“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”
অবশেষে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষন, ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। এদিন ছিলো ইউনেস্কোর কাছে প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। কিন্তু তখনো প্রস্তাবটি এসে পৌঁছায়নি। এই কর্মযজ্ঞের প্রাথমিক পুরোধা একালের রফিক ও সালাম, টেনশন আর উত্তেজনায় তাঁরা ছটফট করছিলেন, নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে টেলিফোন নিয়ে আর ই-মেইল খুলে বসে অপেক্ষা করছেন, ঘনঘন চোখ রাখছেন ই-মেইলে। কোনো সাড়াই আসছে না বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে! শেষ পর্যন্ত কি অধরাই থেকে যাবে স্বপ্নটি?
এদিকে আসলে লিখিত প্রস্তাবটিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সইটা বাকি ছিল। প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। ওদিকে আবার পার্লামেন্টের সময়সূচি শেষ হতেহতে ইউনেস্কোতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমাও বুঝিবা পার হয়ে যায়। রফিক-সালামের উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। কি করা যায়? সব পরিশ্রমই কি বিফলে যাবে! শেষরক্ষা বুঝি আর হলো না। অবশেষে ইউনেস্কোর সময়সীমা শেষ হওয়ার মাত্র এক ঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা এসে পৌঁছালো ইউনেস্কোর অফিসে।
১৬ নভেম্বর, প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে বসলো ৩০তম সম্মেলন। ইউনেস্কো সচিবালয়ে প্রস্তাবটি নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় বহুল প্রত্যাশিত প্রস্তাবটি সেখানে উত্থাপিত হলো না। রফিক-সালামের উৎকণ্ঠা আবারও বেড়ে গেলো। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক বাংলাদেশের প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এক্সিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণের সুপারিশ করেন। সুপারিশে তাঁর মন্তব্যটি প্রস্তাবটিকে রীতিমতো অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। এ সময় ইউনেস্কোর অধিবেশনে যোগদানকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের (শিক্ষামন্ত্রী জনাব সাদেক, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও ইউনেস্কো মহাপরিচালকের বিশেষ উপদেষ্টা জনাব তোজাম্মেল হক) কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতা এ ব্যাপারে মূল্যবান অবদান রাখে। তাঁরা ইউনেস্কোর ডেপুটি মহাসচিব কলিন পাওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, আমাদের প্রস্তাবে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো, পৃথিবীর বুক থেকে দ্রুত বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করা এবং তা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে বৃহত্তর সচেতনতা গড়ে তোলা। সুতরাং উদ্যোগটি যদি পিছিয়ে যায় তাহলে ইত্যবসরে আরো অনেক ভাষার বিলুপ্তি ঘটবে। অষ্ট্রেলিয়ান নাগরিক কলিন পাওয়ার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি খসড়া প্রস্তাবে উল্লেখিত সুপারিশ প্রত্যাহারে রাজি হন।
উল্লেখ্য যে, প্রস্তাবটি যদি একবার এক্সিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণ করা হতো তাহলে আদৌ আর আলোর মুখ দেখতো কিনা সন্দেহ।
পরদিন ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ সাল। সভার শুরুতেই প্রস্তাবটি উত্থাপন করলো বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। সবগুলো দেশ এতে সাথেসাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই বিরোধিতা করলোনা, এমনকি ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার মূলোৎপাটনের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত হয়েছিলো, সেই পাকিস্তানও নয়। আরও একটি জয়যাত্রা বাঙালীর হলো।
সর্বসম্মতক্রমে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ’আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়।
২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো পালিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেস্কোর পর ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এখন এ দিনটি আর শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বের। বিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দিন। সবাই যাতে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে, গর্ব করতে পারে, সে লক্ষ্যেই জাতিসংঘ এ দিবসটিকে ’আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষনা করেছে।
পাশাপাশি সারাবিশ্ব এখন জানতে পারবে, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বীর বাঙালিরা এই দিনেই প্রাণ দিয়ে দাম দিয়েছিলো। বিশ্বের মানুষ জানবে ঢাকার বুকে 1952 সালের 21শে ফেব্রুয়ারিতে কি ঘটেছিল, কি কারণে রফিক, সালামরা প্রাণ দিয়েছিল। তারা জানবে বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য তা অনেক বড় অর্জন।
পরিশেষে, আমি এই লেখার মাধ্যমে ‘সোনেলা’র পক্ষ থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করছি:
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’কে মহিমান্বিত করতে বিশ্বব্যাপী এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ইউনেস্কো। বাংলাদেশ ইউনেস্কোকে ছবি, ভিডিও ও পোস্টার ডিজাইন সরবরাহ করার মাধ্যমে অনুরোধ করতে পারে প্রত্যেক দেশের সরকার যেনো তাদের দেশের স্কুল পাঠ্যবইতে ’একুশে ফেব্রুয়ারি’র গুরুত্ব তুলে ধরে। তাতে পৃথিবীব্যাপী নানা দেশের মানুষ জীবনের প্রারম্ভেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অনুভব করতে পারবে। আর সেখান থেকেই জানবে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঠিক কি ঘটেছিলো, কোথায় ঘটেছিলো, কেন ঘটেছিলো, মাতৃভাষার গুরুত্ব কি, মাতৃভাষা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন কেনো ইত্যাদি। আর এভাবে পৃথিবীর নানা দেশের স্কুলছাত্ররা স্কুলের পাঠ্যবই পড়ে বাংলাদেশকে চিনবে ‘ঢাকা’ ও ’একুশে ফেব্রুয়ারি’কে জানতে পারার মাধ্যমে।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, মুক্তমনা ব্লগ, bdnews24.com
‘একুশ’ এখন শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বের!:পর্ব-১
১৬টি মন্তব্য
প্রহেলিকা
মহান বীর ভাষা সৈনিকদের প্রানের বিনিময়ে পাওয়া ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পুরো জাতির জন্য গর্বের বিষয়। ভাষায় লেগে আছে বীর শহীদদের রক্তের দাগ। বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার কতৃক প্রতিষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট” কিন্তু এটি বর্তমানে প্রায় অচলই বলা যায়।
আমাদের সকলেরই উচিত এগিয়ে আসার, বিশ্বব্যাপী আমাদের ভাষার ইতিহাসকে প্রসারিত করতে। এমন পোষ্টের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। মহান ভাষা শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র সালাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বিনম্র শ্রদ্ধা মহান ভাষা শহীদদের প্রতি।
হ্যাঁ, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট” বলতে গেলে অচলই। বাঙলা ভাষার উৎকর্ষতা সাধনে সকলের সচেতন হওযা দরকার।
ছাইরাছ হেলাল
এই অসাধারণ অর্জনের পেছনের মানুষদের কথা আমরা মনে রাখি না, মনে করিও না।
আপনি সূত্র উল্লেখ করে কষ্ট করে তুলে ধরেছেন দেখে ধন্যবাদ দিচ্ছি।
আর এই উদ্যোগের সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষ কে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাদের আন্তরিক পরিশ্রমের জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপনাকেও।
যারা সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু করেন, তাঁদের প্রাপ্তির আকাঙ্খা থাকে না। কিন্তু আমাদের উচিৎ তাঁদের আন্তরিক পরিশ্রমের যথার্থ সন্মান দেয়া।
শুন্য শুন্যালয়
চমৎকার গুছিয়ে লেখা একটি পোস্ট। কতো অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসা কাজ করেছে তাদের মাঝে, বিশ্বের মাঝে যারা বাংলাকে আজ ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। স্যালুট তাদের সবাইকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি যাতে আরো বেশি প্রসার লাভ করতে পারে সেজন্য আমাদের সবার কাজ করা উচিত। বিশেষ করে যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা একটু বেশি। এবছর না পারলেও ইচ্ছে আছে আগামী বছর থেকে লোকাল স্কুলগুলোতে ২১ শে ফেব্রুয়ারীর উপর কোন প্রেজেন্টেশন এরেঞ্জ করার। আমার ছেলের স্কুল প্রিন্সিপাল কে মেইল করেছি, আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। বাকিটা নিজেদের সদিচ্ছা।
পোস্টটির জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপু। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ভালো লাগলো আপনার এই চিন্তা ভাবনার কথা শুনে। আসলেই তো, প্রতিটি মানুষ স্ব স্ব জায়গা থেকে কাজ করে গেলে অবশ্যই একদিন আমরা অনেকদূর যাবো। বিশ্বের বুকে আলোকিত জাতিরুপে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবো।
এই দেখুন না, রফিক-সালাম উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে আজ আমাদের ভাষাদিবস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো।
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত গুছানো পোষ্ট।
ধন্যবাদ এমন পোষ্টের জন্য।
খুব সহজেই আমাদের মাতৃভাষা দিবস কিভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে গেলো বুঝাতে পারবো।
লেখার শেষে দৃষ্টি আকর্ষনটিও চমৎকার -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ বিষয়টি আপনার নজরে আসায়।
খেয়ালী মেয়ে
এ দিনটি আর শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বের। বিশ্বের সব জাতির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দিন।
মোদের গোরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা (3
শেষের দৃষ্টি আর্কষনটুকু যথার্থ হয়েছে–তবে আমাদের দেশের পাঠ্যবইগুলোতেও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু নেই 🙁 যার জন্য আমদের শিক্ষার্থীরাও অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত…
অনেক ধন্যবাদ আপনেকে 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমাদের দেশের পাঠ্যবইগুলোতে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ সম্পর্কে যাতে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ পায় সেজন্য সোচ্চার হতে হবে।
ধন্যবাদ।
লীলাবতী
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা সম্পর্কে পুর্নাংগ পোষ্ট বলা যায় আপনার এই লেখাকে।অনেক কিছু জানলাম আপু।আমরা বাংলায় কথা বলি,গর্ব হচ্ছে খুব।ধন্যবাদ আপনাকে আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমরা গর্বিত যে, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নিয়ে কথা আসলেই আমাদের বাঙলা ভাষা নিয়ে কথা চলে আসবে।
এ আমাদের অহংকার।
ব্লগার সজীব
এমন লেখা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত জরুরী।ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
গুরুত্ব অনুধাবন করায় অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া
স্বপ্ন নীলা
এই লেখাটি আমার কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে– আমি জানলাম অজানা অনেক বিষয়, যারা উদ্যোগ নিয়েছে এবং যে সকল দেশ সমর্থন জানিয়েছে প্রতিটি দেশের প্রতি আমার সম্মান রইল—সাথে সাথে আপনি আমাদেরকে জানালেন নতুন করে— আপনাকে মন হতে শ্রদ্ধা
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ধন্যবাদ আপু।
অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যুগেযুগে যারা দেশকে, জাতিকে এগিয়ে নিতে, সন্মানিত করতে বিভিন্নভাবে অবদান রেখে চলেছেন, তাঁদেরকে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা, আমাদের দায়িত্ব।