উন্নয়নে মূল্যবোধের ভূমিকা

স্বপ্ন নীলা ৩ ডিসেম্বর ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ০৬:২৫:১৯অপরাহ্ন বিবিধ ২৮ মন্তব্য

মূল্যবোধ হচ্ছে বিশ্বাস যা আমাদের আচরণকে নির্ধারণ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের মূল্যবোধকে প্রকাশ করে। তাই আমরা বলতে পারি কোন বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস এবং সেই অনুসারে আচরণ করাই হলো মূল্যবোধ। অর্থাৎ মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচার আচরণের মানদন্ড যার আদর্শে তার কর্মকান্ড পরিচালিত হয় এবং সে সমাজের মানুষের কর্মকান্ডের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য বিচার করে। ব্যক্তির আচরণ তার মূল্যবোধকে প্রকাশ করে।

মূল্যবোধ জন্মগতভাবে প্রাপ্ত কোন বিষয় নয়। মূলতঃ সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ায় মূল্যবোধ গড়ে উঠে। কারণ সকল মূল্যবোধই সামাজিক। সেই কারণে মূল্যবোধ বদলায়, পরিবর্তিত হয় – যা নির্ভর করে অনুকূল ও প্রতিকূল সামাজিক বাস্তবতায়। মূল্যবোধ গঠণ ও পরিবর্তনে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠণ ও প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন – পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সঙ্গী -সাথী, কর্মস্থল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

মূল্যবোধের ধরণঃ

মূল্যবোধ দুই ধরণের, যথাঃ
১. জীবনমূখী বা উন্নয়ন সহায়ক মূল্যবোধ
২. জীবনবিমূখ বা উন্নয়ন বিরোধী মূল্যবোধ

জীবনমূখী বা উন্নয়ন সহায়ক মূল্যবোধ মূল্যবোধঃ
জীবনমূখী মূল্যবোধ আমরা তাকেই বলতে পারি যা জীবন ও প্রগতির পক্ষে কাজ করে। অন্যভাবে বলা যায়, যা একজন মানুষের মধ্যে সুন্দর ও সমতাভিত্তিক জীবনের বোধ জাগ্রত করে।

স্বাধীনতা, গনতন্ত্র, সমতা, ইহজাগতিকতা, দেশপ্রেম, সততা, সহনশীলতা, অহিংসা, মানবতা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, ভালবাসা, অংশগ্রহণ, সহযোগিতা, সৃজনশীলতা, ভ্রাতৃত্ব, বিজ্ঞানমনষ্কতা, যৌথতা, একতা, পরমত সহিষ্ণুতা, সময়ানুবর্তিতা ইত্যাদি জীবনমূখী মূল্যবোধের উদাহরণ।

উপরোক্ত বিষয়গুলো জীবন সহায়ক মূল্যবোধ এই কারণে যে, এই মূল্যবোধ চর্চাকারী ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে সবসময় মানবতা, প্রগতি ও উন্নয়নের পক্ষে কাজ করেন। জীবনবাদী মূল্যবোধগুলির বৈশিষ্ট্যই একজন ব্যক্তিকে জীবনকেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগে সহায়তা করে। এধরণের মূল্যবোধের অনুশীলন মানুষে-মানুষে, নারী -পুরুষে এবং মানুষে ও প্রকৃতিতে সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে – যা একটি দারিদ্রমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে।

জীবনবিমূখ বা উন্নয়ন বিরোধী মূল্যবোধঃ
যে সকল মূল্যবোধ ইতিবাচক পরিবর্তনের বিপক্ষে এবং যা বঞ্চনা ও নির্যাতনকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তা-ই জীবনবিমূখ মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধগুলির মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য টিকে থাকে এবং ক্রিয়াশীল হয়।

সা¤প্রদায়িকতা, ভোগবাদিতা, বিলাসবাদিতা, পুরুষতন্ত্র, হিংসা, মৌলবাদ, স্বৈরতন্ত্র, নির্ভরশীলতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, অসহযোগিতা, অসমতা, সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পরশ্রীকাতরতা, মুনাফাবাদিতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি জীবনবিমূখ মূল্যবোধের উদাহরণ।

১. এই মূল্যবোধ চর্চাকারী ব্যক্তি উন্নয়ন ও প্রগতির পক্ষে কাজ করতে উৎসাহী হয় না। সমাজের ঘটনা প্রবাহকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করে থাকেন। জীবনবিমূখ মূল্যবোধগুলির বৈশিষ্ট্য মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক হতে এবং জীবন ও উন্নয়নের বিপক্ষে কাজ করার জন্য প্রভাবিত করে থাকে। এই মূল্যবোধগুলি চর্চার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রগতি বিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা ও চিন্তা – চেতনা প্রসারিত হয়।

উন্নয়ন সহায়ক মূল্যবোধগুলি গড়ে তোলার উপায় ঃ
উন্নয়ন সহায়ক মূল্যবোধগুলি নিম্নোক্ত উপায়ে গড়ে তোলা যেতে পারে-
(ক). ব্যক্তিগতভাবেঃ
১. ঘটনাকে বিশ্লেষনাত্মক উপায়ে দেখা
২. বিজ্ঞানমনষ্কতা
৩. গোড়ামী পরিহার করা
৪. পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া
৫. যে কোন ঘটনাকে কার্য ও কারণের ভিত্তিতে দেখা
৬. ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করা
৭. জীবনের সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অনুশীলন করা
(খ). সংগঠণগতভাবেঃ
১. প্রশিক্ষণ
২. সাধারণ শিক্ষা ও বয়ষ্ক শিক্ষা
৩. পাঠচক্র
৪. কর্মী ও দলীয় সভায় ইস্যুভিত্তিক আলোচনা
৫. গণসংস্কৃতি চর্চা
– গণসংগীত
– গণ নাটক
– গণ মেলা
– লোকজ যাত্রা ইত্যাদি
৬. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন
৭. সমাবেশ
৮. অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অনুশীলন

(গ). রাষ্ট্রীয়ভাবেঃ
১. গণমাধ্যমগুলোতে ঐতিহ্যনির্ভর ও জীবনঘনিষ্ট ইস্যুর প্রচার
২. বিজ্ঞানমনষ্ক বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার
৩. বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় আইনের অপনোদন, সমতামূলক আইন তৈরি, আইনের কার্যকর প্রয়োগ
৪. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জবাবদিহিতা ও গণতান্ত্রায়ন

আজকের যে শিশু – সে একদিন বড় হবে। সমাজের কোন না কোন পর্যায়ের সে নেতৃত্ব দিবে। তাই আমরা পরিবার হতেই যদি ইতিবাচক বা জীবনমূখী মূল্যবোধগুলোর চর্চা শুরু করি – যাতে শিশু বয়স হতেই সে ইতিবাচক মূল্যবোধগুলো চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। সাধারণতঃ ছাত্র-ছাত্রীগণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে থাকে। তাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত। তাছাড়া গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, গান, নাটক, প্রবন্ধ, পত্র-পত্রিকা, গণমাধ্যমের ফিচার, বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে জীবনমূখী মূল্যবোধের প্রকাশ থাকতে হবে। কোন শিশুই মাদকাশক্ত, সন্ত্রাসী তথা খারাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। সামাজিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কেউ খারাপ পথে আবার কেউ ভাল পথে আগায়। । সিভিল সোসাইটিকে, সমাজের দায়িত্ববাহকদের এ ব্যাপারে বিরাট একটা ভূমিকা পালন করা উচিত। তার আগে তাদেরকেও এই উন্নয়নমূখী মূল্যবোধ লালন এবং পালন করতে হবে।

আমরা যদি সমাজ পরিবর্তনের কথা বলি তবে পরিবারকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশের সকল পরিবারের সদস্যগণ যদি পজিটিভ মূল্যবোধগুলি লালন করে তাহলে এই সোনার বাংলার রূপটা আরো সুন্দর হবে। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল- ইংল্যান্ডের এক ভদ্রলোক সমাজটাকে পরিবর্তনের জন্য অনেক চেষ্টা করলো। কেউ কেউ তার কথা শুনলো কিন্তু বাকীরা তার সামনে বললো ঠিক আছে মেনে চলবো আসলে তারা তা চর্চা করলো না। তাতে তিনি খুব কষ্ট পেলেন। তিনি একদিন মনে করলেন, ঠিক আছে আমি আমার বাড়ির আশে পাশে যারা আছে তাদেরকে বুজাবো। সেই কথামত সে কাজ করলো। কিন্তু হায়! বড়জোড় দু ’একজন শুনলো। একদিন উক্ত ব্যক্তি চিন্তা করলো আমি সবচেয়ে বড় ভুল কি করেছি? কি বড় ভুল করেছি? সে একদিন খুঁজে পেল তিনি তার পরিবারে এধরণের কোন কথাই আলোচনা করেন নাই। পরিবারে মত প্রকাশের স্বাধীনতা তিনি দেন নাই। তাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তিনি গড়ে তোলেন নাই। তাদের জন্য সামান্য সময় তিনি দেন নাই। শেষ বয়সে তিনি পরিবারের সকল সদস্যদের কাছে যখন ফিরে গেলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তার সকল সন্তান তাদের মতো করে বড় হয়েছে, পজিটিভ ভ্যালুজের চেয়ে নেগেটিভটাই তারা রপ্ত করেছে অনেক বেশি।
তাই আর দেরি নয়, এ ব্যাপারে নিজেরা / পরিবারে/ স্কুলে/কলেজে/পাড়ায়/বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে/কর্মস্থলে ইতিবাচক মূল্যবোধের চর্চা করি এবং অন্যকে এই মূল্যবোধগুলো চর্চা করতে সহযোগিতা করি। আমরা যদি শিশুর সামনে মিথ্যা কথা বলি , প্রতারনা করি, খারাপ আচরণ করি, শিশু তাই শিখবে, বিশ্বাস করবে এবং তা পালন করবে। আর যদি সকলকে আমরা ভালবাসি, সত্য কথা বলি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেই, প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা করি, দেশকে ভালবাসি, মাদককে না বলি, পরিবারে সকলের সাথে সুন্দর আচরণ করি, সন্ত্রাসকে ঘৃনা করি, ধনী -গরীব, ধর্ম-বর্ণ সকলকে সমান ভাবে দেখি, পরমত সহিষ্ণু হই, শ্রদ্ধ করি নিজের যা কিছু আছে তা দিয়ে দরিদ্রদের সাহায্য করি, কাজটাকে গুরুত্ব সহকারে করি, যার যার দ্বায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি তাহলে শিশুরা যেমন শিখবে ঠিক তেমনি বড়রাও নিজেদের মধ্যে তা লালন করবে এবং পালন করার চেষ্টা করবে। রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা নিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের আন্তরিক সদিচ্ছাই পারে উন্নয়নমূখী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা বর্তমান প্রজন্ম এই উন্নয়নমূখী মূল্যবোধগুলি যেমন চর্চা করবো ঠিক তেমনি আগামী দিনের প্রজন্মও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। আর এর মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের চাকাকে সচল করতে সচেষ্ট হই। আসুন আমরা সকলে মিলে শিশুদেরকে তথা যুবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করি ।

— উৎসর্গঃ সোনেলা পরিবারকে —

১৩৫৯জন ১৩৫৮জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ