমাদের পিক করলে ওখানেই আমি নাচ শেখাই। তুমি কি রোজ আমাদের ওখান থেকে পিক করতে পারবে?”
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম।
পরের দিন আমি আবার সে স্কুলের সামনে অপেক্ষা করলাম আর বর্ণাকে পিক করে বাসায় দিয়ে এলাম। এভাবে ধীরে ধীরে সব জড়তা কেটে গেলো। ওর সঙ্গটা আমি আগের মতই উপভোগ করছিলাম । হয়তো বর্ণাও করছিলো। কারণ ওর হাসিটা এখন নিয়মিত ছিলো।
এভাবেই প্রায় ২২ দিন যে কীভাবে কেটে গেল, টেরই পেলাম না! কিন্তু আমি ওকে আমার দেশে যাওয়ার কথা চেপে গেলাম। কী হবে বলে? ফালতু ভালবাসা পিছুটান ছাড়া আর কি ই বা দেয়?
আজ বর্ণা আমাকে সময় নিয়ে আসতে বলছে। আজ নাকি সারাদিন ও আমার ক্যাবে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু আজ যে ১৮ সেপ্টেম্বর। সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট। আমি ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত হয়ে ফ্লাইট ধরার জন্য এয়ারপোর্ট এর পথে।
হয়তো মেয়েটি আজও সেই ১৬ বছর আগের দিনটার মত অপেক্ষা করবে। আর ভাঙা মন নিয়ে ফিরে যাবে।
নাহ আর না। আমি জীবনকে আর আমাকে নিয়ে খেলতে দেবোনা। আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার বাসায় ফিরলাম। ব্যাগগুলো ফেলে রেখে আবারো ক্যাব নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। ওইতো বর্ণা! আজ একটা ভায়োলেট রঙের শাড়িতে ওকে দারুন লাগছে! আমি আজ আর হাত কেটে B লিখিনি। আজ সরাসরিই বলবো, “ভালোবাসি”
দেখা যাক ভাগ্য আমাদের শেষ পর্যন্ত মেলায় কিনা।
#নোট_: প্রিয় কিছু মানুষের প্রতি অনুভূতিগুলো কখনোই বদলে যায়না। সময় বদলে গেলেও অনুভূতিগুলো হৃদয়ের কোনো না কোনো কোণে ঠিকই লুকিয়ে থাকে। আর জীবন যখন আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়, তখন সেগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখন সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হয় যে, আপনি সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবেন, নাকি মেরে ফেলবেন।
১৮টি মন্তব্য
নুর হোসেন
আমরা মিরাকেলের আশায় থাকি আর মিরাকেল আমাদের দিয়েই মিরাকেল ঘটায়!
অসম্ভব সাজিয়ে গুছিয়ে লিখেছেন,
জীবন ফুলের মতই সুন্দর অযত্নে ঝরে যাওয়ার আগেই নিজেদের চিন্তাকে পাত্তা দেওয়া উচিত;
ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভাল থাকুক আপনাদের ভালবাসা।
তারিক
ধন্যবাদ ভাই
জিসান শা ইকরাম
সোনেলার উঠোনে আপনাকে স্বাগতম।
নিয়মিত লেখুন এবং অন্যের লেখা পড়ুন।
আপনার লেখা সম্পর্কে মন্তব্য আগামীকাল করবো,
শুভ কামনা।
তারিক
ধন্যবাদ
সাবিনা ইয়াসমিন
বিরতি না রেখেই গল্পটি পড়লাম। বেশ গোছানো আর সুবিন্যস্ত লেগেছে। অভিমানটা আসলেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, যদি মনের কোনে কিঞ্চিৎ পরিমান মায়া অবশিষ্ট থাকে। আর জীবন যখন দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়, তখন নিয়তির ইংগিত বুঝেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সব মিলিয়ে আপনার প্রথম পোস্ট খুবই ভালো লাগলো।
সোনেলা ব্লগ পরিবারে আপনাকে স্বাগতম। আজ থেকে আপনিও আমাদের একজন হলেন। ইচ্ছেমত লিখুন, বাকিদের সাথে নিজের মতামত বিনিময় করুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
তারিক
ধন্যবাদ
সুরাইয়া পারভিন
চমৎকার লিখেছেন। কিন্তু এতে তো পাঠক হৃদয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা মিটছে না। তারপর কি হলো জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তো। তনয় কি বলতে পেরেছিলো বর্ণাকে ভালোবাসার কথা
তারিক
বলবো অন্য একদিন
ছাইরাছ হেলাল
স্বাগত আপনি এখানে।
গোছানো লেখাটি পড়তে বেশ ভালই লাগল।
লিখুন নিয়মিত নিজের মত করেই।
তারিক
ধন্যবাদ
তৌহিদ
সোনেলায় স্বাগতম। আপনার লেখাটি একনাগাড়ে পড়ে গেলাম। বেশ গুছিয়ে লিখেন আপনি। লিখুন নিজের মত করে।
বিজয়ের মাসে সোনালী শুভেচ্ছা।
তারিক
ধন্যবাদ
অনন্য অর্ণব
কিছু বলবো ভাবছি কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। চমৎকার প্রেম বিরহের গল্প।
তারিক
ধন্যবাদ ভাই
সুপর্ণা ফাল্গুনী
চমৎকার লেখনী
জিসান শা ইকরাম
বর্নার কাছে ফিরে গিয়ে তনয় সঠিক কাজটিই করেছে।
আপনি বেশ ভালো গল্প লেখেন।
ভালো লেগেছে আপনার প্রথম পোস্ট। নিয়মিত লেখুন।
শুভ কামনা।
তারিক
ধন্যবাদ
এস.জেড বাবু
গল্পটা দারুন লেগেছে।
অসাধারণ বলেছেন শেষে-
////////আর জীবন যখন আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়, তখন সেগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখন সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হয় যে, আপনি সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবেন, নাকি মেরে ফেলবেন।
স্বাগত সোনেলায়।