দেশীয় আবহে এদেশীয় উৎসব

রিমি রুম্মান ২১ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ০৪:০৪:০৫পূর্বাহ্ন বিবিধ ৬ মন্তব্য

নভেম্বরের এক রোদেলা বিকেল। পরনে হেভি জ্যাকেট, কান টুপি, হাত মোজা। কনকনে শীতে জবুথবু হয়ে কাজ থেকে ফিরছি। হাঁটছি ডাউনটাউন ম্যানহাঁটনে সাবওয়ে স্টেশনের দিকে, যেপথে বাড়ি ফিরবার ট্রেন এসে থামে, সেইদিকে। আচ্‌মকা তুলার মত কিছু উড়ছিল বাতাসে। আমি ডানে তাকাই, বাঁয়ে তাকাই, উপরে তাকাই। কোথা থেকে এইসব উড়ে আসছে ? কোন বাড়ির ছাদ থেকে কে ফেলছে এইসব সাদা তুলা ! ধীরে ধীরে শহর জুড়ে সাদা চাদরে ঢেকে গেলো যেন ! সে-ই জীবনে প্রথম তুষার দেখা আমার। ব্যস্ত কোলাহল মুখর শহরটি অন্যদিনের তুলনায় কী ভীষণ নীরব নিথর ছিল সেদিন। এই শহরে সেদিনই আমার প্রথম ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’। সরকারি ছুটির দিন হলেও আমার কাজ ছিল। কেননা দিনটি পালনে আমার কোন তাড়া ছিল না। ছিল না দিনটি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান। চায়নিজ সহকর্মী মিস্টার লু এর কাছ থেকে জানলাম, ঘরে ঘরে পরিবার এবং বন্ধুদের মিলনমেলা, পার্টি চলছে বিধায় ঘরের বাইরে এই সুনসান নীরবতা। পরের বছর থ্যাংকস গিভিং ডে আসার আগেই আমি জেনে যাই দিনটি কী এবং কেন পালন করা হয়।

প্রায় দুইশত বছর আগে একদল মানুষ ইংল্যান্ড ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে জাহাজে চড়ে বের হয়েছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের এইসব মানুষদের উদ্দেশ্য ছিল কোথাও গিয়ে স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করা। কয়েকমাসের দীর্ঘ ভ্রমণে তাঁদের বেশীরভাগই প্রচণ্ড ঠাণ্ডাজনিত কারনে এবং খাদ্যাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘ মে ফ্লাওয়ার ‘ নামের তাঁদের বহনকারী জাহাজটি ম্যাসাচুসেটস বে তে এসে নোঙ্গর করলে তাঁরা সেখানে একটি গ্রাম গড়ে তোলেন। সেখানে স্থানীয় এক উপজাতি আমেরিকান ইন্ডিয়ানের মাধ্যমে তাঁরা ফসল ফলানোর কৌশল জেনে নেয়। স্থানীয় এবং অস্থানীয় সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বেশ সফলতার সাথে পরের বছর ফসল ঘরে তোলেন। সেইসময়ে সেখানকার গভর্নর আদিবাসীদের সম্মানে তিনদিন ব্যাপী আনুষ্ঠানিক এক ভোজের আয়োজন করেন। তাঁরা একে অপরকে সহযোগিতার জন্যে কৃতজ্ঞতা জানান, প্রার্থনা করেন, এবং সেই সাথে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান। এবং এটিই পরবর্তীতে ‘ থ্যাংকস গিভিং ডে ‘ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একের প্রতি অন্যের সংহতি প্রকাশের এই দিনটি নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পালন করা হয়। এইদিন সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত বন্ধ থাকে। পরিবারের সদস্যরা একত্রে সময় কাটায়। ঘরে ঘরে টার্কি নানান রকম সস মাখিয়ে ওভেনে পোড়ানো হয়। সাথে ব্রেড, ক্যানবেরি সস, বেবি কেরট, ম্যাশ পটেটো, পামকিন পাই, কর্ণ সহ ডিনারে পরিবেশন করা হয়।

এ উপলক্ষে স্কুলগুলোয় টানা চারদিনের হলিডে থাকে, তাই সকলেই দিনটি যার যার মতো করে উদযাপন করেন। এটি আমেরিকার বড় উৎসব গুলোর মধ্যে অন্যতম। শপিং মলগুলো সহ সর্বত্র আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ের অফার থাকে। দেশে আমাদের ঈদের সময়কার মতোই জমজমাট থাকে এদেশের দোকানপাটগুলো। সকলেই প্রিয়জন, স্বজন এবং বন্ধুদের জন্যে উপহার কিনেন দিনটিকে উপলক্ষ করে। সর্বত্র উৎসব উৎসব আমেজ থাকে। দিনটি যদিও বন্ধুত্ব, সংহতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিশেষদিনকে স্মরণ করে, কিন্তু আমার কাছে এটি অনেকটা নতুন ফসল ঘরে তোলার সময়ের নবান্ন উৎসবের মত মনে হয়। এই বিশেষ দিনে নানান সাজে অসাধারন সব মিউজিকের তালে তালে ড্যান্স সহ বিশাল এক প্যারেড শহর প্রদক্ষিণ করে থাকে। শিশুদের নিয়ে অন্যসব ভিনদেশিদের সাথে রাস্তায় অপেক্ষা করি আনন্দদায়ক প্যারেড দেখার উদ্দেশ্যে। এই দিনে কখনোবা বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ থাকে। সপরিবারে সেখানে যাই। রাতভর খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, হাসি আনন্দ চলে। আবার কখনোবা নিজ বাড়িতে বন্ধু ও স্বজনদের নিয়ে পার্টির আয়োজন করি। যাকে বলে ভুঁড়িভোজ। টার্কি কিনে আগের দিন বাংলাদেশি চিকেন রোস্ট স্টাইলে মশলা মাখিয়ে মেরিনেট করে রেখে দেই। পরদিন ওভেনে এপিঠ, ওপিঠ ভাল করে পুড়িয়ে সস মাখিয়ে সাথে সালাদ সহ টেবিলে অন্য খাবারের সাথে পরিবেশন করি। পরিবেশনে একটু ভিন্নতা আনার জন্যে সাথে নদী থেকে বড়শি দিয়ে ধরে আনা আস্ত মাছও একই কায়দায় মশলা মাখিয়ে ওভেনে পুড়িয়ে চারপাশে রেড অনিয়ন, গ্রিন পেপারস, রেড পেপারস দিয়ে সাজিয়ে টেবিলে পরিবেশন করি। আমরা আমাদের দেশীয় অন্যান্য খাবার দাবারের পাশাপাশি টার্কি অবশ্যই পরিবেশন করি। বাংলাদেশি বিয়ে বাড়িতে বরের জন্যে যে স্পেশাল আস্ত মুরগির রোস্ট করা হয়, অনেকটা তেমন। পার্থক্য শুধু টার্কি আকারে কয়েকগুন বড় হয়। যেহেতু পরদিন শিশুদের স্কুল বন্ধ থাকে, তাই এই পার্টি চলে মধ্যরাত অবধি।

এই বিদেশ বিভূঁইয়ে জন্ম এবং বেড়ে উঠা আমাদের শিশুরা আমাদেরই দেশীয় আবহে অন্যসব উৎসবের মত করে দিনটিতে আনন্দে মেতে উঠে। প্রযুক্তির এই যুগে নাগরিক ব্যস্ততাকে পিছনে ঠেলে একটি বিশেষ দিবসকে উপলক্ষ করে দেশীয় পরিমণ্ডলে পরিবারের সান্নিধ্যে কাটানোই বা কম কিসে !

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

৪৮৭জন ৪৮৫জন

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ