মেয়েটি জন্মেছে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর। টুইন টাওয়ার ট্রাজেডিতে যে ক’জন বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়, মেয়েটির পিতা তাঁদের একজন। বাবার আদর ভালোবাসার ছোঁওয়ায় যার বেড়ে উঠবার কথা ছিল, সে জন্মাবধি নিষ্ঠুর অমানবিক এক পৃথিবীতে বাবাহীন বেড়ে উঠছে। বেড়ে উঠতে উঠতে এখন তাঁর বয়স চৌদ্দ।
দেশ থেকে বেড়াতে আসা অতিথিদের নিয়ে টুইন টাওয়ারে গিয়েছি একাধিকবার। প্রতিবার নিরাপত্তা কর্মীদের কঠোর তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছি। কখনো কোমরের বেল্টের কারনে, কখনোবা কানের দুলের কারনে সিকিউরিটি এলার্ম বেজে উঠতো। সে রাতেও বাসায় দেশ থেকে বেড়াতে আসা অতিথিরা। রাতে খাবারের টেবিলে গল্প করছিলাম। পরদিনের পরিকল্পনা করছিলাম। ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরেই রওয়ানা দিবো টুইন টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। গল্পে গল্পে অনেক রাত হলো। ভোরে ঘুম ভাঙতে খানিক বেলা হয়ে গেলো। টিভি অন করেই দেখি ব্রেকিং নিউজ ! সন্ত্রাসী হামলায় একটি টাওয়ার ধ্বসে পরেছে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই চোখের সামনে ঘটে যায় দ্বিতীয় টাওয়ারটির দুঃসহ ধ্বসে পরার দৃশ্য। মুহূর্তেই সেটিও মিশে গেলো ধরণির বুকে। মিশে গেল অনেকগুলো জীবন। যে দেহগুলোতে ক্ষণিক আগেও প্রান ছিল। শরীর হিম হয়ে এলো। নির্বাক চেয়ে রইলাম। অতঃপর কেবলই ধুলা, ধোঁয়া, আর শব্দ শহর জুড়ে। দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গেলো। সমস্ত ফ্লাইট বাতিল হলো। বাস, ট্রেন চলাচল বন্ধ হলো। হাজারো মানুষ ম্যানহাটন থেকে ফিরলো পায়ে হেঁটে। কুইন্স ব্রিজ ধরে নামলো মানুষের ঢল। চারিদিকে আতংকিত সব মুখ। টিভি নিউজগুলো সরব হল__ শেষ মুহূর্তে বাঁচবার আকুতি নিয়ে ৯১১ এ করা ফোন কলগুলো নিয়ে। ভয়েজ রেকর্ডারে এক এক জনের বাঁচার আকুতি কিংবা প্রিয়জনকে শেষ বিদায়ের কণ্ঠস্বর গুলো আরো স্তব্দ করে দেয়। আমি হয়ে রইলাম ভয়াল সেই এগারোই সেপ্টেম্বর এর সময়ের সাক্ষী।
এরপর কেটে গেলো চৌদ্দটি বছর।
ইংল্যান্ড থেকে বেড়াতে আসা বাল্যবন্ধুকে নিয়ে গতমাসে সেই স্থানে যাই। ধ্বংসস্তূপের জায়গাটিতে গড়ে তোলা হয়েছে “ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ইলেভেন মেমোরিয়াল এন্ড মিউজিয়াম”। ধ্বংসস্তূপের লোহা দিয়ে তৈরি করা জাহাজ পানিতে ভাসানো হয়। নিহতদের স্মরনে নির্মাণ করা হয় দুটি ফোয়ারা। সেখানে দেয়াল বেয়ে পানি ঝরছে অবিরত। যেন হাজারো মৃত মানুষের বিরামহীন কান্না। যেন তাঁদের বেঁচে থাকা প্রিয়জন কিংবা স্বজনদের বয়ে বেড়ানো কষ্টের নোনা জল। সেখানে লিখে রাখা মৃত মানুষগুলোর নামগুলো ছুঁয়ে দেখি। খুঁজে দেখার চেষ্টা করি আমার দেশের মানুষ ক’জনের নাম, যারা সেই ভোরে টাওয়ারগুলোয় কাজে গিয়ে আর ফিরেনি। জানি, এই খুঁজে ফেরা অনর্থক। জীবনের সবকিছুই অর্থবহ হয় না। কিছু অনুভূতি অর্থহীন কড়া নাড়ে অবচেতন মনে।
আজ আবারো দুঃসহ সেপ্টেম্বর ইলেভেন।
এই শহরের মানুষগুলোর শোকের দিন।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৬টি মন্তব্য
নীতেশ বড়ুয়া
সেইসব সকল মৃত আত্মীয় অনাত্মীয়র আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি… -{@
রিমি রুম্মান
শুভকামনা জানবেন। -{@
লীলাবতী
নাইন ইলেভেন এক দুঃসহ কষ্টের দিন।এমন দিন যেন আর না আসে ফিরে।
রিমি রুম্মান
পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসী ঘটনাগুলোয় নিহতদের জন্যে প্রার্থনা এই দিনে।
জিসান শা ইকরাম
ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় এই দিন।
গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি আমাদের দেশের নিহতদের সহ সবাইকে।
রিমি রুম্মান
একটি ঘটনা বদলে দিল গোটা দেশকে। ভাল থাকুক নিহতদের পরিবার।
নীলাঞ্জনা নীলা
এমন দিন যেনো আর না আসে।
বাবাহীন মেয়েটির চেয়ে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটির মায়ের জন্যে। জীবনের কি দুঃসহ স্মৃতি তাকে বয়ে নিতে হচ্ছে।
রিমি রুম্মান
সেই সময়ের প্রতিটি নিউজ মনে পরে এখনো ।
যারা উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ছিল, তাঁরা বেশীরভাগই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেনি।
শুন্য শুন্যালয়
এমন কোন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড আর যেন না ঘটে! আপনার ও যাবার কথা ছিলো এটুকু ভাবলেই হিম হয়ে আসি। দুঃসহ এ স্মৃতি ভোলা সম্ভব নয়, আপনার জন্যে তো তারা স্পষ্ট। সকল মৃতদের জন্যে মাগফেরাত কামনা করছি।
রিমি রুম্মান
আমাদের যাবার কথা ছিল, মনে করলে আজও ভয়ে কুঁকড়ে উঠি। বেঁচে থাকবার আনন্দে সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। নিহত আহতদের জন্যে প্রার্থনা জানাই।
অরুনি মায়া
শুধু মাত্র টিভি তে দেখেই হতবাক হয়েছিলাম। আর যারা বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার সাহস নেই আমার।
আল্লাহ্ আপনাকে রক্ষা করেছেন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপনি। সৃষ্টিকর্তা মহান।
মেহেরী তাজ
🙁
মানুষ কতটা নিষ্ঠুর!!
রিমি রুম্মান
মানুষ হত্যা কোন ধর্ম হতে পারে না। হত্যাকারীরা মানুষ নয়। একদিন এঁদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। ইহকাল নয়তো পরকালে।
ইমন
উফ ! গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো 🙁
রিমি রুম্মান
এর ভয়াবহতা ব্যাপক। নিহতরা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। তাঁদের স্বজনরা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। আর যারা উদ্ধার কাজে নিয়জিত ছিল, তাঁরা নানা প্রকার রোগ, শোক, কিংবা মানসিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে। স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা হয়নি তাঁদের। ভাল থাকবেন। শুভকামনা।