দৃশ্যত রঙিন প্রবাস

রিমি রুম্মান ১০ জুন ২০১৬, শুক্রবার, ১১:০৫:৫৩পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১২ মন্তব্য

নিউইয়র্কে আমার বাড়িতে একজন অতিথি আসেন মাঝে মধ্যে, যিনি দুই যুগেরও অধিক সময় কঠোর পরিশ্রম করেছেন এদেশে। বয়স এবং শারীরিক নানাবিধ অসুস্থতা নিয়ে অবশেষে বিদেশের পাট চুকিয়ে একেবারেই ফিরে গেছেন দেশে পরিবারের কাছে। ডাক্তার কিংবা কাগজপত্র সংক্রান্ত প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে আসেন। কাজ শেষে আবার ফিরেও যান। এই স্বল্পকালীন সময়ে তিনি আমার অতিথি হন। হাসপাতাল কিংবা সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে একাই ছুটোছুটি করেন। কিংবা সময় পেলে আমিও নিয়ে যাই। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন অনেক আগেই। এখন জীবনের পড়ন্ত বেলা।

জীবনের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি নিয়ে গল্প হচ্ছিলো। কথা বলছিলাম, ফেলে আসা জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ থাকলে কোন ভুলটি শুধরে নিতাম__ এসব নিয়ে। বললেন, বিয়েটাই ভুল ছিল, কিংবা ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক টেনে নিয়ে গেছেন গোটা একটা জীবন। কেননা, স্ত্রীকে এদেশে আনার ব্যপারে কোনভাবেই রাজী করাতে পারেননি তিনি। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুন্দর একটি জীবন হতে পারতো এদেশে তাঁর। হয়নি। বাধ্য হয়েই পরিবারের সান্নিধ্য পাবার জন্য বছরের ক’মাস দেশে, আর রুটি, রুজির তাগিদে বাকীটা সময় বিদেশে কাটাতে হয়েছে। এতে না পেরেছেন কাছে থেকে সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করতে, না পেরেছেন ভালো আয়-রোজগার করতে।

গল্পে গল্পে ন্যাশনাল এভিনিউয়ের রেড লাইটে এসে থামি আমরা। আমি ফিরে চাই পাশের সিটে বসা জীবন সংগ্রামে লড়াকু একজন মানুষের দিকে। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। বললেন অনেক কথা। উপরে উঠার সুযোগগুলো একে একে কেমন করে হাতছাড়া হলো, শুধু এই পিছুটানের কারনে। সামনে প্রশস্ত রাস্তায় শত শত গাড়ির ছুটে চলার দিকে চেয়ে ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বললেন, ” দোটানা, আর টানাহেঁচড়ার জীবনে উঠে দাঁড়ানো কঠিন, খাড়া পাহাড়ে উঠার চেয়েও কঠিন। ”

আমার চেনা আরেকজন বড়ভাই আছেন ঠিক বিপরীত। তিনি রাস্তায় গাড়িতে ফলের ব্যবসা করেন। অনেকটা আমাদের দেশের চটপটি, ফুচকার গাড়ির মতন। স্বাধীন ব্যবসা। বছরের কন্‌কনে শীতের তুষারপাতের সময়টা দেশে থাকেন। বাকি আট মাস এদেশে। আগে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী এদেশে আসতে উদগ্রীব। স্বামী সন্তান নিয়ে একসাথে থাকবে, সংসার সাজাবে, সেই স্বপ্ন দেখে প্রতিনিয়ত। আমি বলি, এটাই স্বাভাবিক। সব মেয়েই এমন স্বপ্ন লালন করে।

 

এক বিকেলে থার্টি সেভেন এভিনিউতে দেখা হতেই বলি, ” কি রহমান ভাই, ভাবী আর বাচ্চারা কবে আসবে ?”

তিনি একগাল হেসে বলেন, ” মেয়ে মানুষ এই দ্যাশে না আনাই ভাল। বেশি স্বাধীনতা পাইলে চোখ উলটাইয়া ফালাইবো। ”

আমি বিস্ময়ে বলি, ” কিহ্‌ !”

এবার তিনি আরেকটু প্রশস্ত হাসি হেসে বলেন, ” বুঝেন নাহ্‌ ! এইখানে আসলে পাখ্‌না গজাইবো, উড়াল দিতে চাইবো। ”

ততোক্ষণে শেষ বিকেলের নিরুত্তাপ আলো মিলিয়ে যেতে যেতে আঁধার ঘনায় । রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো জ্বলে উঠে। অজস্র মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠা আমি ভাবি…

এটিই প্রবাস। রঙবেরঙের মানুষের দৃশ্যত রঙিন প্রবাস। কারো স্বস্তির নিঃশ্বাসের উল্টো পিঠে কারো দীর্ঘশ্বাস !

কিংবা, এভাবেও বলা যেতে পারে,

পৃথিবীর কোথাও যখন এক আকাশ আলো ছড়িয়ে জ্যোৎস্না উঠে, অন্য কোথাও তখন চারিপাশ আঁধার করে বৃষ্টি নামে।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 

৩৯৪জন ৩৯৪জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ