
হঠাৎই খুশিতে নেচে উঠলো অনিকের মন।দারুণ ঝকঝকে চকচকে নোটদুটো কন্ডাকটর ফেরত দিতেই আমার দিকে লোভাতুর হাত বাড়িয়ে দিল অনিক। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার বুঝতে বাকি রইল না যে ওটা নিতে চাচ্ছে। আমি কিছু না বলে ওর সামনে হাতটা নাড়িয়ে দিলাম। একবার আমার দিকে আর একবার নোটদুটোর দিকে তাকিয়ে নোটদুটো বুক পকেটে পুরে নিল।
যাচ্ছিলাম মিরপুরে। অনিকের স্কুলের ফলাফল ঘোষণার দিন আজ। তাই ওর ফলাফল নিতে যাওয়া। যদিও আজ ছুটি নিয়েছি, কাজ সেরে অফিস থেকে বেতন উঠিয়ে বাসায় ফিরবো। পকেটে মাত্র পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। মিরপুর থেকে অফিসে ফিরতে ওটাই যথেষ্ট আমাদের জন্য। অবশ্য চা-পানের কথা ভাবলে আলাদা। আপাতত সে চিন্তা মাথায় আনার সুযোগও নেই। বাসের কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতেই বের করে দিলাম নোটটা। কন্ডাক্টর চকচকে একটা বিশ টাকার আর একটা দশ টাকার নোট ফেরত দিল। নতুন টাকা দেখে অনিক মনে মনে সেটা নিজের বলে ভেবে নিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা অনিকের স্কুলে পৌঁছে গেলাম। সেখানে অনেক লোকের ভীড়। ছেলে মেয়ের মা-বাবারা আমার মতই এসেছে ফলাফল নিতে। সেখানে একেকজনের সাথে একেকজন নানান রকম গল্পে মেতে আছে। এক মা তার ছেলেমেয়ের গল্প করছে। বড় ছেলে রাজনীতি করে। অল্প বয়সেই এলাকার বড় নেতা। তার ভয়ে নাকি বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খায়। বড় মেয়েও এক অফিসের বড় অফিসার। পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিটা নিয়েছিল। এখন অফিসের সবাই তাকে ভয় পায়। বেতন পঞ্চাশ হাজার হলেও, আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা উপরি আয়ের ব্যবস্থা আছে। আমি প্রশ্ন করলাম উপরি আয়টা কি? উনি বললেন এই সামান্য উপহার-উপঢৌকন আর কি। আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে, উনার মেয়ের উপরি আয় মূলতঃ ঘুষ থেকেই আসে। আমি বললাম এসব অন্যায় উপার্জন ভাল না। এরকম একেকটি অন্যায় বহু অন্যায়ের জন্ম দেয়। তিনি আমার কথা শুনে রাগে খিটিমিটি করতে লাগলো। আমরা সেখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলাম না।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই অনিকের ফলাফল হাতে পেয়ে গেলাম। অন্যবারের পরীক্ষায় প্রথম হলেও এবার প্রথম হতে পারেনি, দ্বিতীয় হয়েছে। অনিকের কিছুটা মন খারাপ হলো। আমি তাকে বললাম একবার ফলাফল একটু হলে মন খারাপ করতে নেই। কোন যুদ্ধে হেরে গেলে পূণরায় জয়ী হবার দৃঢ় সংকল্পই মানুষকে বিজয়ী করে তোলে। আজকে জয়ী হবার শপথ আগামী দিন জয় ছিনিয়ে আনবেই। তাছাড়া পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়াই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ নয়। সবাইকে আগে একজন ভাল মানুষ হবার শপথ নেওয়া উচিৎ। অনিক আমার কথায় একমত হয়ে মাথা নাড়ালো।
স্কুলের কাজ শেষ করে আমরা আমার অফিসে যাচ্ছি।বাসের কন্ডাক্টর কাছে আসতেই বুকের ভেতর কেমন যেন খচ করে উঠলো। কিন্তু উপায় নেই। কাছে কোন টাকা নেই। আমি অনিকের দিকে অসহায়ভাবে তাকালাম। সে তার পকেট থেকে টাকাটা বের করে অনেকটা নির্লিপ্তভাবে কন্ডাক্টরকে দিয়ে দিলো। সে যেন মনে মনে বলে উঠলো, যা কিছু তোমার নয় তার জন্য আফসোস করোনা।
কন্ডাক্টরের আঙুলের ভাঁজে টাকাটা চকচক করছে।অনিক সেদিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। কিন্তু আমার চোখ পড়লো একটি বারো-তের বছরের কিশোরের দিকে। সেও তাকিয়ে আছে জ্বলজ্বলে নোটটার দিকে।চোখটা ছলছল করছে। প্রথমে মনে হলো টাকাটা তো ওর নয়, তাহলে ও কেন কাঁদবে? পরে অবশ্য ভুলটা ভেঙে গেল। এই টাকাই মানুষের জীবনের কত পার্থক্য গড়ে দেয়!
ছেলেটিকে কাছে ডাকলাম।কৌতুহল হলো বেশ।
–নাম কি? কি করো তুমি?
–গরীবের আর নাম স্যার! হাসু। সাহেব হইলে মাইনসে কইতো হাসেম চৌধুরী।
–সাহেব হইতে কেউ নিষেধ করছে তোমারে! লেখাপড়া শিখে সাহেব হয়ে যাও।
–আর লেখাপড়া স্যার! দুইবেলা খামু কি, তাই জুটাইতে পারি না, আবার লেহাপড়া!
–মানে! কি কও তুমি!
–জে স্যার! লেহাপড়া করতেও তো টাহা লাগে স্যার! আমারও কত কিছু ইচ্ছা করে।আমার বয়সী পোলারা কত সুন্দর পোশাক পইরা স্কুলে যায়, পার্কে খেলাধূলা করে, কত্ত কিছু খায়! আর আমি! রিশকা ঠেইলা জীবন বাঁচাই। কহনো খাই, কহনো খাই না। টাহার অভাবে বিনা চিকিৎসায় বাপ-মা মইরা গেল। আমি কিছু করতে পারি নাই স্যার!
ছেলেটির কথা শুনতে শুনতে কখন যে গন্তব্যে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। পা আর উঠছে না। তবুও কোন মতে বাস থেকে নেমে পড়লাম। পার্কের সামনে নামতেই দেখি একদল ছেলেমেয়ে হৈ হুল্লোড় করে খেলছে আর উল্লাস করছে। পার্কের অন্য কোনায় কারা যেন খাওয়া দাওয়া করছে। কয়েকটা খাবারের প্যাকেট পড়ে আছে।কোন কোন প্যাকেট অর্ধেক খাবারসহই ফেলে দেওয়া। এসব দেখে খুব খারাপ লাগছে। অনিক বললো, দেখোছো বাবা, কত লোক না খেয়ে মরছে, অথচ অন্য মানুষ কত খাবার ফেলে দিচ্ছে, নষ্ট করছে!
অফিস থেকে বেতন উঠিয়ে বাসায় ফিরছি। কিন্তু নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব। কি যেন একটা যন্ত্রনায় আমি কুকড়ে যাচ্ছি।বারবার ওই ছেলেটির মুখ ভেসে উঠছে। আমরা ভাল হলে ওই একই খাবারে ওরাও কত ভাল থাকতে পারতো। নাহ,আর পারছি না। একটা সিগারেট ধরিয়ে নেবো মনে করে চা দোকানের সামনে দাড়ালাম। অনিক বললো, না বাবা, তুমি আর কখনো সিগারেট খাবে না।তুমি যে টাকায় সিগারেট খাও সেটা প্রতিদিন আমার কাছে জমা দেবে। তোমার ঐ সিগারেটের টাকায় হাসুর মত একটা ছেলের জীবন চলে যাবে।
অনিকের কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। এতটুকু ছেলে আমার, অথচ কি অসম্ভব প্রতিভা তার! বললাম ঠিক আছে বাবা, তুমি ঠিক বলেছো। আমি আর কোনদিন সিগারেট খাবো না। আমার সিগারেটের টাকায় হয়তো একটা মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। হয়তো একটি শিশু মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে।
১৪টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
জীবন নামের গল্পটি
ভাল লাগলো।
শুভ কামনা।
হালিম নজরুল
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসম্ভব ভালো লাগলো। এমন করে সবাই যদি ভাবতো , ছোটদের কাছ থেকেও শেখার আছে। শুভ কামনা রইলো
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ দিদি। শুভকামনা রইল।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকে ও ধন্যবাদ ভাইয়া
নিতাই বাবু
আপনার লেখা পড়ে নিজেও ভাবছি! ভাবছি সিগারেট নিয়ে। আমি অত্যন্ত ধূমপায়ী ব্যক্তি। প্রতিদিন নিচে ৪০ থেকে ৫০টি সিগারেট আমার লাগে। যদি এই বদভ্যাস বাদ দিতে পারতাম, নিশ্চয়ই এই টাকা দিয়ে কোনও নিঃস্ব ব্যক্তির উপকার করা যেতো। কিন্তু না, শত চেষ্টাই আমার বিফল হয়ে যাচ্ছে! কিছুতেই ধূমপান থেকে বিরত থাকতে পারছি না, শুধু ভাবেই যাচ্ছি!
তারপরও আপনার পোস্টের লেখনী পড়ে শেষ ভাবাটা হয়তো শেষবারের মতো ভেবে দেখতে হবে। ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
হালিম নজরুল
শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দাদা।
ফয়জুল মহী
খুব ভালো লেগেছে।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।
সুরাইয়া পারভীন
যা কিছু তোমার নয় তার জন্য আফসোস করোনা।
তুমি যে টাকায় সিগারেট খাও সেটা প্রতিদিন আমার কাছে জমা দেবে। তোমার ঐ সিগারেটের টাকায় হাসুর মত একটা ছেলের জীবন চলে যাবে।
দারুণ বলেছে অনিক। চমৎকার গল্প
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ আপা।
হালিম নজরুল
গল্প পড়া সময়সাপেক্ষ বলে পাঠক কম মনে হল।
ইসিয়াক
ভালো লাগলো ভাইয়া।
শুভকামনা রইলো্
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ ভাই