
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে এগারসিন্দুর গ্রামে ঈশা খাঁর এই দূর্গের অবস্থান। কিশোরগঞ্জে ঈশাখার আরো দূর্গ রয়েছে যা এখনো আমার দেখা হয়নি। দূর্গ দেখতে গিয়ে কি পরিমাণ হতাশ হয়েছি তা আমার পোষ্ট দেখলেই বুজতে পারবেন। ঈশা খাঁ দূর্গ লিখা সাইনবোর্ডটা পড়ে এবং দেখানো তীর চিহ্নের দিকে যাওয়ার কোন রাস্তাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শেষ পর্যন্ত স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞেস করে বেশ কিছুটা ঘুর পথে সেখানে গিয়ে হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু দূরেই বেবুদ রাজার দীঘিটা অবশ্য ভালোভাবেই দেখা হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে, বেবুধ নামে এক কোচ উপজাতীয় রাজা দূর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে ঈশা খাঁ দূর্গটি দখল করে নেন এবং একে সংস্কার করে তাঁর শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করেন।
এ দুর্গেই পরবর্তীতে মোঘল সেনাপতি রাজা দুর্জন সিংহের সাথে ঈসা খাঁ এর যুদ্ধ হয়। এবং ইতিহাসের বহুল আলোচিত ঈসা খাঁ আর মানসিংহের লড়াই এ জায়গাতেই ঘটেছিল। কথিত আছে যুদ্ধে মানসিংহের তলোয়ার ভেঙ্গে গেলে নিরস্ত্র মানসিংহকে আঘাত না করে নতুন অস্ত্র তুলে দেন ঈসা খাঁ। মান সিংহ ঈসা খার মহানুববতায় পরাজয় মেনে নেন। ১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে দুর্গটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তো আসুন এবার দেখে নেই ঈশা খাঁ আর বেবুদ রাজার দেশটি এখন কেমন আছে।
(২/৩) এই মাটির টিলাটাই নাকি ঈশা খাঁ দূর্গ! এতোটা পথ এসে সত্যিই একেবারে হতাশ হলাম।
(৪) দূর্গের উপর আমরা দাঁড়িয়ে
(৫/৬) টিলার এক পাশে এইটা কোন কবরের উপরিভাগ না দূর্গের কোন ভগ্নাশেষ অন্য কিছু জানা হয়নি।
(৭) শেষ পর্যন্ত আমরা হাসার সিদ্ধান্তই নিলাম, একটু হাসলাম ও। প্রচন্ড খারাপ রাস্তাঘাট পার হয়ে এমন দুর্গ দেখা !!! তবে মনকে এই বলে শান্তনা দিলাম যে, একটা ইতিহাস জানা ও দেখা হলো, আর মনে কষ্ট পেলাম এই জন্য যে আমাদের দেশে অনেক ইতিহাস বা ঐতিহাসিক স্থান বা স্থাপনা এইভাবেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
(৮) করিম মেম্বারের উত্তর পাশেই নয়ন কবিরাজের বাড়ি, দূর্গ থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গলে সমস্যা নাই 😀
(৯) বেবুদ রাজার দীঘি দেখতে এমন মেঠো পথে আরো কিছুটা পথ যেতে হলো।
(১০) অল্প পানিতে মাছ ধরছে একটা কিশোর।
(১১) চিংড়ি, মলা, পুটি নানা রকম মাছ।
(১২/১৩) এটা বেবুদ রাজার দীঘি। এটা নিয়া একটা নিয়া একটা মিথ প্রচলিত আছে। মিথটি এই রকমঃ
এগারসিন্দুরের এক সামান্তরাজ আজাহাবাকে যুদ্ধে পরাজিত করে বেবুদ রাজা হাজরাদী এলাকা করায়ত্বে আনার পর এগারসিন্দুরকে তার রাজত্বের রাজধানী করে এগারসিন্দুরের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। যতদূর জানা যায় স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি তার রাজপ্রাসাদের সন্নিকটে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার , পুকুর অনেক গভীর করে খনন করার পরও পুকুর থেকে পানি উঠেনি। রাজা অপয়া এইরকম একটি কানাঘুষা শুরু হলো। এতে ইন্ধন ছিলো রাজারই একজন ক্ষমতালোভী মন্ত্রীর। রাজা পড়লেন মহাচিন্তায়। এরই মধ্যে রানী একদিন স্বপ্নে দেখা পেলেন গঙ্গাদেবীর, গঙ্গাদেবী স্বপ্ন মারফত রানীকে জানালেন, রানী যদি জলশূন্য পুকুরে কলসি কাঁখে নিয়ে এসে পুকুরের তলদেশে পদস্পর্শ করে তবে পুকুরে পানি উঠবে এবং এই জলের তলদেশেই গঙ্গাদেবীর আজ্ঞাধীন যক্ষিণী হয়েই রানীকে থাকতে হবে। নয়তো এই রাজত্ব বা রাজা কিছুই থাকবে না। রানী কেঁদে বুক ভাসালেন, অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, দেবীর পাষান মন গললো না। শেষে জানতে চাইলেন, আমি চলে গেলে আমার শিশু বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে কে? উত্তরে দেবী জানান, তোমার বাম হাতের তর্জনীতে থাকা সোনার আংটি জলস্পর্শ করে তোমাকে ডাকলে, তুমি মানব আকৃতিতে তোমার সন্তানকে দুধ খাওয়ানোসহ তাকে আদর-সেবা করতে পারবে। পরদিন তার স্বপ্নের কথা রাজাকে জানালে স্বপ্নের বর্ণনানুযায়ী পুকুরের ঘাটে এসে রানীর বাম তর্জনীর আংটিটি রাজার হাতে দিয়ে কলসি কাঁখে পুকুরের তলায় পদস্পর্শ করার সাথে সাথেই পুকুরে পানি উঠে ভরে যায়, আর সেই সাথে রানী হারিয়ে যায়। স্বপ্নের বর্ণানুযায়ী যখনই রাজার সন্তান খাবারের জন্য কান্না করত তখন রাজা ঐ আংটিটি হাতে নিয়ে ঘাটে এসে জল স্পর্শ করে ডাক দিলেই রানী মানব আকৃতিতেই উঠে আসতেন এবং তার সন্তানকে দুধ খাইয়ে আবার চলে যেতেন। বেবুদ রাজার সেই ষড়যন্ত্রকারী মন্ত্রী; যার কাছে তিনি রাণীর পানিতে অন্তর্ধান ও তার আংটির রহস্যময় জাদুকরি কর্মের কথা বললে, সে কুমতলবে রাজার হাত থেকে কৌশলে আংটিটি চুরি করে নিয়ে যায়। বেশী দূর যেতে পারে নি। অল্প কিছু দূর গেলে সে দৈবভাবে শাস্তিপ্রাপ্ত হয় এবং আংটিটি তার হাত থেকে পড়ে যায় এবং সেই এলাকার মাটি সরে গিয়ে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয় এবং পুরো এলাকা পানিতে একাকার হয়ে যায়। আংটি চুরির ফলে সৃষ্ট এ জলাশয়টিই এখন আংটি চুরার বিল নামে পরিচিত। আংটি হারিয়ে রাজা পুকুর ঘাটে এসে শত ডেকেও আর রাণীর দেখা পাননি। রাণীকে হারিয়ে রাজা একাকিত্বে দুঃখ কষ্টে ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়েন। এবং পরবর্তীতে মারা যান।
(১৪/১৫) এই দীঘিতে এখন গরু আর মানুষের সমান্তরালে গোসল করা চলে।
(১৬) আকাশে বেশ মেঘ জমেছে, এবার বাড়ির পথে পা বাড়াতে হবে।
২১টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
বাহ, এবারে আপনার লেখা পড়ে বেশ অনেক অজানা ইতিহাস জানতে পারলাম।
এত সবুজ কি করে হলো? এডিটিং এ পাকা না মনে হচ্ছে।
দিঘীটির ছবি সুন্দর।
কামাল উদ্দিন
এডিটিংটা আরো ভালোভাবে শিখতেই হবে মনে হচ্ছে……শুভ সকাল।
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের সাথে নিয়েন কিন্তু!
ইসিয়াক
শেষ পর্যন্ত আমরা হাসার সিদ্ধান্তই নিলাম, একটু হাসলাম ও। প্রচন্ড খারাপ রাস্তাঘাট পার হয়ে এমন দুর্গ দেখা !!! তবে মনকে এই বলে শান্তনা দিলাম যে, একটা ইতিহাস জানা ও দেখা হলো, আর মনে কষ্ট পেলাম এই জন্য যে আমাদের দেশে অনেক ইতিহাস বা ঐতিহাসিক স্থান বা স্থাপনা এইভাবেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
সত্যি কথাই বলেছেন কামাল ভাইয়া। অনেক কিছু সংরক্ষণের অভাবে আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্চে।
কামাল উদ্দিন
দুঃখ করে কি লাভ ভাই বলুন, তার থেকে আনন্দ নিয়েই ফিরে এলাম।
সুপায়ন বড়ুয়া
ইতিহাস সমৃদ্ধ এই লেখার সাথে
সবুজের শ্যামলিমা এই ছবিগুলি
মন কেড়ে নেয়।
শুভ কামনা ভাইজান।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ দাদা, আপনার জন্যও রইল শুভ কামনা সব সময়।
মোঃ মজিবর রহমান
সবুজের সবুজের বহময় মন জুড়ায়। ইতিহাস পড়লাম
কামাল উদ্দিন
হুমম, এমন মিথ মাখা ইতিহাসগুলো আমায় খুবই টানে, তাই তো ওদের পাণে ছুটে যাওয়া, ভালো থাকবেন ভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সংরক্ষণের অভাবে এভাবেই অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এসব ইতিহাস দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ধন্যবাদ আপনাকে এতকষ্ট করে হলেও হাসিমাখা ছবি দেবার জন্য। ভালো থাকুন শুভ সকাল
কামাল উদ্দিন
এক সময় হয়তো এমন ইতিহাসগুলো বইয়ের পাতায়ই শুধু থাকবে, ধন্যবাদ আপু, ভালো থাকুন সব সময়।
জিসান শা ইকরাম
পোষ্ট পড়ে হাসতে হাসতে শ্যাষ আমি। এইটা দুর্গ! হা হা হা। সংরক্ষনের অভাবে কত কিছু নষ্ট হয়ে যায় আমাদের।
দীঘিটা অনেক সুন্দর।
শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
আমরাও হেসেছিলাম ভাই, অতি দুঃখেও কিন্তু মানুষ হাসে 😀
আলমগীর সরকার লিটন
ভাল লাগল কামাল দা
কামাল উদ্দিন
শুভেচ্ছা জানবেন লিটন ভাই।
ফয়জুল মহী
অনুপম, অতুলনীয়
কামাল উদ্দিন
হুমম
সৈকত দে
ভ্রমণ না করেও যেন ভ্রমণের স্বাদ পেলাম। অসাধারণ 🌹🌹
কামাল উদ্দিন
শুভেচ্ছা জানবেন ভাই
হালিম নজরুল
অসাধারণ অভিজ্ঞতা ও ছবি।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ নজরুল ভাই