ইচ্ছে পূরণ

নাজমুল আহসান ৬ অক্টোবর ২০১২, শনিবার, ০৯:৪৬:৪৭অপরাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

জীবনে কখনো এমন সিদ্ধান্তহীনতায় পড়িনি। টুটুল যেটা বলছে সেটা কোনোমতেই মানতে পারছি না আমি। অথচ এরকম সময়ে ওর অনুরোধ রাখব না, এটা ভাবতে গেলেও খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে ছুটে বেরিয়ে যাই এই ফিনাইলের গন্ধভরা ঘরটা থেকে। পারছি না, টুটুল আমার হাত চেপে ধরে আছে।

গত অক্টোবরে ওর ক্যান্সার ধরা পড়ে। শুরুর দিকে ওকে জানাইনি। কিন্তু বেশিদিন চেপে রাখা গেল না, ও জেনে ফেলল। এরপর সাধারণত যা হয়, জানার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লো ও। দুইতিনদিনের মাথায় হসপিটাল চেঞ্জ করে এখানে আনা হল। দেশের সেরা হসপিটাল, টাকার জোরে সুচিকিৎসা হচ্ছিল। কিন্তু ছেলের পিছনে সব ঢেলে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলেন আংকেল, ওর বাবা। ভিটেমাটি সব বিক্রি করে দিলেন। আংকেল ব্যবসা করতেন, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে একদিন ফোন দিলেন, রাতে। তারাতারি মালিবাগ যেতে বললেন। টুটুলকে হসপিটালে নেওয়ার পর থেকে আন্টি ওখানেই আছেন। টুটুলের মামার বাসা। আংকেল ঢাকা-খুলনা ছুটাছুটি করেন। এতো রাতে যেতে বললেন, আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম।

মালিবাগে পৌঁছলাম রাত সাড়ে ন’টার দিকে। আংকেল আমাকে ডেকে পাশে বসালেন। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছি।
-‘বাবা শোন, তুমি টুটুলের কাছের ফ্রেন্ড, কথাগুলো তোমাকেই বলি।’
আমার ভয় আরও বেড়ে গেল, কী বলতে চাচ্ছেন আংকেল। প্রায় ফিসফিস করে বললাম ‘জ্বি, বলেন।’
-‘আমি কাল রাতে খুলনা থেকে আসছি। আজ সারাদিন হসপিটালে ছিলাম, এই একটু আগে এখানে এলাম। ফ্রেশ হয়েই তোমাকে ফোন দিলাম। আসতে চাচ্ছিলাম না, তোমার খালাম্মা জোর করে পাঠিয়ে দিল। সারারাত জার্নি করে আসায় শরীরটাও টায়ার্ড ছিল, তার উপর সারাদিন হসপিটালে!’
আমি বুঝতে পারলাম আংকেল কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। অপ্রয়োজনীয় কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইছেন। বললাম- ‘নতুন কোন খবর আছে আংকেল?’
আংকেল মনে হল দিশা পেলেন। ‘হ্যা, বাবা। তুমি তো সব জানো। আমার ব্যবসা, জমিজমা সব গেছে। ছেলের জন্যে জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি, তাতে তো লাভ হবে না বাবা। আজ শেষ যে সম্বল ছিল, সেটাও বিক্রি করে দিলাম। পালানের একটু জমি ছিল আর ঘর সহ দোকানের জমিটা।’
-‘ও!’ আমি বলার কিছু খুঁজে পেলাম না।
-‘এই টাকায় সপ্তাহখানেক চলবে, তারপর কী করব বাবা?’ আংকেল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখ মুছলেন। আমি জানি এটা ভয়াবহ সমস্যা। ইতোমধ্যে বড় অংকের ঋণ নিয়েছেন ব্যাঙ্ক থেকে, সম্পদ-সম্পত্তি বলে তো কিছু থাকল না। এই ঋণ শোধ করবেন কীভাবে! আর টুটুলের চিকিৎসা-ই বা চলবে কীভাবে! আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারছি না। টুটুল ছোটবেলা থেকে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ওর জন্যে কিছু করতে পারছি না, কষ্টে বুকটা ব্যথা করতে লাগলো।

হলে ফিরলাম রাত ১২টা নাগাদ। পুরো রাস্তাটা কাঁদতে কাঁদতে এসেছি। কাউকে বলে কোনো হেল্প পাবো এরকম মনে হল না। তারপরও সকালে কামাল ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। মাস্তান টাইপের কামাল ভাই হলে আছেন ৭-৮ বছর, আদুভাই কিসিমের মানুষ। সব শুনলেন, কিছু বললেন না। দুইদিন পর কামাল ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। টুটুলের সাহায্যার্থে কনসার্ট হবে, তবে একটু দেরি হচ্ছে। কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নুয়ে এল আমার। এরপর জানুয়ারির শুরুতে কনসার্ট হল।বেশ টাকা এল হাতে।

পরের সপ্তাহে একটা মোটা অংকের টাকা নিয়ে টুটুলের কাছে গেলাম কামাল ভাইকে নিয়ে। কামাল ভাই টুটুলকে চিনতেন না, অথচ যখন টুটুলের মাথায় হাত রেখে বললেন-‘চিন্তা করো নাই ভাই, সব ঠিক হয়ে যাবে!’, আমি অবাক হয়ে গেলাম। কামাল ভাইয়ের চোখে আমি যে স্নেহ আর ভালবাসা দেখলাম তার তুলনা হয় না। কামাল ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, আমি থেকে গেলাম। এরপর নানা ব্যস্ততায় দুইতিন দিন হসপিটালে যাওয়া হয়নি।

‘এই, কী ভাবিস?’ টুটুল আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল।
-‘হ্যা, বল।’
-‘বললাম তো!’ টুটুল বলেছে, কিন্তু যেটা বলেছে সেটা হয় না। ওর ধারণা ও বাঁচবে না, অযথা এতোগুলো টাকা নষ্ট করার কী দরকার! আমাকে প্রস্তাব দিয়েছে টাকাগুলো শীতার্তদের সাহায্যার্থে দিয়ে দিতে। এটা কোনও কথা হল?
-‘দোস্ত, আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করবি না তুই?’ আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলাম। কী করব এখন! ডাক্তার যা বলেছেন তার অর্থও এটাই দাড়ায়, টুটুল বাঁচবে না। তাই বলে ওর প্রস্তাব মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু বন্ধুর শেষ ইচ্ছে পূরণ!শেষ পর্যন্ত ওর জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেলাম।
-‘আর শোন, কামাল ভাই টাকা দিয়ে গেছেন এটা কেউ জানে না। তানহা জিজ্ঞেস করেছিল কনসার্টের ব্যাপারে, আমি কিছু বলিনি। ’ তানহা টুটুলের গার্লফ্রেন্ড, আমাদের এক বছরের জুনিয়র।
-‘তো কি হয়েছে?’ ও কী বলতে চাচ্ছে অনুমান করতে পারছি।
-‘প্লিজ দোস্ত, কাউকে বলবি না। বাবা-মাকে তো অবশ্যই না, তানহাকেও না।’
প্রতিবাদ করতে চাইলাম, কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। মনটা খচখচ করতে লাগলো। ওকে বলে এলাম ব্যবস্থা করে ওকে জানাব। বাইরে বেরুনোর সময় দেখলাম তানহা, রিসিপশনের মেয়েটার সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখে হাসল, আমি দেখলাম বন্ধুর প্রেমিকার চোখে কষ্টের ছোপছোপ রক্ত!

ভার্সিটিতে গিয়ে খোঁজ নিলাম। শীতার্তদের সাহায্যে চতুর্ভুজ নামের ছাত্রদের একটা দল উত্তরবঙ্গে যাবে, আগামিকাল দুপুরে রওয়ানা দেবে। ওদের সাথে কথা বলে আবার হসপিটালে এলাম, চতুর্ভুজের লিডার ছেলেটা আমার সঙ্গে এল। টুটুলকে সব জানালাম। কথা পাকা হল, কাল সকালে ওদের অফিসে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে।

***

সময় দুপুর সাড়ে ১২টা। আমার হাতে একটা স্লিপ। চতুর্ভুজে টাকা জমা দিয়েছি, তার রশিদ। টাকাটা দিয়ে সোজা হসপিটালে চলে এসেছি, মিনিট বিশেক লেগেছে। ৯০৪ নম্বর কেবিনের দরজাটা হাট করে খোলা। আমি ভিতরে ঢুকিনি। বাইরে থেকেই দেখতে পেলাম তানহার পাথরের মত নিশ্চুপ মূর্তি। আন্টি কেবিনের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন, কয়েকজন নার্স তাঁকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে। আমার সামনে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আংকেল ভিতরে ঢুকলেন। হারুন মামা আর অপরিচিত একটা লোক তাঁকে ধরে ফেলল, আংকেল জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। আমি এখান থেকে টুটুলের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, মুখে তৃপ্তির হাসি।

টুটুল মারা গেছে ১২টা ১০মিনিটে; আমি হিসেব করলাম ঠিক যখন টাকাটা আমি চতুর্ভুজকে দিয়েছি, তখন।

৭০০জন ৬৯৮জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ