
মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ। খোলা আকাশের নিচে হাঁটছি। বেশ ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য বাইক্কা বিলের টাওয়ারে উঠে বসে আছি। টাওয়ারের সামনে অল্প পানিতে পদ্মপাতা ভেসে আছে। সেই পাতার নিচে খুঁজে খুঁজে শৈবাল খাচ্ছে জলচর পাখি।। এমন সময় পাখির একটি ঝাঁক এসে বসলো জলজ উদ্ভিদের উপর। পাখিগুলো দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম বক জাতীয় পাখি। পরে এই পাখির পরিচয় জানতে পারি। এদের নাম ‘কাস্তেচরা’। অনেকেই মনে করেন এরা পরিযায়ী পাখি। আসলে এরা পরিযায়ী নয়। আমাদের দেশের দুর্লভ পাখি।
কাস্তেচরা Threskionis পরিবারের অন্তর্ভূক্ত মাঝারি আকারের ৭৫ সেমি দৈর্ঘ্যের জলচর পাখি। বয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড় পালকহীন। ঠোঁট নিচে বাঁকানো ও কালো রঙের। মাথা ও ঘাড় ছাড়া দেহ সাদা। ঘাড়ের গোড়ায় কিছু পালক ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ডানা সাদা-ঢাকনিতে ধুসর আভা। বুকে হলুদ আভা। অনেক সময় কাঁধে সাদা পালক থাকে। ঘাড় নীলচে কালো। চোখ লাল বাদামী। পা লম্বা। পায়ের পাতা কুচকুচে কালো। প্রজননের সময় পুরুষ পাখির ঘাড়ে পালকে সজ্জিত থাকে। পুরুষ ও মেয়ে পাখির চেহারায় ভিন্নতা আছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড়ের নিচের অংশ কালো ও নরম পালক থাকে। ঘাড়ের সামনের অংশ সাদা।
কাস্তেচরা জলাভূমি, নদী, তৃণভূমি, ধানক্ষেত, কাদাচরা ও উপকূলের জোয়ার-ভাটার খাঁড়িতে বিচরণ করে। এরা সচরাচর দল বেঁধে থাকে। একেকটি ঝাঁকে অন্তত ২০০-২৫০ পাখি দেখা যায়। কাদা বালু ও অগভীর পানিতে ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা খাবার খুঁজে খায়। মাছ, ব্যাঙ, ছোট শামুক, কেঁচো, শৈবাল এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে। শীত মৌসুমে এরা নীরব থাকে, কিন্তু গরমের সময় ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে ডাকে। ওড়ার সময় এরা বকের মত গলা ভাঁজ করে না।
জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এদের প্রজনন সময়। প্রজননকালে বক ও পানকৌড়ির সঙ্গে মিশে যায়। পানির ধারে জলমগ্ন গাছে কিংবা গ্রামের কুঞ্জবনে ডালপালা দিয়ে ছোট মাচার মত বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখিটি ২-৪টি সাদা ডিম পাড়ে। ২০-২৫ দিনের মাথায় ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। মা-বাবা উভয়েই বাচ্চা লালন-পালন করে।
কাস্তেচরা আমাদের দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। শীত মৌসুমে বরিশাল, হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, টাঙ্গুয়ার হাওর, রাজশাহীর পদ্মার চর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভোলায় দেখা যায়। এ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারসহ এশিয়ার অনেক দেশেই এদের বিচরণ রয়েছে। বিশ্বে ৫ প্রজাতির কাস্তেচরা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এক প্রজাতি দেখা যায়।
বাংলা নাম: কাস্তেচরা
ইংরেজি নাম: Black-headed Ibis
বৈজ্ঞানিক নাম: Threskionis melanocephalus
ছবিগুলো হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপের দমারচর ও ভারতের ভরতপুর থেকে তোলা।
৩০টি মন্তব্য
ইঞ্জা
অনেকদিন পর পাখি নিয়ে বিস্তারিত লিখতে শুরু করলেন দেখে খুব ভালো লাগলো, কাস্তেচরা যে আমাদের দেশিয় দূর্লভ পাখি তা আজ জানলাম।
পোস্টটির জন্য ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ সুহৃদ।
ইঞ্জা
😊
শামীম চৌধুরী
আসলে ভ্রমন কাহিনীতে অনেক সময় গিয়েছে। যার জন্য পাখি নিয়ে বিশদ লেখার সুযোগ ও সময় হয়ে উঠে নি। যে পাখিগুলি ভ্রমন কাহিনীতে দেখেছেন সেগুলি নিয়ে ভাবছি বিস্তারিত লিখবো।
ধন্যবাদ ভাই সঙ্গে থাকার জন্য।
ইঞ্জা
লিখেন ভাই, আমি অপেক্ষায় থাকবো।
প্রদীপ চক্রবর্তী
অনেকদিন পর পাখি নিয়ে বিস্তারিত লেখনী।
খুবি সুন্দর পরিবেশে তাদের বিচরণ।
বিশ্বে ৫ প্রজাতির কাস্তেচরা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এক প্রজাতি দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় মনে হয়?
.
খুবি ভালো লাগলো,দাদা।
শামীম চৌধুরী
সত্যি কথা কি দাদাভাই, ভ্রমন কাহিনী নিয়ে সময় দিতে হয়েছিল। গল্পটি শেষ হওয়ায় এখন সময় পাচ্ছি। তাই আবার শুরু করলাম পাখি পরিচিতি।
ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।
সুপায়ন বড়ুয়া
পাখিগুলো দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম বক জাতীয় পাখি। মাছ শিখারে ব্যস্ত যেমন দেখি খালে বিলে
পাশের গ্রামের নদীর তীরে।
আপনার থেকে জানতে পারলাম পাখির নাম ‘কাস্তেচরা’।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
এরা গণে বক জাতীয়। তবে এরা ৯টি উপ প্রজাতিতে বিভক্ত। এই প্রজাতিও প্রচুর মাঝ খায়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
কাস্তেচরা পাখি নিয়ে বিশদভাবে জানানোর জন্য অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ ভাইয়া। পাখিটিকে আমার খুব ভালো লেগেছে অবশ্য পাখি আমার খুব প্রিয় প্রাণীদের মধ্যে। এরা পরিযায়ী নয় দুর্লভ পাখি আমাদের দেশের এটা শুনে ভালো লাগার পাশাপাশি মনটা খারাপ হয়ে গেল দুর্লভ বলে। যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে, অভয়ারণ্য নষ্ট করা হচ্ছে তাতে এমনটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুভ কামনা রইলো অফুরন্ত
শামীম চৌধুরী
দিদিভাই.
ভরতপুরে যে পাখিগুলি পেয়েছিলাম ভাবছি এই পাখিগুলি নিয়ে পাখির পরিচিতি তুলে ধরবো। তাতে পাঠকরা অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন। আর তাদের জানানোটা আমার কর্তব্য। এরা দূর্লভ হয়ে শুধুমাত্র উচু উচু গাছ নিধনের জন্য। সত্যিই বলেছেন আপনি। আর পাখি ও ফুল কার না ভাল লাগে।
শুভ কামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
আচ্ছা, কাস্তেচরা পাখি কি অন্য রঙ বা রকম হয়?
পাখিটি দেখতে ভালই লাগে, সাদা-কালোর মিশ্রণে।
পাখি ভাই পাখি ভাই ই।
শামীম চৌধুরী
না মহারাজ, কালোমাথা কাস্তেচরা এক রঙেরই হয়। আরেকটা আগে গ্লোসী কাস্তেচরা। সেটা রঙ্গিন হয়। দুইটা দুই প্রজাতির।
আমার মহারাজ ভাই মহারাজই।
আরজু মুক্তা
এই প্রথম এমন পাখি দেখলাম।
ভালো লাগলো।
আপনার জন্য থাকলো শুভেচ্ছার ফুলঝুড়ি
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।
আপনার জন্যও রইলো সেই ফুলঝুড়ির গোলাপের শুভেচ্ছা।
হালিম নজরুল
আপনার কল্যাণে অনেককিছু দেখলাম, জানলাম। ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
আপনাদে জানাতে ও দেখাতে পেরে নিজের পরিশ্রমকে স্বার্থক মনে হয় ভাইজান।
ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।
কামাল উদ্দিন
টুকিটাকি ছবি উঠানোর চেষ্টা করি বলে ক্যামেরা হাতে থাকলে পাখিদের খুঁজে বেড়ায় আমার চোখ। এই কাস্তেচড়া পাখিটা এখনো আমার চোখে পড়েনি। আপনার এমন পোষ্টগুলো পড়ে পাখিদের সম্পর্কে অনেক জানা হচ্ছে ভাই………শুভ সকাল।
শামীম চৌধুরী
কামাল ভাই,
কাস্তেচরা দেখতে হরে হাওর বা বিলে যেতে হবে। মার্চ থেকে এপ্রিল মাস এদের দেখা পাবেন। যদি দেখতেই মন চায় তবে এই সময়ে বাইক্কা বিল বা টাঙ্গুয়ার হাওর বা নিঝুম দ্বীপে চলে যেতে পারেন।
কামাল উদ্দিন
বাইক্কাবিল আমার হাতের নাগালে, হয়তো এই সপ্তাহেই দৌড় লাগাইতে পারি।
শামীম চৌধুরী
ভাই এখন দেখা পাবেন না। মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে যে কোন সময়ে যাবেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভাইয়া এই পাখিদের মাংস কি খায়? বোকার মত জানতে চাইলাম। শুভ কামনা। শুভ সকাল।
শামীম চৌধুরী
জানাটা আপু বোকার মতন হবে কেন? অজানাকে জানাটাই হচ্ছে জ্ঞানার্জন।
জ্বি আপু একমাত্র চিল,শকুন,বাজ ও ঈগল ছাড়া সবই মনুষ্যরা ভক্ষন করে।
কামাল উদ্দিন
তবে ওদের খাদকদের প্রতিহত করা আমাদের অবশ্যই অবশ্যই কর্তব্য বলে আমি মনে করি আপু।
শামীম চৌধুরী
সহমত ভাই।
খাদিজাতুল কুবরা
আমিতো প্রথমে বক ভেবেছিলাম। আমাদের গ্রামে কালো বক দেখেছি। কিন্তু এখন দেখছি এ পাখিটির নাম কাস্তেচরা। খুব সুন্দর পাখি। উড়ন্ত অবস্থায় বেশি ভালো দেখতে।
ধন্যবাদ ভাইয়া সুন্দর সুন্দর ছবি এবং বিস্তারিত জানানোর জন্য।
শামীম চৌধুরী
আপনি ঠিকই বলেছেন। ব্ল্যাক বিটার্ন বা কালো বক এখনও গ্রামের পুকুর ধারে ও ঝোপে দেখা যায়। প্রচুর মাছখেঁকো পাখি। কাস্তেচরা লোকালয়ে আসে না। এরা হাওড় বিল ও উপকূলীয় পাখি। তাই দেখা হয়নি কখনো।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য দেবার জন্য।
তৌহিদ
আপনার লেখা মানেই ভিন্নধর্মী তথ্যজ্ঞান লাভ করা। কাস্তেচরা পাখি আজই প্রথম দেখলাম আপনার মাধ্যমে। ধন্যবাদ ভাই।
শুভকামনা রইলো।
শামীম চৌধুরী
অনেক ধন্যবাদ ভাই। চেষ্টা করি পাখি নিয়ে আমি যতটুকু জানি তা সবাইকে জানাতে। আমার এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
তৌহিদ
আপনার মতন গুনীজনের কাছে এটাই কাম্য ভাই।