
“ক্ষুধার্তের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমাকে কখনোই কষ্ট করতে হয়নি। কারণ আমি খুব ছোটবেলা থেকে নিজের জীবন থেকেই জানতাম ক্ষুধা কি জিনিস।”
কথাগুলো চ্যাপলিন তাঁর নিজের লেখা “মাই অটো” বায়োগ্রাফিতে লিখেছেন।
তাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল ইংল্যান্ডে। মা হানা হিল ছিলেন পেশাদার একজন থিয়েটার কর্মী। বাবা, চার্লস চ্যাপলিন ছিলেন নাট্যশিল্পী। চার্লির জন্মের পর তাঁর বাবা ১৮৯০ সালে আমেরিকা যান শো করতে। সেখান থেকে তিনি আর ফেরেননি। বলা যায় জ্ঞান হবার পর চার্লি বাবার স্নেহ পাননি। তবে মায়ের স্নেহ ছিলো অফুরান।
প্রচণ্ড অভাব আর কষ্টের মধ্যে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে লন্ডন এর ঘুপচি ঘরে থাকতেন। একদিনকার কথা, চার্লির বয়স ৫/৬। মায়ের সাথে থিয়েটারে এসেছিলেন। সেদিন হানা একটু অসুস্থ ছিলেন। গান চলার সময় হঠাৎ তার গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস শব্দ হয়, সুর আসছেনা। দর্শক ব্যঙ্গ করছে। থিয়েটারের ম্যানেজার জোর করে চার্লিকে মঞ্চে উঠিয়ে দেন। গান গেয়ে দর্শকদের মন মাতিয়ে দেন। অনেকটা যুদ্ধ জয়ের মতো তাদের মন জয় করেন।
তাঁর ছোটবেলা কেটেছিলো যুদ্ধের মতো। সেই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জ্যাক লন্ডন তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে বলেছেন, “চার্লি ছিলেন এমনই এক বালক যার বাল্যকাল বলে কিছু ছিলো না!”
চার্লির জীবনে আর একজনের ছায়া ছিলো। তিনি তাঁর সৎ ভাই সিডনি। চার্লি বলেছেন, ” তিনিই মা, তিনিই বাবা।” সিডনি ছিলো হানা হিলের আগের স্বামীর সন্তান।
চার্লি বলেছেন, ” তাঁর জীবনে এতো সংকট এসেছে যে, এটা তাঁর জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। এনন সময় গেছে তাঁদের আয় নেই কিন্তু বাঁচার জন্য টাকা চাই।
দুই ভাই ভর্তি হয়েছিলেন স্কুলে। বেশিরভাগ দিন কাটতো আধপেটা। কোনো কোনো দিন গীর্জার স্যুপ খেয়ে রাত পার করেছেন।
চার্লির ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়, জীবন যুদ্ধের যে অভিজ্ঞতা চার্লি অর্জন করেছেন, ছবিতে এরই ব্যবহার করেছেন আজীবন।
তাঁর ছবির বাস্তবতা সম্পর্কে এক সমালোচক প্রশ্ন করলে, তিনি বলেছিলেন, ” ক্ষুধা কী তা আমাকে বই পড়ে শিখতে হয়নি। এ আমার জীবনের শিক্ষা। ”
সবমিলিয়ে বছর তিনেক লেখাপড়া করেছেন। ফুল বিক্রি থেকে গৃহ পরিচারক। পেটের দায়ে হেনো কাজ তিনি করেননি।
জানালার পাশে বসে হানা রাস্তার মানুষ দেখতেন এবং চলার ভঙ্গি ও মুখ দেখে বলতে পারতেন লোকটির মানসিক অবস্থা। পরে তিনি নিঁখুতভাবে লোকটির অনুকরণ করতেন। চার্লি মাকে দেখেই শিখে ফেলতেন মুকাভিনয়।
তাঁদের স্কুলে যাওয়া ছিলো বিলাসিতা। তাই মা, ছেলেদের সব দুঃখ ভুলিয়ে রাখতে অভিনয় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন বাসায়। মা বলেছিলেন, “শেখো আর মজা করো!” গিন্জি পরিবেশে থেকেও চার্লির ভাষা কখনো বদলায়নি। কখনোই অশ্লীল ভাষায় কথা বলেননি। উনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ” আজ আমি যা কিছু করছি সব মায়ের শিক্ষার ফল।”
কেনিংটনের রাস্তার ধারে চার্লি ও সিডনি তাদের নাচ ও গানের চর্চা করতেন। এটা ছিলো টাকা আয়ের একটা পথ। এইসময় ল্যাংকাশয়ার ল্যাডসের মালিকের নজরে আসেন। তিনি ছয় সপ্তাহ তাঁকে প্রশিক্ষণ দেন। এবং দর্শকদের সামনে প্রথমদিনেই বাজিমাত করেন। এর মাঝে চার্লি ব্ল্যাক মোর থিয়েটারে নিবন্ধন করলেন। তাঁর পারদর্শিতা দেখে পরিচালক অবাক হলেন। আর চার্লি ও বুঝলেন, ” অভিনয়ের চেয়ে আনন্দদায়ক কাজ তাঁর কাছে আর কিছু নেই।”
১৯০৮ সালে বীরদর্পে মঞ্চে ফিরে এলেন। প্রতিটি মঞ্চই সফল। নাটকের শুরুতে দর্শক সেই যে হাসা শুরু করলো। বাসায়ও ফিরতেন হাসতে হাসতে।
১৯১০ সালে পা রাখলেন আমেরিকায়। আর দুই বছরের মাথায় জনপ্রিয় হয়ে গেলেন। প্রচুর পড়াশোনা করলেন চলচ্চিত্র, নাটক নিয়ে। প্রতিটি শো ই হাউসফুল।
১৯১৪ সাল। সে সময়ের সিনেমা মানে এক অথবা দুই রিলের। ছবির দৈর্ঘ্য ১০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা। তাঁর প্রথম ছবি “অ্যা লিভিং”। সারাজীবন তিনি ৮১ টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পাঁচটিতে নিজে পরিচালক ছিলেন যৌথভাবে। বাকি ১৫ টির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা ছিলো নিজেরই।
চার্লির করা প্রথম ছবি ” কট ইন দ্যা রেইন”। অভিনয়ও করেছেন নিজে। নিজেকে উজাড় করে দিলেন। দর্শক ভাবলো, এতো নিজের কথা। তাঁর বানানো, দ্যা ব্যাংক, চার্লি দ্যা ওয়ার্ক বিখ্যাত। “দ্যা কিড” ছবিটিতে তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ” যুদ্ধ সবচেয়ে ক্ষতি করে সাধারণ মানুষদের।”
ছোট খাটো এই মানুষটি সেই ১৪/১৫ বছর থেকে টানা ৮৮ বছর নীরবে বলে গেছেন নানা না বলা কথা। জীবনভর তিনি তাঁর ছবিতে বলে গেছেন, মানুষ হয়ে মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ানো কঠিন। এর চেয়ে মানুষকে ভালোবাসা অনেক সহজ। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এই কাজটি করে না। হতদরিদ্র থেকে তিনি মিলিয়নিয়র হয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে অসুস্থ হয়ে পরেন। তখন তাঁর বয়স ৮৮। বড়দিনের আগের রাতে শেষবারের মতো ঘুমাতে গিয়েছিলেন। অবসান হয়েছিলো চার্লি শতাব্দীর।
সবমিলিয়ে চার্লি নামটি একজন সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে সততার সঙ্গে সাফল্যের দিকে যেতে হয়।
২১টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
ভীষণ ভালো লাগলো লেখা ।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ
ছাইরাছ হেলাল
তাঁর অনেক ছবি দেখেছি কিন্তু তাঁকে জানা হলো আপনার লেখায়।
অনেক ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
ভালো লাগলো।
শুভকামনা
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনার লেখনীতে তাকে জানলাম নতুন করে। খুব ভালো লেগেছে আপনার সুন্দর বর্ণনা। ভালো থাকবেন। শুভ সকাল আপু
আরজু মুক্তা
শুভকামনা আপি
তৌহিদ
চার্লি চ্যাপলিন একটি আদর্শ চরিত্র। আজ আপনার সুনিপুণ লেখায় সেটি আরও একবার প্রমাণ হলো। সুন্দর পোষ্ট আপু।
আরজু মুক্তা
শুভেচ্ছা অবিরাম
সুপায়ন বড়ুয়া
ক্ষুধা যার নিত্য সঙ্গী তাকে ক্ষুধার জন্য অভিনয় শিখতে হয় না। এই অপ্রিয় সত্যটা চার্লি ই বলেছিলেন।
ভাল লাগলো একজন জাত শিল্পীকে তুলে আনার জন্য।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা জানবেন ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
কালজয়ী চার্লি চ্যাপলিনকে ভিন্নরুপে জানা হলো আপনার অবদানে। ধন্যবাদ সহ শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ আপি
পার্থ সারথি পোদ্দার
শৈশব থেকেই এই মহান মানুষটির কথা শুনে আসছি।তবে আজ উনার সম্পর্কে বেশ অজানা কথা জানলাম আপনার লেখনির মধ্য দিয়ে।খুব ভালো লিখেছেন।ধন্যবাদ,আপু।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই।
অনপ্রাণিত হলাম।
হালিম নজরুল
“ক্ষুধার্তের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমাকে কখনোই কষ্ট করতে হয়নি। কারণ আমি খুব ছোটবেলা থেকে নিজের জীবন থেকেই জানতাম ক্ষুধা কি জিনিস।”
—–প্রারম্ভিক কথাই আমাদেরকে অনেককিছু শিখিয়ে দেয়।
আরজু মুক্তা
একদম। ঠিক বলেছেন।
ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
” ক্ষুধা কী তা আমাকে বই পড়ে শিখতে হয়নি। এ আমার জীবনের শিক্ষা। ” – জীবনের শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা।
এমন লেখা আরো চাই।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
লেখা রেডি। নতুন নতুন আসবে।
শুভকামনা, দাদা
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
এই মানুষটা সম্পর্কে জানার আগ্রহ বহুদিনের। অনেক সুন্দর উপস্থাপন। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনার আগ্রহ পূরন হলো নিশ্চয়
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
জি৷ অনেকটাই।