‘মুখ ও মুখোশ’ প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে ঢাকায় ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল। এতে নানা চরিত্রের উপস্থাপনায় চলচ্চিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। যেমন এ ছবিতে ডাকাত চরিত্রে ইনাম আহমেদের দুর্দান্ত অভিনয় এখনো দর্শকমনে শিহরণ জাগায়।

একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো- নানা-নানী, দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। আর এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এতে দর্শক কোনো না কোনোভাবে নিজেদের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র খুঁজে পেয়ে আহ্লাদে ছবিটি উপভোগ করত। এ কারণেই ৫০ থেকে আশির দশকের চলচ্চিত্রের ছিল সোনালী সময়। যা এখন নেই বললেই চলে।

দর্শক নন্দিত কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিঃ
=========================
এক সময় ফোক, নারীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিত্র, প্রেম, গ্রাম্য মোড়লের আধিপত্য থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণের মাধ্যমে দর্শকের মনে চলচ্চিত্রকে চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হতো।
নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত হলেও এখানে পরিবারের বিভিন্ন চরিত্র মর্মস্পর্শীভাবে তুলে ধরা হয়েছিলো। ছবিতে আলোরূপী ববিতা ছিল নানা নারায়ণ চক্রবর্তীর আদরের নাতনি। যে কিনা ভোরে জেগে সবার মুখে চা তুলে দিয়ে ঘুম ভাঙাত। একসময় যুদ্ধের দামামা প্রাণ কেড়ে নেয় আলোর। এ ছবিতে আলো তার প্রাণ দিয়ে নতুন করে দেশ গড়ার মিছিলের অনুপ্রেরণা জোগায়।

চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি হলেও এই ছবিতে কয়েকটি পরিবারের যন্ত্রণার চরিত্র স্থান পায়।

সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একজন বীরাঙ্গনা নারীর গল্প বলে থেমে যায়নি। এখানে সাংবাদিকরূপী আনোয়ার হোসেনের বিবেকের দহন দর্শকের মন পুড়িয়েছে।

খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ শুধু একটি ছবি ছিল না, এটি ছিল সমাজ সংস্কারের দর্পণ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় অভাব-অনটনে পোড়-খাওয়া সমাজে হতাশ মুক্তিযোদ্ধারা যখন অপরাধ করতে অস্ত্র হাতে তুলে নেন তখন তাদের কলেজের অধ্যক্ষ খান আতাউর রহমান তাদের মানুষ হওয়ার মন্ত্রণায় দীক্ষিত করে হতাশামুক্ত করে।

গ্রাম্য কুসংস্কার ও মোড়লের অত্যাচারঃ
========================
এক সময় আমজাদ হোসেন এগিয়ে এলেন গ্রাম্য কুসংস্কার আর মোড়লের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক তরুণের প্রতিবাদী গল্প নিয়ে। এ ছবিতে জাঁদরেল মোড়লরূপী এ টি এম শামসুজ্জামানের দুর্ধর্ষ অভিনয়ের কথা এখনো ভুলেনি দর্শক।
ছবির নাম ‘নয়নমণি’।
কঠিন জীবনযাত্রার গল্পে নির্মিত এই ছবিতে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে হালকা করতে কৌতুক চরিত্রে নির্মাতা হাজির করেন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদকে।

আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নারীর দুঃখপ্রধান চলচ্চিত্র হলেও এখানে মোড়লের অত্যাচার, সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র দর্শকদের এসব বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই ছবিতে জীবন সংগ্রামে পোড়-খাওয়া তিন নারী রওশন জামিল, আনোয়ারা ও ববিতার চরিত্রকে মর্মস্পর্শীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

একইভাবে এই নির্মাতার ‘ভাত দে’ ছবিটিতে সমাজপতি মজুদদাররূপী খলঅভিনেতা রাজীবের অনবদ্য অভিনয় কখনো ভুলার নয়। একই সঙ্গে ছবির নায়িকা শাবানার বাবারূপী গায়েন চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের অসহায় জীবন কাহিনী দর্শকের অশ্রু ঝরিয়েছে। সেরা শিশুশিল্পীর সম্মাননা পায়। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে স্বৈরাচার শাসকের প্রতীকী চরিত্রে অসাধারণ হয়ে ওঠেছেন রওশন জামিল।

আর স্বৈরাচারের হাতে নিষ্পেষিত জনতার আরেক প্রতীকী চরিত্রের নাম ছিল খান আতাউর রহমানের হৃদয় টলানো অভিনয়। যে কিনা এই দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য লুকিয়ে গেয়ে চলেন ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’।

কামাল আহমেদের ‘অশ্র“ দিয়ে লেখা’, ‘পুত্রবধূ’, ‘অনুরাগ’, ‘উপহার’, নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’, কাজী জহিরের ‘বধূ বিদায়’ ‘ময়নামতি’, ‘মধূমিলন’, সাইফুল ইসলাম কাশেমের ‘সোহাগ’, ঘর সংসার, বৌরানী ছবিগুলোতে প্রেম, পরিবার, বিনোদন দর্শকদের বিমোহিত করেছে। নায়করাজ রাজ্জাকের ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বদনাম’, ‘সৎভাই’, ‘চাঁপাডাঙার বউ’, ‘বাবা কেন চাকর’সহ তার নির্মিত ছবির গল্প ও চরিত্র এখনো সমাজ আর পরিবারের কথা বলে।

আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ ছিল নিরক্ষতার অভিশাপমুক্ত হওয়ার গল্পে নির্মিত ছবি। এখানে ছোট্ট শিশু মাস্টার সুমন গ্রামের লেখাপড়া না জানা রহমত (রাজ্জাক) দারোয়ানকে অক্ষরজ্ঞান শিখাতে যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তা সত্যিই শিক্ষণীয়। মতিন রহমানের ‘লাল কাজল’ ছবিটিতে সন্তানের জন্য একজন মায়ের হাহাকার তীব্র হয়ে ওঠেছে। এখানে মা চরিত্রে শাবানার অনবদ্য কাজ এখনো দর্শকের অশ্রু ঝরায়। আশির দশক পর্যন্ত এ জাতীয় সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র প্রচুর পাওয়া গেছে। এই সকল ছবিগুলি বক্স অফিস হিট হবার পিছনে পার্শ্বচরিত্র অভিনেতারাই ছিলো মূখ্য ভূমিকায়।

ছবির মূল হলো পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতাঃ
=========================
চলচ্চিত্রে অনেক দিন ধরেই পার্শ্বচরিত্রের অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে। পার্শ্বচরিত্রের ক্ষেত্রে প্রথমেই বাবাদের কথা বলতে হয়। একটা সময় সিনেমার চিত্রনাট্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাবার চরিত্র। পর্দায় দাপুটে বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফতেহ লোহানী, খলিল, গোলাম মুস্তাফা, শওকত আকবর, নারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখ। আদর্শবাদী বাবার ভূমিকায় মানানসই ছিলেন আনোয়ার হোসেন, প্রবীর মিত্র, রাজ্জাক, আলমগীর, খান আতা। বাবার মতো মায়ের চরিত্রও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কখনো কখনো নায়ক-নায়িকাকে ছাপিয়ে ‘মা’ হয়ে যেতেন গল্পের মধ্যমণি। অনেকে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। দরিদ্র-খ্যাপাটে, মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন রানী সরকার। তেমনি সাদাসিধা মধ্যবিত্ত পরিবারের শহুরে মা কিংবা গ্রামের মায়ের ভূমিকায় মিনু রহমানের অভিনয় ছিল অনবদ্য।

খলনায়িকারা ছিলো ছায়াছবির প্রাণঃ
======================
মায়া হাজারিকাঃ
*
নায়িকা হবার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে মায়া হাজারিকার। যানপরণাই চেষ্টা করেও তিনি নায়িকার জায়গাটি দখলে আনতে পারেন নাই। সেই সময়কার পরিচালকরা মায়া হাজারিকাকে খলনায়িকা হিসেবে অভিনয় করতে মনস্থির করেন। মূল কারন ছিল, তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ও চেহারায় ফুঁটে উঠা দূর্ধর্ষ নারীর ছাপ। দেহের গড়ন ও চলাফেরায় ছিলো খলনায়িকা হবার যোগ্যতা। যে কারনে তিনি বাধ্য হয়ে নায়িকা হবার স্বপ্ন থেকে সরে আসেন। বেঁছে নেন খলনায়িকার চরিত্র। পরবর্তীতে খলনায়িকা হয়ে তার অভিনয় জীবনের সফলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পর্দায় মায়া হাজারিকার চরিত্র আসা মাত্রই হলের ভিতর দর্শকরা নিন্দার ভাষায় উচ্চ স্বরে কটাক্ষ করতো। স্বামীর পাশে বসে থাকা বধুটিও ছবির শেষ পর্যন্ত আতংকে থাকতো ভাঙ্গা-গড়ার শেষ পরিনতি কি হয় তা দেখার জন্যে। কোন কূটচালে কার প্রেমের সর্বনাশ বা কোন বধুকে স্বামীর সংসার থেকে বিতাড়িত হতে হবে তা দেখার জন্য ভারাক্রান্ত মনে অস্থির থাকতো। পর্দায় অভিজাত পরিবারে শ্বাশুড়ি বা কোন পতিতালয়ের সর্দরনীর ভুমিকায়ও তাঁর অভিনয়ে দক্ষতা ছিলো। পুরুষ জাতকে তটস্থ থাকতে হতো তার নির্দেশনায় ভাঙ্গা-গড়ার খেলায়।
খলনায়িকা চরিত্রে তাঁর প্রথম ছায়াছবি “নয়নতারা” মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। প্রথম ছবিতে তিনি খলনায়িকার চরিত্রের অভিনয়ে বাজিমাত করেন। তারপর থেকে মায়াহাজারিকাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।

আবার অভিজাত ঘরের অহংকারী মায়ের চরিত্র মানেই ছিলেন মায়া হাজারিকা। কূটচাল, ষড়যন্ত্র এবং ছবির শেষে বরাবরই নিজের ভুল বুঝতে পারা রুপালি পর্দার মা ছিলেন মায়া হাজারিকা। ছায়াছবিতে মায়া হাজারিকা কূটচরিত্র অভিনয় দিয়ে ফুঁটিয়ে তুলতেন। যার জন্য অভিনয় জগতের বাহিরেও তাঁকে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। অনেক নববধু ও প্রেমিক-প্রেমিকার চোখে তিনি ছিলেন বিরাগভাজন। বাস্তব জীবনে কোন অনুষ্ঠানে কারো সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র মা-খালা, বউ-ভাবী,প্রেমিক-প্রেমিকারা ভ্রু কুঁচকে অন্য দিকে দৃষ্টি আড়াল করতো। আর এখানেই অভিনয় জীবনের সফলতা পেয়েছিলেন মায়া হাজারিকার।

শুধু খলনায়িকা নয়। বাংলার স্নেহময়ী মায়ের চরিত্র পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্যও মায়া হাজারিকা ছিলেন অনবদ্য। সারল্য, মমতা, সন্তানের জন্য আকুতির ক্ষেত্রে অনবদ্যভাবে মায়ের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতেও তার বিকল্প ছিল না। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারীনি। যা একজন গুনী মানুষের মাঝে খুব কমই দেখা যায়।

তিনি ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের কয়েক দশক ধরে রওশন জামিল মন্দ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন। ইহা ছাড়া রহিমা খালা, সুমিতা দেবী, রিনা খান, দিলারা জামান, মিরানা জামান, সুলতানা জামান সহ অনেকেই খলনায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক ভালোবাসা ও জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। আনোয়ারা ও রোজী সামাদের কথা নাই বা বললাম। সিনেমা শুধু নায়ক-নায়িকার খাতিরেই হিট হয় না। পার্শ্বচরিত্রগুলোও শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।

ব্যাক্তিগত জীবনঃ
===========
মায়া হাজারিকা ১৯৬৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। তাঁর স্বামী সিরাজুল ইসলাম পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন।পাকিস্তান আমলে সিরাজুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের প্যাট্রল ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ১৯৭৫ সালে অবসর গ্রহণের সময় তিনি সহকারী পুলিশ সুপার ছিলেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনে জাবেদ ও জমশেদ নামে দুইজন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ২০০৯ সালে এই গুনী শিল্পী দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে নিজের ভুবনে
আমাদের ছেড়ে চলে যান।
(তথ্যগুলি এফডিসির জার্নাল থেকে সংগ্রহ)

দর্শক কেন হল বিমুখঃ
==============
হাল ছবিতে গল্প আর চরিত্রের সংকট। এখন ছবিতে খলনায়িকা তো দূরে থাক নানা-নানী, দাদা-দাদি মা- বাবাই থাকে না। কমেডির নামে ভাঁড়ামি আর জোর করে দর্শক হাসানোর অপচেষ্টা চলে। আগে কমেডিয়ানরাও ছিল রীতিমতো তারকা। ছবিতে চরিত্র কমে গেছে। একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আর একজন খলনায়ক ও আইটেম গান থাকলেই নাকি ছবি হয়ে যায়। এসব ছবি দর্শক কখনো গ্রহণ করবে না। এখনকার ছবিতে গল্প তো নেই-ই, চরিত্র থাকবে কীভাবে। বর্তমানে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছেন তাতে যাপিত জীবনের চরিত্র নেই। এসব চরিত্র, গল্প ও জীবনবোধের ছায়াহীন ছবি দেখতে দর্শক কেন হলে যাবে।

৫০ দশক থেকে ৮০ দশকের দর্শকরা এখনও মায়া হাজারিকাকে তাঁদের মননে গেঁথে রেখেছে। প্রায় ২৫০ অধিক ছায়াছবিতে খলনায়িকার চরিত্রে মায়া হাজারিকা তাঁর অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয়ে যে স্থান দখল করেছেন তা কেউ মুঁছে ফেলতে পারবে না। যতদিন এই দেশে চলচ্চিত্র থাকবে ততদিন মায়া হাজারিকা দর্শকের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবে।

আমি মরহুমার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
সবাই ভালো থাকুন।

১৭৬৬জন ১৫৭২জন

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ