দীর্ঘ খাটাখাটনির পর পরীক্ষা শেষ হল । বুঝতেই পারছ আবার আমার পাখা গজিয়ে গেল । ঘুম থেকে ওঠার ও ঘুমোবার কোন নির্দিস্ট সময় থাকল না । কখন কোথায় যাই কি করি তারও কোন ঠিক থাকল না । যদিও ফোনে কথা বলার সময় তোমার মামাতো বোন দুই একবার তোমার কথা তুলেছিল ,কিন্তু পরীক্ষার পর তোমার কথা পুরোপুরি ভুলে গেলাম । আমি মুক্ত বিহঙ্গ । আসতে আসতে স্মৃতি থেকে তোমার মামাতো বোনও উধাও হয়ে গেল । পরীক্ষার ফল বের হল । আশানুরূপ ফলাফলে আমি,আমার পরিবার,বন্ধুরা সবাই খুশি ।আমি আর পিছনের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ই পেলাম না। দেশের সেরা একটা কলেজে ভর্তিও হয়ে গেলাম,যার জন্য নিজের শহরটাকেও ছাড়তে হল ।
শুরু হল আমার ঢাকার জীবন । কাকার বাসায় থাকি । আমার আধ-পাগলা ডিভোর্সি কাকা নিজে বাসা থেকে না বেরিয়ে পারলে বের হয় না ,আর আমাকেও বের হতে দেয় না । কলেজে গেলেও তার একজন পিওন সাথে দিয়ে দেয়।সেই পিওনটা আবার ছুটি হলে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয় । পুরোপুরি চিপার ভিতর পড়ে গেলাম । যে আমি দিনের শতকরা ৭০% সময় বন্ধুদের সাথে কাটাতাম সেই আমি এখন কলেজ ছাড়া বাকিটা সময় বাসায় কাটাই।বাসায় সারাদিনই একা থাকি,শুধু খাওয়ার সময় কাকার সাথে দুই একটা কথা হয়,তাও পড়াশুনা নিয়ে।এই বন্দি জীবনে হঠাৎ হঠাৎ তোমার কথা আমার মনে পড়ত।ভাবতাম “ঈশ,মেয়েটা কি লাজুক ছিল,সবাই এত বক বক করল,অথচ ও কোন কথাই বলল না।যদি আবার ওর সাথে দেখা হয় তাহলে বেশ শয়তানি ওর সাথে করব”।এসব ভাবতাম আর নিজে নিজে লজ্জা পেতাম।কিন্তু সময় পেলেই আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতে বসতাম।আর স্বপ্ন দেখতাম তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে, আমরা কথা বলছি । তোমাকে বার বার লজ্জা দিচ্ছি । তুমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছ এসব । কিন্তু যতই তোমার কথা ভাবতাম ততই নিজে লজ্জা পেতাম ।তুমি জানো আমি একদিন তোমার মামাতো বোনের কাছে ফোন দিয়েছিলাম শুধু তোমার খোজ নেয়ার জন্য । কিন্তু দুর্ভাগ্য ফোনটা তোমার মামা ধরেছিল । তাই ২য় বার আর সাহস করি নি । এভাবেই কাটছিল সময়। ধিরে ধিরে কাকার বাসা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল।যতই অসহ্য লাগত ততই আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতাম । আসলে এখন বুঝি , আমার ভাবার কিছু ছিল না,তাই তোমাকে নিয়ে ভাবতাম ।এই কথা শুনে তুমি কি রাগ করলে??? আসলে রাগ করারই কথা । কিন্তু আজ আর কোন মিথ্যা তোমার কাছে বলব না । কেন এই কথা বললাম তা একটু পরেই পরিস্কার হবে ।
কাকার বাসা থেকে মুক্তি মিলল।আমি চলে গেলাম হোস্টেলে।এখানে আবার নতুন পরিবেশ । কারো কোন প্রাইভেচি নেই । এক রুমে চারজন।গণ টয়লেট। একসাথে সময় মত খাওয়া।ভোরে ঘুম থেকে ওঠে প্রার্থনা করা । নতুন বন্ধু । নতুন শহর ঢাকা।সব মিলিয়ে আমি আবার তোমার কথা ভুলে গেলাম । তখন আমার পুরটা জুড়ে ছিল নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা । এখানে আর একজনের কথা না বললে অপরাধ হবে । তোমার কি “মৌরীর” কথা মনে আছে?? আমার পিতৃবন্ধুর মেয়ে । ভুলে যাওয়ার কথা না । যা হোক ।আমরা ছিলাম ৫ দিনের ছোট বড় । এই নিয়ে ছোট বেলায় আমাদের ভিতর বিস্তর ঝগড়া হয়েছে যে-“কেন মৌরি আমাকে দাদা ডাকে না” । সেই মৌরীর সাথে আবার দেখা হল ঢাকায় এসে ।আমাকে ঢাকা শহরটা ঘুরিয়ে দেখানর দায়িত্ব পুরোপুরি নিয়ে নিল মৌরি।কিন্তু দায়িত্বটা কে তাকে দিয়েছিল তা এখনও অজানা ।শুক্রবার হলেই সকালে আমি মৌরিদের বাসায় চলে যাই । সকালের নাস্তা খেয়েই দুইজনে বেরিয়ে পড়ি।কোনদিন রমনা ,কোনদিন জিয়া উদ্যান আবার বোটানিক্যাল বা আশুলিয়া কোন না কোন দিকে আমরা যাবই । ফাস্টফুড কিভাবে খেতে হয় । বড় মার্কেটে গিয়ে কিভাবে কেনাকাটা করতে হয়, কিভাবে কথা বলতে হয় এসব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল মৌরি ।
আমার রুটিন টা দাড়িয়ে গেল এরকম।ছুটির দিনে মৌরি আর বাকি দিন গুলোতে কলেজ,হোস্টেল আর নতুন বন্ধুরা । আবার তুমি তলিয়ে গেলে অতল অন্ধকারে । তখন আমি সম্পুর্ন নতুন এক মানুষ।মেয়েদের সামনে লাজুক আমি এখন গড় গড় করে মেয়েদের সাথে কথা বলি । সুযোগ পেলেই ইভ-টিজিং করি(তুমি তো জানো এই কাজটি এখনও করি না, আগেও করতাম না) ।
এখন সেই ঘটনা টা বলি কিভাবে তোমার সাথে আবার আমার যোগাযোগ হল।নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি।যেহেতু মোবাইল তখন এতটা সস্তা না, তাই মিস্কল দিলেই কেউ ব্যাক করত না । কিছুদিন ধরেই আমার ফোনে একটা নম্বর থেকে মিস্কল আসা শুরু করল । শুরু করল তো ভালো কথা আমিও সমানে মিস্কল দিয়ে গেলাম।কিন্তু অবাক হলাম তখন যখন দেখলাম ওই নম্বর থেকে কল দিচ্ছে, কিন্তু রিসিভ করার পর কেউ কথা বলে না।প্রতিদিনই রাতে এই ঘটনা ঘটত।ঠিক রাত ১০ থেকে সাড়ে দশটার ভিতর।প্রথমে আমার খুব মজা লাগত।কিন্তু একটা পর্জায়ে এসে খুব মেজাজ খারাপ হতে লাগল। প্রথমে একদিন রিসিভ করার পর ঝাড়ি দিলাম।পরে রুম মেটদের কাছে দিতাম কথা বলার জন্য।কিন্তু অন্য কণ্ঠ পেলেই লাইন কেটে জেত ।এখন বুঝি তুমি কেটে দিতে।কিন্তু একদিন শুরু করে দিলাম গালাগালি, মুখে যা আসে তাই(গালাগালি তে আমি আর আমার বন্ধু সজল ছিলাম চ্যাম্পিয়ান,ফোনে গালি দেয়ার জন্য আমাদের ভাড়া করা হত) । খুব বাজে বাজে বেশ কিছু গালি দিলাম । কিন্তু আশ্চার্জ্য যে বিষয়টি খেয়াল করলাম তা হল প্রতিদিনের চেয়ে অনেক পরে ওইদিন লাইন টা কাটল । বেশ ভালো । আমি ফুরফুরে মেজাজে বই নিয়ে বসলাম । তখন আবারও সেই নম্বর থেকে ফোন । আমি তো অবাক । রিসিভ করলাম, আবার সেই নিরাবতা। কিন্তু লাইন কাটছে না । এইবার ভদ্র ছেলের মত অসহায় ভঙ্গিতে বললাম,”দেখুন কথা যদি না বলেন আমি কিন্তু নম্বর বদলে ফেলব” । এইবার কাজ হল । একটা ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেলাম, যার সারমর্ম বের করলে বুঝা যায় কেউ খুব ভয়ে ভয়ে বলছে হ্যালো । আমি চমৎকৃত ।মেয়ের গলা । যাই হোক জিগ্যাস করলাম কে?? তুমি জবাব না দিয়ে বললে “আপনি কি শুভ্র” । আমি বললাম হ্যা, কিন্তু আপনি কে?? এইবার তুমি তোমার নাম বললে ।বিশ্বাস কর আমার গায়ের রক্ত পুরা হিম হয়ে গিয়েছিল তোমার নাম শুনে । যদিও আমি পার্ট নেয়ার জন্য বললাম ঠিক চিনতে পারলাম না। তখন তোমাকে চেনার যত পথ আছে সব পথ থেকে ঘুরিয়ে আনলে। আর আমি বললাম “ও,তা কি মনে করে,এতদিন পর।নম্বরই বা কোথায় পেলে?”।তুমি কি খেয়াল করেছিলে আমার গলা সেদিন কাপছিল । তুমি বিশ্বাস করবে না, শুধু আমার গলা না সারা শরীরই সেদিন কাপছিল ।
চলবে…………………
১৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
অসাধারন লিখছো শুভ্র ।
মুগ্ধ হয়ে গেলাম লেখার বুননে ।
"বাইরনিক শুভ্র"
এত ভালো বইলেন না । লজ্জা পাই ।
শিশির কনা
ভাইয়া আপনি নাটক লিখেন । জমজমাট কাহিনী মনে হচ্ছে । এক বারেই পড়ে ফেললাম। অনেক অনেক ভালো লেগেছে।
"বাইরনিক শুভ্র"
ভাই সে যোগ্যতা আমার নেই । পরেছেন এ জন্য ধন্যবাদ ।
বনলতা সেন
অসাধারন । খুব ভালো লেগেছে মিষ্টি প্রেমের সুচনা ।
"বাইরনিক শুভ্র"
ধন্যবাদ ।
আদিব আদ্নান
বেশ জমে উঠছে গল্পটি ।
"বাইরনিক শুভ্র"
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।
ছাইরাছ হেলাল
ছোট ছোট বাক্যে গল্পের বিস্তার ভাল হচ্ছে ।
অপেক্ষা করছি ।
"বাইরনিক শুভ্র"
পড়েছেন এজন্য ধন্যবাদ ।
প্রজন্ম ৭১
যাক নায়ক নায়িকার মিলন হলো অবশেষে ।
"বাইরনিক শুভ্র"
“নায়ক নায়িকার মিলন” হা হা হা হা । দেখা যাক কি হয় ।
লীলাবতী
পরিণতির দিকে এগুচ্ছে । নায়িকার দেখা পাওয়া যাচ্ছে 🙂
"বাইরনিক শুভ্র"
হুম। পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ।
হতভাগ্য কবি
অদ্ভুত জোশ। ভালাগসে 🙂
"বাইরনিক শুভ্র"
=D