- মাহতাব হোসেনের প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম ‘তনিমার সুইসাইড নোট।’ গত বছর প্রকাশিত এই গ্রন্থে যে চৌদ্দটি গল্প আছে, তার এগারোটিই উত্তমপুরুষে লেখা। ‘ফেরা’ ও ‘অনিকেত প্রান্তর’ নামের দুটি গল্প নামপুরুষে হলেও, যেই গল্পটি থেকে গ্রন্থের নাম দেয়া হয়েছে, সে-ই ‘তনিমার সুইসাইড নোট’ গল্পটার বর্ণনাভঙ্গি অন্যরকম। কারণ, লেখক এতে উত্তমপুরুষ থেকে সোজা নামপুরুষে চলে গিয়েছেন। অবশ্য, এটা সচেতনভাবে না-কি অবচেতনভাবে হয়েছে, তা লেখকই বলতে পারবেন।
যে কোনও লেখকের জন্য উত্তমপুরুষ আদর্শ বর্ণনাভঙ্গী। কারণ, পাঠকেরা সহজেই লেখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। এ জন্য বেশীরভাগ লেখক এটির ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু উত্তমপুরুষে লিখলে, প্রধান চরিত্রে অতিকথন এসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই গ্রন্থের ‘যূথীর দুপুরবেলা’ গল্পটিতে এই ব্যাপারটি ঘটেছে।- মাহতাব হোসেনের গদ্য সুখপাঠ্য। নিজের মত করেই লিখেছেন গল্পগুলো। গ্রন্থটির ভূমিকায় সেই স্বীকারোক্তি আছে। তার গল্পগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দৈনন্দিন জীবন। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে যায় মফস্বল। যা পড়তে ভাল লাগে। গ্রাম থেকে শহরে আসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য কোচিং করা, সিনেমা হলে যাওয়া, টিউশনি করানো, ছাত্রীর শিক্ষকের প্রতি মুগ্ধতা, অভিভাবকের আন্তরিকতা, স্কুলফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হওয়া; চারপাশে ছড়ানো এইসব উপকরণই লেখক নিজের মত করে আহরণ করেছেন। দুর্বোধ্যতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণে গল্পগুলো নস্টালজিয়াকে সামান্য উস্কে দিয়ে যায়।
- এই গ্রন্থে প্রচুর নারী চরিত্র আছে। বিশেষ করে ‘স্নিগ্ধার টেলিফোন’ গল্পটির কথা বলা যায়। এখানে স্নিগ্ধা একই সঙ্গে দুজনের সঙ্গে প্রেমের সম্ভাবনা রেখেছে। কিন্তু লেখনীর কারণে মনে হবে, এ’রকম হতেই পারে। উদাহরণ হিসেবে ‘অনিকেত প্রান্তর’ গল্পটির নাম নেয়া যায়। এটি পড়ার পর শায়না বেগম ওরফে বাটুলের মা জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠবেন। এখানে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে পড়ে থাকা একটি লাশ নিয়ে যে গল্পটি বলা হয়েছে, তা সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর। পাঠক গল্পটি পড়ার পর, শেষদিকে এসে বাটুলের পরিণতি আবিস্কার করে চমকে যাবেন। এবং বুঝতে পারবেন, গল্পকার প্রথম থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলেন। একটি ভাল গল্পের জন্য সফলভাবে প্লট নির্মান করা জরুরী। কারণ, অনিশ্চয়তা, পূর্বাভাস, স্মৃতিচারণ, গল্পের কাঠামো, সমাপ্তি মিলিয়েই গল্প জমে ওঠে। ‘অনিকেত প্রান্তর’ গল্পটিতে তার অনেকখানিই ছিল। এ কারণে এটিকে গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ গল্পও বলা যায়।
- ‘ফেরা’ গল্পটির প্লটটা গ্রামের। নামপুরুষে লিখলেও গল্পটিতে বৈ-সাদৃশ্য চোখে পড়ে। বিশেষ করে, লেখক গল্পটা জমিয়ে তুলে যখন শেষের দিকে এগিয়ে যা-ন, তখন তা গল্প থেকে বেরিয়ে আসে। কারণ, এই পর্বে এসে লেখক তার গল্পের ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেন। তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও এর সেটিংস’টা অন্যরকম। শুধু এটিই নয়, বেশীরভাগ গল্পের সেটিংস বেশ ভালো। এই দিক থেকে গ্রন্থের শেষ গল্প ‘মাতসুমি ফ্রম জাপান’ খানিকটা আলাদা।
- মাহতাব হোসেন গল্পের ভেতর স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করেন। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘আমার চোখে সমুদ্র জল’ এ তিনি লিখেছেন, ‘একবার মিরপুর এক নম্বরের চাইনিজে একটা বিয়ের দাওয়াত ছিল।’ এটা পড়তে গিয়ে কোনও অস্বাভাবিকতা ঠেকবে না। কিন্তু বারবার এই স্টাইল ব্যবহার করলে গতি হারানোর সম্ভাবনা থাকে।
ষোল’র বইমেলায় প্রকাশিত এই গ্রন্থটি পাঠকেরা গ্রহণ করেছিলেন। যার কারণে মাত্র তেরো দিনেই প্রথম মুদ্রণ ফুরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এর প্রকাশক ‘অনুপ্রাণন প্রকাশন’ চোদ্দটি গল্পতেই প্রচুর অযত্নের ছাপ রেখেছেন। যার কারণে গ্রন্থটির অঙ্গহানি হয়েছে।- ‘তনিমার সুইসাইড নোট’ মাহতাব হোসেনের উত্থানসংখ্যা। এ কারণে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা উচিত নয়। তারপরেও লেখক হিসেবে তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি নিয়ে বলি; সেটা হল, তার হাতে নারী চরিত্রগুলো বেশ নিরাপদে থাকে। যা আমাদের আগামীর দিকে উৎসাহিত করতে সাহায্য করবে।
- ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬
৬টি মন্তব্য
অলিভার
মাহতাব সমুদ্রের লেখার সাথে পরিচয় হয় “সামহয়্যার ইন ব্লগ”-এ। তারপর ধীরে ধীরে সবার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ব্যক্তিগত ব্যস্ততা, ব্লগিং এবং ব্লগারর্স ঝামেলা, ব্লগের ঝামেলা সব মিলিয়ে অনেক জনপ্রিয় ব্লগারই ব্লগ বিমুখ হয় সেখান থেকে। তবে মাহতাব সাহেব হারিয়ে যান নি। সামহয়্যার ইন ব্লগ থেকে তার শক্ত অবস্থান তৈরি হয় তার ফেসবুকের ব্যক্তিগত প্রোফাইলে। তার কথার যাদু তার গল্পকারে প্রকাশিত হতে থাকে সেখানেও।
তার লেখাকে আপনি চমৎকার ভাবে বিশ্লেষন করেছেন। হয়তো একজন সঠিক সাহিত্য বোদ্ধা মাত্রই এমনটি করবেন। তবে আমাকে তার লেখার যে অংশটা আকর্ষন করে তা হল তার সহজাত স্বাভাবিক বচনভঙ্গী। তার লেখা গুলি যেন তার মতই সাধাসিধে এক ছেলেকে ঘিরে থাকে। মাঝে মাঝে যদিও দু’একজন নারী চরিত্র প্রধান চরিত্র হিসেবে গল্পে দেখা যায়, তবুও সেখানে তার লেখার এই ছন্দের কোন পতন তেমন চোখে পড়ে না।
“তনিমার সুইসাইড নোট” বইটি পড়েছি। প্রতিটি গল্পই ভালো লেগেছে। খুব বেশি অতিকথন কোনটাই মনে হয়নি। যদিও এটি একটি গল্প গুচ্ছ। তবুও ‘তানিমার’ গল্প হতে ‘অনিকেত প্রান্তর’ গল্পটাই আমাকে বেশি আকর্ষন করেছে। গল্পটা পড়ার পুরোটা সময়ই মন ব্যথিত ছিল, আর গল্পের শেষে এসেও যেন ব্যথায় মন আরও ভার হয়েছে। তবে তানিমার গল্পটির জন্যে লেখক ধন্যবাদ পেতেই পারে। আর সকলেই যখন এমন পরিস্থিতিতে নেগেটিভ একটা সিদ্ধান্তে গল্পের সমাপ্তি টানে সেখানে মাহতাব সাহেব গল্পটির পজিটিভ অংশটাই চিত্রায়ন করেছেন। পরে অবশ্য জেনেছিলাম যে এই পজিটিভ হবার ব্যাপারে ‘আপের মাহমুদ’ সাহেবেরও কিছু হাত রয়েছে।
আপনার রিভিউটি দারুন হয়েছে। আশা করছি রিভিউটি পড়বার পর অনেকেই গল্পগুলিকে জানার জন্যে আগ্রহী হবে 😃 😃
নাজমুস সাকিব রহমান
একেকজনের পাঠরুচি একেকরকম। আপনাকে ধন্যবাদ এমন মন্তব্যের জন্য। আজকাল পরিশ্রম অনুপাতে মন্তব্য পাওয়া যায় না। এখানে আমার লেখার চারটি লাইন তুলে দিচ্ছি। কারণ আপনি সহজাত বচনভঙ্গির কথা বলেছেন।
‘মাহতাব হোসেনের গদ্য সুখপাঠ্য। নিজের মত করেই লিখেছেন গল্পগুলো। গ্রন্থটির ভূমিকায় সেই স্বীকারোক্তি আছে। তার গল্পগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দৈনন্দিন জীবন।’
এই বইটি আমি বইমেলা থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। পরে একজন নিয়ে যায়, স্বাভাবিকভাবেই আর ফেরত দেয়নি। এ কারণে এটি নিয়ে লিখতে দেরী হয়েছে। ফেনীর এক বড় ভাইও বইটি কিনেছিলেন। আমার প্রয়োজন দেখে তিনি কুরিয়ারে করে তার কপিটি পাঠিয়েছেন। কিছুদিন আগে ঢাকা গিয়েছিলাম। যাত্রা পথে ট্রেনে বসেই আমি বইটি পড়া শেষ করি। তারই একটা পাঠঅভিজ্ঞতা তুলে ধরেছি লেখাটিতে। আর এই লেখাটি পড়ে কেউ যদি গল্পগুলো নেড়েচেড়ে দেখে, তাতে ভালই হবে।
শুভেচ্ছা নেবেন।
অলিভার
-{@ -{@
মৌনতা রিতু
আপনার লেখক ও বই পর্যালোচনাতে বইটি পড়ার ইচ্ছে জাগল। যদিও আমি ইদানিং এসব বই পড়ার আগ্রহ পাইনা। তবু পড়ব আশা করি। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব এখন আমার অতি প্রিয়।
তবে এ কথা অতি সত্যি, লেখা কিন্তু এতো সহজ কথা নয়। এর জন্য দরকার সময়, সৃষ্টিশীল উদার মানসিকতা। তাই যে যাই লিখুক না কেন তা তার সৃষ্টিশীল মানসিকতার প্রকাশ।
এবার বইমেলায় উন্মুক্ত বই কিনব। ইনশাল্লাহ্।
নীলাঞ্জনা নীলা
এতো সুন্দর রিভিউ লেখেন আপনি কি বলবো!
এখানে বইটির অবশ্যই খোঁজ করবো। কারণ ইচ্ছেটা মনে বেশ জোরসে অবস্থান করে নিয়েছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
অপার্থিব
রিভিউ ভাল হয়েছে। রিভিউয়ের সাথে বইয়ের প্রকাশনী, মুল্য ও পৃষ্ঠা উল্লেখ করে দিলে ভাল হত।