দেশ থেকে দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে যারা নতুন বিদেশে পাড়ি জমান, তাঁদের ভাষাগত সমস্যাসহ নানাবিধ কারনে চাকুরি পাওয়া বেশ কঠিন। যদিও বেশিরভাগই অসীম মনোবলে যে কোন কাজ করতেই আগ্রহী, তবুও তাঁদের জন্যে চাকুরি যেন সোনার হরিণ। আমার এখনো মনে আছে সেইসব দিনের কথা। অভিবাসী জীবনের প্রথমদিকের কথা। আমি হন্যে হয়ে সম্ভাব্য অনেক জায়গায় চাকুরির আবেদন করে অপেক্ষার প্রহর গুনতাম। ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে চম্কে উঠতাম। এই বুঝি কোন কর্মস্থল থেকে ফোন এলো।। কিন্তু নাহ্, এমন কোন ফোন আসেনি কোনদিন। শেষে এক পরিচিত আপার অনুরোধে তাঁরই কর্মস্থলে চাকুরি হয়। অর্থাৎ নতুনদের জন্যে মাধ্যমটা জরুরি হয়ে উঠে।
গত সপ্তাহে আমার ভাই প্রথমবারের মত নিউইয়র্কে আসে আসেইমিগ্র্যান্ট হয়ে। দুইদিন বিশ্রাম নেবার পর তাঁর আর অবসর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। চাকুরি করতে চাইছে মনে প্রাণে। জানতে চাইলাম, কি কাজ করবি ? তাঁর বলিষ্ঠ জবাব, যে কোন কাজ। এই যে, যে কোন কাজ করার বাসনা, আগ্রহ এটি ইতিবাচক মানসিকতা। কিন্তু আমার বিস্ময় অন্যখানে। বাবা-মা’র একমাত্র পুত্র, আদরে আদরে যার বেড়ে উঠা, তাঁর এহেন মনোভাব হোল কেমন করে! বাস্তবতার কারণে নাকি বিদেশ বিভূঁই বলে সে বিশ্লেষণে না-ই বা গেলাম। তবে এটি তো সত্য যে বিদেশে আমরা যে কোন কাজ করতে কুণ্ঠা বোধ করি না। কেননা এখানে সকল কাজ কিংবা পেশাকেই সম্মানের চোখে দেখা হয়। আমাদের ইমিগ্র্যান্ট জীবনের শুরুটা ছিল আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো ছিল অন্যরকম। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার নতুন অর্থ সঞ্চারিত হবার মত। তখন ছিল গ্রীষ্মের শুরু। স্বামী প্রতিদিন ভোরে কোট, টাই পরে চাকুরি খুঁজতে বের হতেন। ফিরতেন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে। ক্লান্ত চেহারায় রোজ খুশি খুশি ভাব নিয়ে জানাতেন, অনেকেই ফোন নাম্বার রেখেছে। সহসাই ফোন করবে। আমরা ধরেই নিতাম চাকুরি হয়ে যাবে যে সময়। আমরা সেই আনন্দে আতিশয্য হবার মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকতাম। আশায় বুক বাঁধতাম। ফোন সেটের দিকে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকতাম। মরুভূমির বুকে তৃষ্ণিত চাতক যেমন দু’ফোটা তৃষ্ণার জলের আশায় চেয়ে থাকে, ঠিক তেমন। সপ্তাহ শেষ হয়, নতুন সপ্তাহ শুরু হয়। ফোন আর আসে না। আমার স্বামী আবারো সেইসব জায়গাগুলোয় দেখা করতে যেতেন। ফোন করেনি কেন, ডাকেনি কেন, জানতে চাইতেন। তাঁরা কপাল কুঁচকে রাজ্যের বিস্ময় প্রকাশ করে বলতেন , ‘ ইয়ং ম্যান, তুমি এখনো জব পাওনি! ‘ বলা বাহুল্য যে, এদেশে প্রায় ক্ষেত্রে চাকুরি খুঁজতে যাওয়াদের ‘ পরে ফোন করে জানাবো ‘ কথাটির অর্থ ‘ কর্ম খালি নেই ‘ এটি বুঝতে আমাদের অনেকটা সময় লেগেছিল। এক আমেরিকান বস্ টাই নেড়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি ধরনের চাকুরি আশা কর ? সেইদিন তিনিও উত্তর দিয়েছিলেন, যে কোন কাজ হলেই চলবে। এই যে, ‘ যে কোন কাজ ‘ করার মানসিকতা, এটি আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেকদূর।
দেশ থেকে যারা নতুন বিদেশে আসেন, শুরুর দিকে প্রায় সকলকেই কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে হয়। যারা স্টুডেন্ট ভিসায় এদেশে আসেন , তাঁদের যেমন কাজ করেই নিজের থাকা খাওয়ার খরচ বহন করতে হয়, তেমনি যারা পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে আসেন, তাঁদেরও (গুটিকতেক বিত্তশালীর কথা অবশ্য ভিন্ন)। আমার দেশের দরিদ্র খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের মতোই একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কঠোর পরিশ্রমের ফল স্বরূপ বিদেশে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়। আমরা ভালো থাকি। চমৎকার জীবন-যাপন করি। কঠিন, কঠোর সময় পাড়ি দিয়ে ‘ যে কোন কাজ ‘ করার মানসিকতায় এদেশে বসবাসের নানাবিধ কারণ আছে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই।
সময়টা ছিল কোমল, সুশৃঙ্খল, শান্ত এক দুপুর। শিশুদের স্কুল ছুটি হোল। সকল অভিভাবকরা একে একে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিল। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একাকি। চিন্তাক্লিষ্ট মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দূর থেকে হন্তদন্ত হয়ে আমার আট বছর বয়সী ছেলের শ্রেণি শিক্ষক এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। ছেলের হাত আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেরিতে আসার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন। সাথে একটি শাদা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমি খুব দুঃখিত যে, কাল আমাদের ফিল্ড ট্রিপে তোমার ছেলে সাথে যেতে পারছে না। আমি কপাল কিঞ্চিত কুঁচকে কারন জানতে চাইলাম। মিস ইব্রাহীম জানালেন, যেহেতু তোমার ছেলের শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা আছে, তাই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ফর্মটি তাঁর ডাক্তারকে পূরণ করে দিতে বলবে। এবং অফিসের মেডিক্যাল রুমে জমা দিবে। ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া এই হিমাংকের নিচে তাপমাত্রার সময়ে আমরা তাঁকে বাইরে নিয়ে যেতে পারি না। মিস ইব্রাহীমকে নামের কারনে প্রথমদিকে ভাবতাম মুসলিম। কিন্তু গত প্যারেন্ট টিচার কনফারেন্সের সময়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁর পূর্বপুরুষেরা ইগিপ্ট থেকে এসেছে এদেশে। মিস ইব্রাহীম বেশ বিনয়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ করলেন আবারো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি ভেবো না, আগামীকাল তোমায় আমি অন্য ক্লাসে রেখে যাবো যদিও, কিন্তু তোমার জন্যে আনন্দদায়ক হবে এমন ব্যবস্থা করে যাবো। বিদায় বেলায় রিহান তাঁর শিক্ষককে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরলো যেমন করে রোজ আমায় জড়িয়ে ধরে ঠিক তেমন। দৃশ্যটা এতো অদ্ভুত সুন্দর, মমতার ! যেন প্রখর রোদে শীতল ছায়া। এদেশের স্কুল শিক্ষকদের এই মমতাটুকু বেশ ভাল লাগে। স্কুল ছুটির পর প্রায়ই রিহান তাঁর পূর্ববর্তী বছরগুলোয় যারা শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করে, সৌজন্যসূচক জড়িয়ে ধরে। শুধু সে-ই নয়, অন্য শিশুরাও শিক্ষকদের সাথে একই আচরণ করে। শিক্ষক-ছাত্রের এই মায়ার বন্ধন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর অন্যতম। আরেকটি ভালোলাগার বিষয়, প্রায়ই স্কুল ছুটির সময় আমি যখন অন্য অভিভাবকদের সাথে বাইরের প্রশস্ত ফুটপাতে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি, সে সময় স্বর্গীয় এক অনুভূতিতে কিছু অসাধারণ দৃশ্য দেখি। যে গেইট দিয়ে থার্ড গ্রেডের ছাত্ররা বেরিয়ে আসে, সেই একই গেইট দিয়ে বের হয়ে আসে কিছু দেবশিশু। অর্থাৎ স্পেশাল নিডস্ এর শিশুরা যাঁদের বাংলায় বলে প্রতিবন্ধী। ওঁরা সংখ্যায় সবমিলে দশ/বারো জন হবে। কেউ একদৃষ্টে ঘাড় উঁচিয়ে শুন্যে তাকিয়ে থাকে, কেউ বা একাকি খিলখিল করে হেসে উঠে। আবার কেউ সশব্দে কাঁদে। কেউ এমনভাবে হাঁটে যে দু’পায়ের সমতা ঠিক রাখতে পারে না। পড়ে যাবার আশংকা থাকে। প্রতিজন শিশুকে একজন করে শিক্ষক কিংবা সহকারী শিক্ষক খুব সতর্কতার সাথে হাত ধরে স্কুল বাসে তুলে দেয়। কখনোবা স্কুল বাসে তুলে দেবার আগে খুব যত্নে জ্যাকেটের চেইন লাগিয়ে দেয় , কিংবা প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে আগলে রাখতে মাথায় কানটুপি পরিয়ে দেয় গভীর মমতায়। কী ভীষণ যত্নশীল চিত্র! এটি আমার প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য। আমি ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবার সময় প্রায়শই ভাবি, এইসব শিশুরা আজন্ম পৃথিবীর জটিলতা, পাপ সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দিবে হয়ত। তাঁদের জীবনের স্বাভাবিক গতি নেই হয়ত, কিন্তু বিধাতা যাদের স্বাভাবিক চলা ফেরার ক্ষমতা দিয়েছেন, বিচার বিবেচনা বোধ দিয়েছেন, তাঁরাই তো এঁদের আগলে রাখছেন, এ-ই বা কম কিসে! এমন নানাবিধ মানবিক কারণে প্রবাসের সংগ্রামী জীবনকেও মধুর এবং গতিময় মনে হয়।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৫টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু কী চমৎকারভাবে দেখিয়ে দিলে আমাদের প্রবাসীদের মন এবং মানসিকতার আমূল পরিবর্তনের দিকগুলো। এতো কঠিন সঙ্কুল জীবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থেকে সুন্দরকেও পেয়ে যাওয়া, এ বুঝি প্রবাসেই সম্ভব।
ভালো থেকো প্রবাসী জীবনে। 🌹
জিসান শা ইকরাম
জানলাম অনেক কিছু প্রবাসের কাজ সম্পর্কে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে যা অকল্পনীয়। ছাত্র শিক্ষকদের এমন সম্পর্ক কবে হবে আমাদের দেশে? ভালো থেকো দিদি ভাই।
তৌহিদ
উন্নতদেশের পরিবেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম আপু। ধন্যবাদ এত সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য। আমাদের দেশে ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক যদি এমন হতো!!
মায়াবতী
খুব ভালো লাগে আপনার লেখা গুলো আপু, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি। অপেক্ষায় থাকি আপনার লেখার জানেন তো? শুভ শুভ কামনা অফুরন্ত আপু। -{@
ছাইরাছ হেলাল
ছাত্র শিক্ষকের এই মায়াময়তা আমাদের এখানে যে কবে শুরু হবে
তা আল্লাহ-ই ভাল জানেন।
অনেক কিছুই জানছি আর জানছি।