নিউইয়র্কে আমার বাড়িতে একজন অতিথি আসেন মাঝে মধ্যে, যিনি দুই যুগেরও অধিক সময় কঠোর পরিশ্রম করেছেন এদেশে। বয়স এবং শারীরিক নানাবিধ অসুস্থতা নিয়ে অবশেষে বিদেশের পাট চুকিয়ে একেবারেই ফিরে গেছেন দেশে পরিবারের কাছে। ডাক্তার কিংবা কাগজপত্র সংক্রান্ত প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে আসেন। কাজ শেষে আবার ফিরেও যান। এই স্বল্পকালীন সময়ে তিনি আমার অতিথি হন। হাসপাতাল কিংবা সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে একাই ছুটোছুটি করেন। কিংবা সময় পেলে আমিও নিয়ে যাই। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন অনেক আগেই। এখন জীবনের পড়ন্ত বেলা।
জীবনের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি নিয়ে গল্প হচ্ছিলো। কথা বলছিলাম, ফেলে আসা জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ থাকলে কোন ভুলটি শুধরে নিতাম__ এসব নিয়ে। বললেন, বিয়েটাই ভুল ছিল, কিংবা ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক টেনে নিয়ে গেছেন গোটা একটা জীবন। কেননা, স্ত্রীকে এদেশে আনার ব্যপারে কোনভাবেই রাজী করাতে পারেননি তিনি। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুন্দর একটি জীবন হতে পারতো এদেশে তাঁর। হয়নি। বাধ্য হয়েই পরিবারের সান্নিধ্য পাবার জন্য বছরের ক’মাস দেশে, আর রুটি, রুজির তাগিদে বাকীটা সময় বিদেশে কাটাতে হয়েছে। এতে না পেরেছেন কাছে থেকে সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করতে, না পেরেছেন ভালো আয়-রোজগার করতে।
গল্পে গল্পে ন্যাশনাল এভিনিউয়ের রেড লাইটে এসে থামি আমরা। আমি ফিরে চাই পাশের সিটে বসা জীবন সংগ্রামে লড়াকু একজন মানুষের দিকে। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। বললেন অনেক কথা। উপরে উঠার সুযোগগুলো একে একে কেমন করে হাতছাড়া হলো, শুধু এই পিছুটানের কারনে। সামনে প্রশস্ত রাস্তায় শত শত গাড়ির ছুটে চলার দিকে চেয়ে ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললেন, ” দোটানা, আর টানাহেঁচড়ার জীবনে উঠে দাঁড়ানো কঠিন, খাড়া পাহাড়ে উঠার চেয়েও কঠিন। ”
…
আমার চেনা আরেকজন বড়ভাই আছেন ঠিক বিপরীত। তিনি রাস্তায় গাড়িতে ফলের ব্যবসা করেন। অনেকটা আমাদের দেশের চটপটি, ফুচকার গাড়ির মতন। স্বাধীন ব্যবসা। বছরের কন্কনে শীতের তুষারপাতের সময়টা দেশে থাকেন। বাকি আট মাস এদেশে। আগে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী এদেশে আসতে উদগ্রীব। স্বামী সন্তান নিয়ে একসাথে থাকবে, সংসার সাজাবে, সেই স্বপ্ন দেখে প্রতিনিয়ত। আমি বলি, এটাই স্বাভাবিক। সব মেয়েই এমন স্বপ্ন লালন করে।
এক বিকেলে থার্টি সেভেন এভিনিউতে দেখা হতেই বলি, ” কি রহমান ভাই, ভাবী আর বাচ্চারা কবে আসবে ?”
তিনি একগাল হেসে বলেন, ” মেয়ে মানুষ এই দ্যাশে না আনাই ভাল। বেশি স্বাধীনতা পাইলে চোখ উলটাইয়া ফালাইবো। ”
আমি বিস্ময়ে বলি, ” কিহ্ !”
এবার তিনি আরেকটু প্রশস্ত হাসি হেসে বলেন, ” বুঝেন নাহ্ ! এইখানে আসলে পাখ্না গজাইবো, উড়াল দিতে চাইবো। ”
ততোক্ষণে শেষ বিকেলের নিরুত্তাপ আলো মিলিয়ে যেতে যেতে আঁধার ঘনায় । রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো জ্বলে উঠে। অজস্র মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠা আমি ভাবি…
এটিই প্রবাস। রঙবেরঙের মানুষের দৃশ্যত রঙিন প্রবাস। কারো স্বস্তির নিঃশ্বাসের উল্টো পিঠে কারো দীর্ঘশ্বাস !
কিংবা, এভাবেও বলা যেতে পারে,
পৃথিবীর কোথাও যখন এক আকাশ আলো ছড়িয়ে জ্যোৎস্না উঠে, অন্য কোথাও তখন চারিপাশ আঁধার করে বৃষ্টি নামে।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১২টি মন্তব্য
ইনজা
কথায় আছেনা “নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সূখ আমার বিশ্বাস ” মরাল অব দা স্টোরি সবাই সব কিছুতে খুশি হতে পারেনা।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। এক একজনের সুখ এক এক ভাবে। সবাই সবকিছুতে খুশি হতে পারে না।
জিসান শা ইকরাম
একই রক্ত মাংসের মানুষ আমরা, তবে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার অধিকারী সবাই।
চিন্তা ভাবনার পার্থক্য থাকবেই,
আপনার দেখা দুজন মানুষ তাদের দুজনার চিন্তা ভাবনায় সঠিক
আমার চেনা দুজন মানুষের অভিজ্ঞতা এই দুজনের সাথে মিলে যায়,
একজন হাহাকার করে তার স্ত্রী পুত্রদের জন্য
অন্যজন হাহাকার করে, স্ত্রীকে আমেরিকা নেয়ার তিন মাসের মধ্যে স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে অন্য একজনের সাথে চলে যায়।
এই নিয়েই আমাদের জীবন, কিসে শান্তি আমরা নিজেরাই জানি না।
ভাল থাকুন সব সময় প্রিয় মানুষ।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
ভাল থাকুক আপনার পরিবার।
আবু খায়ের আনিছ
শান্তির পিছঁনে দৌড়াচ্ছি আমরা কিন্তু সেই আমরাই জানিনা আমাদের শান্তি কোথায়।
রিমি রুম্মান
এক এক জনের শান্তি এক এক জায়গায়। যে যেভাবে ভাল থাকতে চায়।
ভাল থাকুন, সবাইকে নিয়ে।
আবু খায়ের আনিছ
শুভেচ্ছা আপু।
মৌনতা রিতু
কেউ পরিবারের মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ ও শৃঙ্খল জীবন চায়। আবার কেউ পরিবারের এই বন্ধনকে তার নিজের স্বাধীন চলাচলের বাঁধা মনে করে, আর এই দুই ঘটনা থেকে এটাই সত্যি প্রমানিত।
শুভকামনা রইল রিমি আপু।
রিমি রুম্মান
ভাল থেকো । সুস্থ থেকো।
শুভকামনা…
নীলাঞ্জনা নীলা
এখানে পাকিস্তানীদের দেখি বৌদের দিয়ে কাজ করায় না। এদের কাজ বাচ্চা লালন-পালন। তবু বাংলাদেশীদের মধ্যে কাজ করার প্রবণতা আছে বেশ। সবচেয়ে মজা দেখি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা পরিবারদের। জানিনা কয়টা বাচ্চা। এরা চাইল্ড বেনিফিটের জন্য বাচ্চা নিতেই থাকে। আমাদের ফ্লাটে সিরিয়ান রিফিউজি এসেছে অনেক। এলিভেটরে যখন ওঠে এরা দেখা যায় একটা পরিবার ভরা।
রিমি আপু নারীরা মানিয়ে নিতে নিতে পুরুষদের জীবন সহজ করে দিচ্ছে।
রিমি রুম্মান
পরিবারে কখনো পুরুষের শাসন, কখনো নারীর শাসন। কখনো পুরুষ অসহায়, কখনো নারী। অথচ দু’জনের সন্মিলিত প্রয়াসে কতই না ভাল থাকা যায়। তাই না , নীলা’দি ?
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু ঠিক তাই। কিন্তু দেখা যায় একজনকেই মানিয়ে নিয়ে যেতে হয় জীবনভর। আর সেখানে নারীর পাল্লাটা বেশী ভারী।