
একা মানুষ মানুষ নয়, সম্মিলিত মানুষই মানুষ।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস আজ মানুষে মানুষে একে অপর থেকে দুই ফিট দূরত্বে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কাছাকাছি, পাশাপাশি হলেই মরণকামড়। এই দুই ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়েও কী আপনি নিশ্চিত হতে পারছেন যে আপনি নিরাপদ?
আপনারা হাতে হাত রেখে হাঁটতে পারেননি, ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে হতে এতোটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠেছিলেন যে, কেবলই নিজে বাঁচতে চেয়েছিলেন। ভোগবাদী বিশ্বে আপনাদের কেবল নিজের জন্যই চাই, চাই আর চাই। কে কারটা দখলে নিয়ে নিজে সুখি হবেন সেই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত। সুখের নেশায় এতোটাই অন্ধ হয়ে ওঠেছিলেন আপনারা, পাশের মানুষটিরও যে অধিকার আছে তা ভুলেই গিয়েছিলেন। পারলে পাশের মানুষটির নায্য অধিকারটাও কেড়ে নিয়ে নিজের ভাণ্ডার পূর্ণ করে ভবিষ্যত সুখের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। করোনা আপনাদের সে নিশ্চয়তায় অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছে। করোনা সকলকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েই জানান দিচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ আসলে ভাল থাকতে পারেনা। মানুষ বাঁচে সম্মিলতভাবেই। অথচ আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিল।
পৃথিবীর বড় বড় নগর আজ একেকটা ভূতুড়ে পল্লী। জনমানবহীন রাস্তাঘাটে নেমে এসেছে কবরের নিস্তব্ধতা। এ পরিস্থিতিতে মানুষ বদ্ধঘরের বেলকনি/বারান্দায় দাঁড়িয়ে একে অপরকে জানান দিচ্ছে, ‘আছি হে মানুষ, আমরা একে অপরের পাশেই আছি।’ এ কিসের বার্তা? এ বার্তা, ‘সম্মিলিত মানুষই যে মানুষ’ এ বার্তা।
বিশ্বময় করোনা ভাইরাসের আক্রমন ঠেকাতেই আমাদের আজ পরস্পর থেকে এমন বিচ্ছিন্ন হওয়া। বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকেই আমরা উপলব্ধি করছি, সম্মিলিত চলার প্রয়োজনীয়তা। করোনা আমাদের জানিয়ে যাচ্ছে একা বাঁচা যায়না। হাতে হাত ধরেই বাঁচতে হয়। ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেক আমরা পরের তরে।’
আপনি বিত্তবান। অঢেল ধনসম্পদ, গাড়ি-বাড়ির মালিক। হাঁক দিলেই আপনার সেবায় লোক চলে আসে। নিজের অজান্তেই তাকে আপনি হুকুম তামিলকারী হিসাবে দেখতে শুরু করেছেন। এ দেখায় একসময় অবজ্ঞা এসেছে, হীনতা এসেছে। ধন সম্পত্তির অহংবোধ ক্রমশ আপনাদের অমানুষ করে তুলছিল। আপনাদের কেউকেউ এদেরকে মানুষই ভাবতেন না। অথচ এরা না হলে আপনার আয়েশি জীবন যাপন করা সম্ভবপর হতনা। আপনারা ধরেই নিয়েছিলেন টাকা হলেই সব সম্ভব, সব। এমনটা ভাবতে ভাবতে একসময় আপনাদের কারো কারো মধ্যে টাকা ছড়িয়ে মানুষ টানার প্রবণতাও জেগে ওঠেছে! আপনাদের অন্তর্গত এই ইচ্ছার চকচকে চোখ দেখলে বড্ড করুণা হয়। আহ! দুদিনের দুনিয়া!! কখনোকখনো ঘেন্নাও হয়। আজ ওই হুকুম তামিল করা লোকটিই কিন্তু আপনার জন্য বিপজ্জনক। ওই নিজস্ব ড্রাইভারটিই আপনার জন্য বিপজ্জনক। চাইলেই আপনি তাকে এড়িয়ে চলতে পারছেন না। আপনার অঢেল সম্পদ আছে, কিন্তু আজ একা চলায় আপনি খোড়া। আপনার পক্ষে কিছুতেই একা চলা সম্ভব নয়। আপনি রাস্তার মানুষজন, ফকির মিসকিন এড়িয়ে চলেন। গাড়িতে করে যান, গাড়ি করে ফিরেন। আপনি নিশ্চিত অই ধুলোময়লা মানুষজনের সংস্পর্শ আপনি এড়িয়ে চলতে পারছেন। কিন্তু আজ এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছেন যে, একা একাও আপনি নিরাপদ নন, যদি নিজেকে বন্দি না করেন। ধরুন, আপনি ড্রাইভার না নিয়ে একাই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে কাজ সেরে আবার বাড়ি চলে আসলেন।
কী ভাবছেন? আপনি নিরাপদ? মোটেই না। কেউ একজন আপনার গাড়িটা সুন্দর দেখে একটু ছোঁয়ে দেখেছিল, ব্যস। ওতেই আপনি এফেক্টেড। করোনা চলে এসেছে আপনার ডেরায়।
করোনার আগমন চোখে আঙুল দিয়ে সত্যটাকেই দেখিয়ে দিল। করোনা ভাইরাস হয়তো একদিন চলেই যাবে। আমরাও হয়তো কেউকেউ তার সাথে চলে যাবো। কিন্তু যারা বেঁচে থাকব, আমরা দেখব করোনা ভাইরাস পূর্ববর্তী পৃথিবী আর পরবর্তী পৃথিবীর মাঝে এক বিরাট পরিবর্তন।
করোনা মানব জীবনে ক্ষতর পাশাপাশি রেখে যাবে অনেকগুলো প্রশ্ন❓
এই উত্তর খুঁজে নিয়েই হয়তো একদিন আবার শুরু হবে সম্মিলিত মানুষের যাত্রা। গড়ে ওঠবে এক মানবিক পৃথিবী।
১৯টি মন্তব্য
তৌহিদ
আমরা করোনার ভয়াবহতা জেনেও এমন সব কাজ করছি যে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছি। যেখানে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন আমরা সেখানে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে কাজে লাগিয়েছি। ফলাফল হচ্ছে করোনা তার জায়গায় আরো সক্রিয় হয়েছে।
এখন হয়তো সে দিন বেশী শক্তিশালী নয় যেখানে মানুষ হয়তো থাকবে তবে করোনার ছোঁয়া মনে করিয়ে দেবে অনেক স্মৃতি।
ভালো থাকবেন আপু। সতর্ক থাকুন। লেখা পড়ে ভালো লেগেছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ ভাই।
করোনা আমাদের মননে অনেক প্রশ্ন রেখে যাবে সেখান থেকে উত্তর খুঁজেই মানবজাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
তৌহিদ
একদম ঠিক। আমাদের সচেতন হবার এখুনি সময়।
ফয়জুল মহী
হে দুনিয়ার মালিক তুমি ক্ষমা করো। বাঁচতে দাও সবাইকে তোমার সুন্দর পৃথিবীতে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সীমালঙ্ঘনকারীকে খোদাও সহ্য করেন না।
সুপায়ন বড়ুয়া
একদিন আবার শুরু হবে
সম্মিলিত মানুষের যাত্রা।
গড়ে ওঠবে এক মানবিক পৃথিবী।
সেই দিনের প্রতীক্ষায় মোরা।
শুভ কামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সম্মিলিত মানুষের যাত্রাই পৃথিবীকে মানবিক পৃথিবী হিসাবে গড়ে তুলে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। শুধু উঁচু তলার মানুষ না, আমাদের সবার মধ্যেই আত্নকেন্দ্রিক মনোভাব, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ বিরাজ করছে। করোনা কতটুকু এগুলোকে নির্মূল করতে পেরেছে, পারবে তা প্রশ্ন থেকেই যায়। ভালো থাকুন শুভ কামনা রইলো
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সমাজের প্রতি পরতে পরতে আত্মকেন্দ্রিকতা জায়গা করে নিয়েছিল। এমনকি করোনা আসার পরও এদেশিয় মানুষকে নিজ স্বার্থকেই বড় করে দেখতে দেখা গিয়েছে। দিয়াবাড়ির ঘটনা রীতিমতো অবাক করেছে।
জিসান শা ইকরাম
আমরা সেই সম্মিলিত মানবিক বিশ্বের জন্য অপেক্ষা করছি। অত্যন্ত সুন্দর লেখা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।
এস.জেড বাবু
আপনি বিত্তবান। অঢেল ধনসম্পদ, গাড়ি-বাড়ির মালিক। হাঁক দিলেই আপনার সেবায় লোক চলে আসে। নিজের অজান্তেই তাকে আপনি হুকুম তামিলকারী হিসাবে দেখতে শুরু করেছেন। এ দেখায় একসময় অবজ্ঞা এসেছে, হীনতা এসেছে। ধন সম্পত্তির অহংবোধ ক্রমশ আপনাদের অমানুষ করে তুলছিল।
/// অধিকাংশ বিত্তবানদের ক্ষেত্রে এই অহংবোধ পরিবার থেকে/ জন্মলগ্ন থেকে পাওয়া। করুনা হয় এদের জন্য- যদিও আমার আপনার ভাবনায় এদের কিছুই যায় আসে না।
বেঁচে থাকি আর মরি-
করোনা পরবর্তি পৃথীবির একটা সুন্দর সহনীয় পরিবর্তন হউক।
মানবতা জাগ্রত হউক মানুষের মনে।
ভালো লাগলো লিখা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সেটাই যেনো হয়। পৃথিবীতে পরিবর্তন আসা জরুরী। করোনা আমূল একটা পরিবর্তন নিয়ে আসবে জানা কথা। কিন্তু মানুষে মানুষে আকাশপাতাল ভেদাভেদ দূর করে মানবতা জাগ্রত করুক, সেটাই কামনা করি।
এস.জেড বাবু
আল্লাহ কবুল করুন- আমিন
ইঞ্জা
সময়ের ঘড়িটা যেন থমকে রয়েছে, মানুষ যেন মানুষ নেই, যেন এক একটা জীবন্ত বোমা, কখন যে ফাটবে তার হিসাব নাই, করোনা এখন ধনী গরিব কাউকে আলাদা করে দেখছেনা, এমন পরিস্থিতির সাথে আমরা কেউই পরিচিত ছিলাম না, এখন আমরা মানুষনা।
মনের কথা গুলো বললাম আপু, আপনার লেখা পড়ে ইমোশনাল হয়ে পড়লাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ভাই, মানুষে মানুষে আকাশপাতাল ব্যবধান আমাকে অনেক পীড়া দেয়। তার উপর আবার যখন দেখি চুরিচামারি করে উপর তলায় উঠে মানুষগুলো নিচের মানুষকে মানুষই ভাবছে না, ভীষণ মর্মাহত হই। অথচ দুর্নীতি না থাকলে, সম্পদের সমবন্টন হলে এতো ব্যপক ফারাক হতোনা।
ইঞ্জা
সম্পূর্ণ একমত আপু, সত্যি এইসব ফারাক ঘুছাতে পারলেই প্রকৃত ভাবে ভালোই হতো, ধন্যবাদ।
হালিম নজরুল
চমৎকার লিখেছেন
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।