জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে অধিকাংশ ফটোগ্রাফার ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের আড়ারকুল গ্রামে দলে দলে পাখির ছবি তুলতে যায়। সময়টা ছিলো ২০১৮ সাল। ঢাকায় বসবাসকারী এমনকি বাহিরের জেলা থেকেও ফটোগ্রাফাররা এসে পাখিটির ছবি তুলে নিয়ে যায়। তখন কাজের ব্যাবস্তার দরুন আমি সময় দিতে পারিনি। যখন সময় হলো তখন পাখিটির ছবি সবার তোলা হয়ে গেছে। কাউকে বলতেও পারি না সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কারন অধিকাংশ সময় আমি একা একাই ফটোগ্রাফী করি। একা ফটোগ্রাফীতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তার মূল কারন দুটি। প্রথমত নিজের মতন করে ছবি তোলা য়ায়। যতক্ষন খুশী ততক্ষন সময় দেয়া যায়। কেউ সঙ্গে থাকলে তারা ভাল কোন শট পাবার পর দ্রুত স্থান ত্যাগ করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠে। এমন আচরনে আমি বিরক্ত বোধ করি। দ্বিতীয়ত কারন হলো আমি কখনই পছন্দ করি না একই ধরনের ছবি,কম্পোজিসন,ফ্রেম ও ব্যাকগ্রাউন্ড সবার এক হোক। তাতে ছবির কোন আকর্ষন ও মান থাকে না। এটা সম্পূর্নই আমার নিজস্ব দর্শন বা চিরত্র বলতে পারেন।
যাহা হোক, আমার অত্যন্ত আদরের পুত্র সমতুল্য ছোট ভাই বণ্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফের কাছ থেকে কেরানীগঞ্জের লোকেশনটা জেনে নেই। আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে, যদি সেই গ্রামে পৌছতে পারি তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করলেই তারা পাখিটির অবস্থান দেখিয়ে দিতে পারবে। এটা আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা। যেহেতু পুরা জানুয়ারী মাস জুড়ে ছোট্ট একটি গ্রামে শখের ছবিয়ালরা দল বেঁধে পাখির ছবি তুলছে, সেহেতু সেই গ্রামে এই পাখিটি সকলের নজরে চলে এসেছে। সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে সঠিক গ্রামে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে ১২ বছরের এক বালক আমার হাতে ক্যামেরা দেখে প্রশ্ন করে।
বলে, লাল গলার পক্ষীর ফুডু তুলতে আইছেন কাকা?
আমি খুশীতে আত্মহারা হয়ে বললাম তুমি কি বাবা সেই জায়গাটা চেনো?
বালকটি চলে যাবার ১০ মিনিট পর টার্কি মুরগীর খাবার ধানের কুঁড়ার উপর পাাখিটি উড়ে এসে বসলো। আমার দুই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। জীবনের প্রথম পাখিটি দেখলাম। পাখিটি সম্পর্কে পক্ষী বিশারদদের বইয়ে বহুবার পড়েছি। তারপর থেকেই পাখিটির প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ি। অনেক্ষন তাকিয়ে রইলাম। নয়ন জুড়ে পাখিটির গলা দেখলাম। তারপর ক্যামেরাা শাটার চাপা শুরু করলাম। জীবনের এই প্রথম কোন একক পাখির জন্য ৩২০০ শাটার ব্যাবহার করি। প্রায় ৬৮জিবি ছবি তুলি।
সাইবেরীয় চুনিকণ্ঠী বাSiberian rubythroatপাখিটি উত্তর এশিয়ার খুবই পরিচিত একটি ছোট পাখি। শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। এরা পরিযায়ী পাখি। আমাদের দেশে মূলত খাদ্য সন্ধানে আসে। এখানে তিন থেকে চার মাস অবস্থান করার পর প্রজননের জন্য আবার চলে যায় নিজ আবাসে। এরা মূলত ঠান্ডা থেকে দূরে থাকতে চায়। যার জন্য শীত মৌসুমে পরিযায়ী হয়ে বিভিন্ন দেশে চলে আসে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার ও আশেপাশের দেশগুলোতেও এ পাখি দেখা যায়। তবে আমাদের দেশের জন্য সাইবেরীয় চুনিকণ্ঠী বিরল পরিযায়ী একটি পাখি। অনেকের কাছে পাখিটি ‘লাল গলা বা গুম্পিগোরা’ নামেও পরিচিত।
পাখিটির দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। প্রসারিত ডানা ২২-২৫ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির চেহারা ভিন্ন। পুরুষ পাখির গলার মাঝখানে উজ্জ্বল লাল রঙের। যা পাখিটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। উপর-নিচে স্পষ্ট চওড়া সাদা টান। অপরদিকে স্ত্রী পাখির গলা অস্পষ্ট সাদাটে ও বেগুনী রেখা। উভয়ের মাথা, পিঠ ও লেজ জলপাই-বাদামি। লেজ ঊর্ধ্বমুখী। লেজতল সাদাটে। বুক ধূসর। পেট জলপাই-বাদামির উপর অস্পষ্ট সাদাটে। ঠোঁট কালো, গোড়ার দিকে ফ্যাকাসে। চোখ কালো। পুরুষ পাখির ভ্রু-রেখা স্পষ্ট সাদা, গলা চুনি লাল, থুতনির পাশে কালো টান থাকে। মেয়ে পাখির গলা সাদা কিংবা বেগুনি। মূলত পুরুষ পাখিটির গলা চুন্নি পাথরের মতো লাল টকটকে হওয়ায় বাংলায় চুনিকণ্ঠী নামকরণ হয়েছে।
এদের প্রধান খাবার পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ। এরা ময়লার স্তুপ বা জমে থাকা লতাপাতা থেকে ঠোঁট দিয়ে খাবার খুঁজে খুঁজে খায়। প্রজনন মৌসুম মে থেকে আগস্ট। বাসা বাঁধে সাইবেরিয়ার তাইগ্যা অঞ্চলে। সরাসরি ভূমিতে ঘাস, তন্তু, চিকন ডালপালা ও চুল পেঁচিয়ে বাসা বানায়। এরা ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৪ দিন। বাচ্চা ফুটে উড়ে যেতে আরো সময় লাগে দুই সপ্তাহ। প্রজননের পর থেকে মোটামুটি ৪৫ দিনের মাথায় এরা বংশবৃদ্ধি করে প্রকৃতিতে মিশে থাকে।
বাংলা নাম: সাইবেরীয় চুনিকণ্ঠী ইংরেজি নাম: Siberian rubythroat বৈজ্ঞানিক নামঃ Luscinia Calliope
ছবিগুলো ঢাকার দক্ষিণ কেরনীগঞ্জের আঁড়ারকূল গ্রাম থেকে তোলা।
অনবদ্য এক পোস্ট দিলেন ভাই, পাখিটি সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ ছিলো, সত্যি আশ্চর্যের যে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এই ছোট্টো পাখিটা এই দেশে আসে।
ধন্যবাদ পোস্টটির জন্য।
ভাবতে অবাক লাগে ছোট্ট এই পাখি এতটা পথ পেরিয়ে এখানে আসে!!
৩২০০ শাটার !! কঠিন !! হ্যা জীবনে বারেবারে এটি হবার নয়। এক শাটার কত এম বি তে রাখেন!
মনকাড়া সুন্দর পাখিটি দেখানোর জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ।
১৮টি মন্তব্য
ইঞ্জা
অনবদ্য এক পোস্ট দিলেন ভাই, পাখিটি সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ ছিলো, সত্যি আশ্চর্যের যে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এই ছোট্টো পাখিটা এই দেশে আসে।
ধন্যবাদ পোস্টটির জন্য।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা ভাই
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ফটোগ্রাফীর খুঁটি নাটি বিষয়গুলো খুব চমৎকার ভাবেই বলেছেন। প্রথম প্যারাটা দারুন বলেছেন। সবার জন্য ই প্রযোজ্য এই থিউরি গুলো। পাখিটির ছবি তুলতে ৬৮ জিবি জায়গা খরচ করেছেন! ৩২০০ শাটার স্পিড! অসাধারণ ভাইয়া । সাইবেরীয় চুনিকন্ঠী ধন্য তুমি। আপনার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন
শামীম চৌধুরী
অনেক ধন্যবাদ দিদিভাই।
আরজু মুক্তা
অসাধারণ।
পাখি ভাই আপনার জন্য শুভকামনা
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও শিভ কামনা কইলো আপু।
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও শুভ কামনা রইলো মুক্তা আপু।
ছাইরাছ হেলাল
ভাবতে অবাক লাগে ছোট্ট এই পাখি এতটা পথ পেরিয়ে এখানে আসে!!
৩২০০ শাটার !! কঠিন !! হ্যা জীবনে বারেবারে এটি হবার নয়। এক শাটার কত এম বি তে রাখেন!
মনকাড়া সুন্দর পাখিটি দেখানোর জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
অবাক হবার মতনই ভাই। তবে এটাই হলো পরিযায়ী পাখিগুলোর জীবন বাঁচানোর পদ্ধতি।
এক শাটারে আমি ২১.৮ এমবি রাখি। “র” ফরম্যাটে।
সাবিনা ইয়াসমিন
পরিযায়ী পাখির তালিকায় এত ছোট্ট পাখিও আছে! এদের উড়ার ক্ষমতা জেনে অবাক হলাম। সুন্দর পরিশ্রমী পাখিটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। আপনার পরিশ্রম সার্থক হোক, শুভ কামনা 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।
প্রদীপ চক্রবর্তী
দাদা আপনি সবসময় সেরা।
আর এত সুন্দর সুন্দর পাখির সন্ধান কিভাবে পান?
সত্যিই প্রকৃতি আপনাকে বেশ ভালোবাসে তাই আপন করে নিয়েছে।
পাখিটির পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সাধুবাদ জানাচ্ছি।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ দাদাভাই। শুভ কামনা রইলো।
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর পাখি শামীম দা
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো কবি দা।
তৌহিদ
পাখির নামটাও যেমন সুন্দর দেখতেও তেমন সুন্দর। চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ ভাই।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো ভাই।