এই সময়েই ঘরের মুলিবাঁশের বেড়ায় মড়মড় শব্দ ওঠে। মনে হয় যেন কোনও বুনো শেয়াল বেড়া ভেঙে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। লোকটা চমকে পেছন দিকে তাকাতেই রামদা হাতে দু’টো লোক বেড়া খুলে মুহূর্তেই ঘরে ঢুকে পড়ে। লোকটা দৌঁড়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। বাইরে থেকে শিকল তোলা। বেরুতে না পেরে সে স্থবির ভাস্কর্যের মত দরজার কাছেই বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখ ফ্যাকাশে। দেহ থর থর করে কাঁপছে। হ্যারিকেনের আলোয় একটা কালো বেড়ালের মত এক কোনায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রহমত। তারা দেরি না করে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক ধাক্কায় সে মেঝেতে পড়ে যায়। সেই ফাঁকে সালেহা ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে এক ঝটকায় বাইরে বেরিয়ে যায়। রহমত আর রহমতের মেজো ভাই সরাফতের চোখে-মুখে জিঘাংসার আগুন। আধো আলো-অন্ধকারে চারটি চোখ কাচের মার্বেলের মত ঝকঝক করছে। রহমত দেরি না করে বাম হাতে কোমর থেকে নতুন গামছাটা এক ঝটকায় বের করে আনে।
ভয়ে লোকটার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বের হতে থাকে। রহমত গিয়ে একপা দিয়ে বুকের ওপর চেপে ধরে খুব দ্রুত লোকটার গলায় নতুন গামছাটার একদিক ফাঁসির দড়ির মত পেচিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সরাফত রহমতের সামনে চলে আসে।
লোকটা আর্তনাদ করে বলতে থাকে, ‘আমারে বাঁচান ভাই, আমারে বাঁচান। আর কোনওদিন এই ভুল হবে না। আমি গেরাম ছাইড়ে চইলো যাব। আমার জীবন ভিক্ষা দেন।’
লোকটার কথায় একটুও মন টলে না রহমতের। সে দেরি না করে গলার ওপর পা দিয়ে চেপে হ্যাচকা টানে গামছাটাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে আসে। গামছাটা লোকটার গলায় এমন জোরে পেচিয়ে যায় যে, একটি গো গো আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ কানে আসে না রহমত ও সরাফতের। বাইরে একটানা ঝিঁঝির ডাকে একটা অদ্ভুত রহস্যময়তা রাত্রির আবহে ঘন হয়ে আসে। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটার গলার গো গো আওয়াজও বন্ধ হয়ে যায়। রহমত ও সরাফত গলার ঝুলন্ত দড়ি ধরে টানতে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেহটাকে বাইরে খড়ের গাদার কাছে নিয়ে আসে।
রহমত ঘর থেকে একটা কোদাল বের করে আনে। তারপর খুব দ্রুত একটা গর্ত খুঁড়তে থাকে। সরাফত ছোটভাইকে তাড়া দেয়, ‘তাড়াতাড়ি কর।’
রহমত প্রাণপণ চেষ্টায় গর্ত খোঁড়া শেষ করলে দু’ভাই মিলে দেহটাকে গর্তের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে তার ওপরে মাটি ফেলে পুরো দেহটাকে ঢেকে দেয়। কিন্তু নতুন খোঁড়া জায়গাটা সকলের নজরে পড়বে বলে খড়ের পাজা থেকে খড় নামিয়ে গোটা কবরটাকে ভালভাবে ঢেকে দিয়ে দু’জনেই ঘরে চলে আসে।
সরাফত নিজের ঘরে চলে যায়। রহমতও নিজের ঘরে ঢুকে হ্যারিকেনটা জ্বালায়। এবার সে নির্ভার। এবার আর তার বউয়ের দিকে কেউ নজর দিতে পারবে না।
গভীরতর স্বস্তিতে তার বুক থেকে দীর্ঘ এক নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। হ্যারিকেনের আলোতে সে ভাঙা বেড়ার বাঁধন ভালো করে লাগিয়ে সালেহাকে ডাকতে যায়।
বাইরে বেরিয়ে সালেহা মেজো বউয়ের ঘরে গিয়ে বসে ছিলো। তার মুখ গম্ভীর। মুহূর্তের মধ্যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল ! অথচ এই সবকিছুর জন্য দায়ী সে নিজে। নিজে যদি স্বামীকে প্ররোচিত না করত, তা হলে কিছুতেই একটা লোকের জীবন এভাবে নিঃশেষিত হয়ে যেতে পারত না। বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি তাকে একেবারে শীতল করে দেয়।
সে কিছুতেই ভুলতে পারে না, একটি মুখ, অসম্পূর্ণ দাঁড়ি আর চোখে সুরমার সূক্ষ্ম আভরণ। ভাবতে ভাবতে এক ধরনের করুণা এসে সালেহাকে গ্রাস করে। ততক্ষণে স্বামী রহমত বাইরে থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে। তার মুখে এক ধরনের স্বস্তির আভা। খেতে খেতে বলে, ‘শালা, আর কোনওদিন আমাগো বৌ-ঝিদের দিকে নজর দিতি পারবি না। শালায় এখন মাটিতে কেঁচো হইয়ে জন্মাবি।’
সালেহা হঠাৎ দেখতে পায়, সত্যি সত্যি একটা কেঁচো খাবার পাত্রের পাশ দিয়ে রহমতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রহমত খেয়াল করেনি। সালেহার আর্তনাদে রহমতও হঠাৎ করে থমকে যায়।
সালেহার চিৎকারে পাশের ঘর থেকে সরাফত ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইছে রে রহমত। বউমা চিৎকার করতিছে ক্যান ?’
রহমত হাঁক দেয়, ‘ও কিছু না ভাইজান, ও কিছু না। আপনি গিয়া ঘুমান।’
সরাফত চলে গেলে রহমত দেখতে পায় কেঁচোটা তার থালা বেয়ে ঠিক মাঝখানে গিয়ে দেহটাকে গোল করে পেচিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে আছে। বিস্মিত রহমত সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে একটি কাঠি এনে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু কেঁচোটি কিছুতেই সেখান থেকে সরে যায় না।
তখনি নদীর বুকে ঝুপ করে শব্দ ওঠে। প্রমত্তা নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ রহমতের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। যেখানটায় খড়ের মাচা, নদী ভাঙতে ভাঙতে প্রায় সেখানটায় চলে এসেছে। যে কোনওদিন স্রোতের টানে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। খড়ের গাদা নদীর মধ্যে ডুবে গেলে তাদের বাড়িঘর ভেঙে তলিয়ে যেতে আর কতক্ষণ।
ভাবতে ভাবতে দু’জনে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সালেহা দেখতে পায়, একটা কেঁচো এসে তার গলাটাকে এমনভাবে পেচিয়ে ধরেছে যে, তা থেকে সে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা গরগর আওয়াজ গলার কাছে এসে বারবার আটকে যাচ্ছে। সে তীব্র আর্তনাদ করে বিছানায় উঠে বসে। সালেহার আর্তনাদে ধড়মড় করে উঠে বসে রহমতও। সে সালেহার পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে রে বউ, কী হয়েছে?’
সালেহা খুব ক্ষীণকণ্ঠে দুটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে, ‘কিছু না।’
তখন তার গা বেয়ে দরদর করে কেবলি ঘাম ঝরতে থাকে।
‘নানী।’
নাতির ডাকে সংবিৎ ফিরে আসে সালেহার। সে নির্বাক চোখে নাতির দিকে তাকায়।
‘সন্ধ্যা হইছে, চল নানী ঘরে যাই।’
সালেহাও কোনও কথা না বলে নাতির হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে বিশাল একটা মাটির চাক ঝপ করে ভেঙে প’ড়ে মুহূর্তেই নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তার চোখের সামনে স্রোতে ডুবে যেতে থাকে আপাদমস্তক অভঙ্গুর একটি কঙ্কালের সম্পূর্ণ অবয়ব।
(সমাপ্ত)
আগের পর্বে লিংকগুলো :
পর্ব-১
http://sonelablog.com/archives/3693
পর্ব-২
http://sonelablog.com/archives/3840
পর্ব-৩
http://sonelablog.com/archives/3888
পর্ব-৪
http://sonelablog.com/archives/3977
১২টি মন্তব্য
মিসু
গলায় ফাস দিয়ে মারা হবে এটি ভাবিনি আগে ।
এক্টি সুন্দর গল্পের সমাপ্তি হলো ।
সাতকাহন
এটাই তো গল্পের নাটকীয়তা ভাই, ভালো লাগলো সাথে আছেন বলে।
ছাইরাছ হেলাল
সমাপ্তির টুইস্ট ভাল হয়েছে ।
আর একটি শুরু করুন ।
সাতকাহন
পাগলার বউ শুরু হবে
জিসান শা ইকরাম
সমাপ্তিটা যা আশা করেছিলাম , তার চেয়েও ভালো হয়েছে ।
নিখুঁত একটি গল্প ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, ভাইয়া।
ব্লগার সজীব
ভালো লাগা সিরিজ গল্পে অগুনতি লাইক 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাই, সাথে আছে এটাই শান্তি।
বনলতা সেন
ধারাবাহিক লেখা আমি পড়তে পছন্দ করি ।
যে ভাবে শেষ করেছেন তা ভালই ।
ঈদের শুভেচ্ছা ।
অন্যদের লেখাও আপনি পড়ে মতামত দিবেন তা দেখার অপেক্ষা করছি ।
সাতকাহন
অবশ্যই, হাতে কিছু কাজ থাকায় নিয়মিত হতে পারছি না, তাছাড়া রমা চৌধুরীকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টরি করছি। ১৬ তারিখ থেকে শুটিং সেটা নিয়েই ঝামেলা যাচ্ছে। আপনাদের সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি এটা আমার এফবি লিংক। বেশি দিন হয় না আমি অনলাইনে। ইচ্ছে হলে আমাকে এফবিতে এ্যাড করতে পারেন। https://www.facebook.com/swadheenota.tumi
বনলতা সেন
ভাল ভাবে ডকু শেষ হোক । আমরাও যেন দেখতে পাই ।
ঈদ মোবারক ।
ফেস বুকিং করি না ।
সাতকাহন
সাথে থাকবেন।