২. প্রবহমানতা
অন্ত্যজ ঝোঁক নিয়ে আট-ছয়-এর চাকার বারবার ঘুরে ঘুরে কথা বলার সনাতন ইতিহাস কবিতাকর্মীদের সুবিদিত। পৌনঃপুনিকতার এই আবর্ত ভেঙে প্রবহমানতার প্রথম দরজা খুলেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত; রেলিংঅলা বনেদি বারান্দাসমেত দ্বিতীয়তলায় উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ; অবশেষে ছাদে চড়ে আকাশের মতো অসীম, বিস্তীর্ণ প্রবহমানতায় ব্যাপ্ত, বিলীন এবং স্তিমিত নক্ষত্রের মুখোমুখি ব্যঞ্জনাবিধূর হতে শেখালেন জীবনানন্দ।
১. একদিন জলসিড়ি// নদীটির তীরে এই // বাংলার মাঠে//
বিশীর্ণ বটের নিচে// শুয়ে র’ব; //-পশমের মত লাল ফল//
ঝরিবে বিজন ঘাসে//
২. একদিন জলসিড়ি নদীটির তীরে// এই বাংলার মাঠে//
বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে র’ব; //-পশমের মত লাল ফল//
ঝরিবে বিজন ঘাসে//
৩. একদিন জলসিড়ি নদীটির তীরে// এই বাংলার মাঠে//
বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে র’ব; //-পশ// মের// মত// লাল// ফল//
ঝরিবে বিজন ঘাসে//
[একদিন জলসিড়ি (রূপসী বাংলা)]
উদ্ধৃত শুধু তিন ধরনের বাঁটেই (পর্বাঙ্গ বিন্যাসে) নয়, কতো ভিন্ন ভঙ্গিতে উচ্চারণ করা যায় এই একদিন জলসিড়ি কবিতাটির পঙ্ক্তিমালা। এ এক বড় বৃত্তের মধ্যে ছোট ছোট বৃত্তের সঞ্চালন ৪, ৬, ৮, ১০, ১২ মাত্রার পর্বাঙ্গ। মৌলিকভাবে ২ এবং ৩-এর মাত্রা চোখে পড়ে ঠিকই কিন্তু লয় এমন যে আদি পয়ারের পুনরাবৃত্তি নেই, চৌদ্দ মাত্রার পরপর টেনে শ্বাসও নিতে হচ্ছে না। সন্ধ্যাসঙ্গীত-এর ঢিলে সুর এ নয়, বলাকার মুক্ত ধ্বনিও এ নয়; এটা জীবনানন্দের একান্ত নিজস্ব জিনিস। এই ধ্বনি সম্ভব হলো এইসব কারণে।
১. বিলম্বিত লয়, মানে ঢিলে উচ্চারণের সুযোগে।
২. মাত্রার মধ্যে থেকেও ড্যাশ-সেমিকোলনের যতি-স্থিতি-নীরবতার অনীরব ব্যবহারে। আকস্মিক বা হয়তো স্বাভাবিক বাকস্পন্দের বিস্ময় ও বিমূঢ়তাব্যঞ্জক ধ্বনি-ঘূর্ণিতে। ফলাফল যা হয়েছে তা যেনো দুই-তিন-চার মৌলিক মাত্রার নৌকোর সারি তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব প্রায় বিলোপ করে, মন্থর অথচ অরুদ্ধ নদীর প্রলম্বিত রেখা-ধ্বনি-গতিকে বেড়-বাঁকসমেত পাঠকের শ্রুতিপটে গুঞ্জরিত করে তুলেছে।
জীবনানন্দীয় লয় ও প্রবহমানতার একটি কৌশল অবলম্বন অথবা তাঁর প্রাতিস্বিক মেজাজ হচ্ছে যুগ্মধ্বনির উত্থান-পতনের প্রায় নিরসন। যখন কবিতাকে দ্রুততর পড়তে হবে স্বাভাবিকভাবেই যুগ্মসুর ঝংকারে দুলে উঠবে, যেমন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অথবা বিষ্ণু দে’র কবিতায় গতি শ্লথ হলেই ধ্বনির তরঙ্গ ওঠার সুযোগ কমে আসবে।
কৈশোরিক রাবীন্দ্রিক সন্ধ্যাসঙ্গীত-এ বিলম্বিত সুরের ক্ষীণ আভাস কোথাও মিললেও পর্বাঙ্গের বিন্যাসে চার ছয় মাত্রার মিলের ঝোঁক ঘুরে ঘুরে আসে। কৈশোরিক রচনা, তাই শিথিল, তবুও ঘুরে ঘুরে আসে।
জ্যেতির্ময় তীর হতে আধাঁরসাগরে
ঝাঁপায়ে পড়িলো এক তারা
একেবারে উন্মাদের পারা।
… … …
যে সমুদ্রতলে
মনোদুঃখে আত্মঘাতী
চির-নির্বাপিত বাতি
শত মৃত তারকার
মৃতদেহ রয়েছে শয়ান
[তারকার আত্মহত্যা (সন্ধ্যাসঙ্গীত)]
‘জ্যোতির্ময় তীর হতে আঁধারসাগরে’; এই ১৪ মাত্রাকে একসঙ্গে পড়ে বেগ তৈরি করা যায়। কিন্তু স্তবকের গঠন সেই ঢেউকে জিইয়ে রাখে না। কিছুক্ষণ পরেই ছোট ছোট একই মাপের বাঁধনে রুদ্ধ হয়ে পড়ে-মনোদুঃখে আত্মঘাতী, চিরনির্বাপিত বাতি শত মৃত তারকার-এই অভিরুচি বাঙলা কবিতার সঙ্গে বাঙলা গানের আদি আত্মীয়তা-সূত্রের প্রচ্ছন্ন প্রকাশ। এই কবিতার উচ্চারণে যা ঘটলো, ধ্রুবপদের অস্থায়ী অন্তরাতে একই ব্যাপার।
যোই যোই ধাবত// ইঞ্ছা ফল পাবত//
সাঁচি বিধাত করুণা সমাহার//
লাজ কি জাহাজ। শিরতাজ// গরীব নওয়াজ
গরিবন কি ইঞ্ছা ফল// পূরী হোত ইয়ে দরবার//
[মালকোষ ধ্রুপদ (তানসেন)]
এইসব পদের খেয়াল অস্থায়ী অন্তরার কাব্যোচ্চারণে মাত্রার বাঁধন প্রায়ই ঢিলে। যদিও গাইবার সময় গায়ককে লয় রাখতেই হবে। প্রথাসিদ্ধ উপায়ে স্বরবর্ণ টেনে রাগ ঠিক রেখে, অলঙ্করণ প্রয়োগ করে পাখোয়াজ তবলার সঙ্গে গায়ককে সমে ফিরতে হয়। উনিশ শতকের বাঙলা কবিতার টেকনিকের ইতিহাস প্রায় সমস্তটাই পদ-পর্ব-পর্বাঙ্গের উচ্চারণে কবিতার মাত্রার পেশিকে শক্ত করার ইতিহাস। সন্ধ্যাসঙ্গীত থেকে মানসী, চিত্রা, ক্ষণিকা কবিতার ধ্বনিবিচারে মাত্রার সঙ্গে অক্ষর এবং শব্দের অভঙ্গুর পায়ে চলবার কাহিনী। রবীন্দ্রপূর্ব কবিদের সঙ্গে তরজাওয়ালাদের সম্পর্ক আরো নিবিড়তর। এবার আবার পড়া যাক, একদিন জলসিড়ি…। লক্ষ করেছি ‘একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে’ এই পঙ্ক্তিকেই কতো বাঁটে, ভিন্ন ভিন্ন যতি টেনে পড়া যায়। এবার আমার ইচ্ছেমতো সাজাই।
একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে
এই বাংলার মাঠে
বি-শী-র্ণ বটের নিচে শুয়ে র’ব;
পশ-মের মত লাল ফল’
ঝরিবে বিজন ঘাসে।
(………………………………………………………………………………….চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (১) http://sonelablog.com/archives/23872
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (২) http://sonelablog.com/archives/23989
৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
অসাধারন।
কবিতার এমন বিশ্লেষন এই প্রথম পড়ছি আপনার লেখায়–
সাতকাহন
জিসান ভাই, তিন বছরের অক্লান্ত শ্রমের ফসল।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার পরিশ্রম স্বারথক ভাই।
শুভেচ্ছা রইল।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, মজিবর ভাই।
আবিদ রোজীনা
জীবনানন্দ আমার প্রিয় কবি। তাঁর কবিতার বিশ্লেষণ আপনার মাধ্যমে প্রথম পড়ছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
আবিদ রোজীনা, এই বিশ্লেষণ শুধু তাঁর শ্রুতিকল্প নিয়ে। পুরো জীবনানন্দকে নিয়ে কাজ করার সামর্থ আমার কখনো হবে কি না জানি না।