দেইল্লার বিলের আশেপাশের গ্রামগুলোর মানুষ আজ খুব উত্তেজিত কিন্তু নিশ্চুপ। মুক্তিযোদ্ধারা কছু খাঁ নামের এক রাজাকারকে নাকি ধরে এনেছে। মেরে ফেলবে বোধয়। এই অঞ্চলে তেমন কোন যুদ্ধ হয়নি। ফলে এখানকার মানুষের কাছে যুদ্ধ, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, হানাদার ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট না। সবই তাদের শোনা কথা। একটু দূরের নদী দিয়ে দুই একবার পাক বাহিনীর লঞ্চ গিয়েছে আর মাঝে মাঝে বিকট শব্দ করে মাথার উপর দিয়ে প্লেন যায়। বেতারের মাধ্যমে কিছু কিছু খবর পায় গ্রামবাসী। এলাকার কয়েকশো যুবক ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে এসে পাকিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তেমনই একটা টিম আজ কোত্থেকে যেন কছু খাঁকে ধরে এনেছে। এই ব্যাটা নাকি পাকিদের হেল্প করতো। কত্তবড় সাহস ব্যাটার!
বিলটা খুব ছোট। তবে এখন অথৈ পানিতে ভরা। ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধা বড় এক নৌকায় বিলের মাঝখানে। পাটাতনে হাত পা চোখ বাধা কছু খাঁ। বিলের চারপাশের বাড়িগুলোতে নারী পুরুষ সবাই তাকিয়ে আছে এই নৌকার দিকে। বোঝা যাচ্ছে কছু খাঁকে ওরা মেরে ফেলবে। কিছু মহিলা ডুকরে কাঁদছে। কেউ কেউ দোয়া দরুদ পড়ছে।
এই ছোট্ট গ্রুপটার কমান্ডার হাসমত তার সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেয়। কয়েকজন মিলে কছুকে ধরে শুইয়ে দেয় পাটাতনে। মাথাটা রাখে নৌকার কার্নিশে। হাসমত বড় এক ছুড়ি নিয়ে এগিয়ে যায়। ইচ্ছে এক কোপে কছুর গলাটা নামিয়ে দেয়া। হাসমতের হাত কাপতে থাকে। দুই তিনবার চেষ্টা করেও কছুর গলায় ছুড়ি চালাতে পারে না। এরপর অন্য আরো দুইজন একইভাবে ব্যার্থ হয়।
এই টিমেরই এক সদস্য আক্কাস জ্বরে অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই ছিল। আক্কাস বাড়ির ঘাটে বসে এতক্ষণ এসব দেখছিল। একসময় ঘাটে বাধা ছোট্ট একটা নৌকা নিয়ে বৈঠা বেয়ে আস্তে আস্তে বড় নৌকাটার কাছে যায়। বড় নৌকার সাথে ছোট নৌকাটা বেধে আক্কাস বড় নৌকাটায় উঠে পরে।
হাসমতের হাত থেকে বড় ছুড়িটা নিয়ে গালাগাল করে সহযোদ্ধাদের।
-“বাল ফালাও!?”
বলেই কছুর পাশে হাটু গেড়ে বসে আক্কাস। বা হাত দিয়ে কছুর চুল মুঠি করে ধরে ডান হাতে থাকা ছুড়িটা খুব দ্রুত চালিয়ে দেয় কছুর গলায়। ছেড়ে দেয়া ধনুকের মত ছিটকে নৌকা থেকে পানিতে পরে যায় কছু। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দে রক্ত বেরুচ্ছে। হাসমত এবার নৌকায় বসেই পানিতে থাকা কছুর গলাটা ধর থেকে মুক্ত করে দেয়। ডুবে যায় কছুর দেহটা।
বিলের তীরে দাঁড়ানো লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখে এই দৃশ্য। দুই তিনজন জ্ঞান হারায়। কেউ কেউ “জয় বাংলা ” বলে চিৎকার দেয়। কিন্তু
অধিকাংশ মানুষের চোখেই তীব্র ঘৃণা। ঘৃণ্য রাজাকার কছু খাঁর জন্য না এই ঘৃণা। এই ঘৃণা বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস দেওয়ানের প্রতি।
১৫টি মন্তব্য
সুরাইয়া পারভিন
কি জানি হয়তো আকাশের জন্য অথবা রাজাকারের জন্য। যেহেতু রাজাকার সম্পর্কে এগায়ের মানুষ এতোটা জানে না। কিন্তু আক্কাস কে এমন নৃশংস হত্যা করতে দেখে তার প্রতি এই তীব্র ঘৃণা
শিপু ভাই
সেটাই
নৃ মাসুদ রানা
মুক্তিযোদ্ধার প্রতি ঘৃণা কেন? কোন কারণ আছে কি?
সুরাইয়া পারভিন
মুক্তি যোদ্ধা হলেও প্রকাশ্যে এমন নৃশংসতা অনেকেই মানতে নাও পারে
শিপু ভাই
মানুষ চাক্ষুষ নৃশংসতা নিতে পারে না
এস.জেড বাবু
রাজাকার
যাদের কারণে নয় মাস লেগেছিলো যুদ্ধে।
ঘৃণা টা স্বাভাবিক- বিশেষ করে তখনকার ভুক্তভূগীদের কাছে।
একটা কথা মনে পড়ল- আজকাল কেউ খুন হবে এটা দেখলে চারপাশের মানুষজন মোবাইল কেমেরা চালু করত।
পরে খোঁজ নিত- সে রাজাকার না মুক্তিযাদ্ধা।
কতটা পাল্টেছে বিবেক।
চমৎকার গল্প।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ
ছাইরাছ হেলাল
রাজাকারের নৃশংসতা দেখেনি, হত্যা দেখেছে শুধু।
শিপু ভাই
ঠিক
জিসান শা ইকরাম
যারা ১৯৭১ এর যুদ্ধে ভুক্তভোগী নয়, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ তেমন কোন ঘটনা নয়,
গল্পে গ্রামের মানুষ রাজাকার, পাকিদের নৃশংসতা দেখেনি,
তারা দেখলো এক মুক্তিযোদ্ধা একজন মানুষকে খুন করেছে, তাই মুক্তিযোদ্ধার প্রতিই ঘৃণা প্রদর্শন।
এরা যদি রাজাকার পাক সেনাদের তান্ডব দেখতো, তাহলে সবাই আনন্দে চিৎকার করত।
নিয়মিত লিখছো দেখে ভালো লাগছে।
শুভ কামনা।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ মামা
মনির হোসেন মমি
বিষয়টা আজকের প্রেক্ষাপটকেও মনে করিয়ে দেয়। রাজাকারদের যখন এ দেশে ফাসিঁ হয় তখন একশ্রেণী মানুষ নারাজ ছিলেন । কিছু রাজাকারদের ৭১এর পৈশাসিকতা সব দেখে জেনে শুনে কিছু এ নতুন প্রজন্ম যারা শুনেছে কেবল চোখে দেখেনি।ধর্মান্ধতায় তারা বিভোর ছিলেন।আপনার এ গল্পটিও হয়তো তেমনি।
এটা আমাদেরই ব্যার্থতা আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভয়ংকর দিকগুলো সঠিক বহুল ভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি।আর যারা বুঝেছেন রাজাকাররা কোন হারামীর জাত তারা আনন্দে মেতেছেন।
নিয়মিত হচ্ছেন দেখে ভাল লাগছে প্রিয় ভাইটি।
শিপু ভাই
ধন্যবাদ ভাই
সাবিনা ইয়াসমিন
নিশংস হত্যাকান্ড চোখের সামনে ঘটতে দেখলে মানুষ হত্যাকারিকেই ভয় পায়, ঘৃণা করে। আক্কাস মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেনাদের বর্বর নিশংসতা নিজে প্রত্যক্ষ করেছে, তাই জবাই করতে তার হাত কাঁপেনি। কিন্তু যারা যুদ্ধ দেখেনি, নিজেদের ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি তারা কিভাবে জানবে? তারা দেখেছে একটা মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, আদতে সে যে নরপশু ছিলো তার ইতিহাস অনেকের কাছেই অজানা।
শুভ কামনা 🌹🌹
শিপু ভাই
আপনার জন্যও শুভকামনা