আমি একটি গ্রুপের এডমিন প্যানেলে রয়েছি বেশ কিছুদিন যাবত। গ্রুপটি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি জ্ঞানচর্চার একটি প্লাটফর্ম।
পৃথিবীর ১৯৩ টি স্বাধীন দেশের মাঝে কিছু দেশ বাদে প্রায় সকল দেশের কিছু কিছু নাগরিক গ্রুপটিতে রয়েছেন। সেখান থেকে অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি। পাশাপাশি অনেক কিছু অনুধাবনও করতে পেরেছি।
প্রথমেই আসি এডমিন প্যানেলের প্রসঙ্গে। সেখানে একেকজন মানুষ একেক দেশের। যিনি প্রধান এডমিন তিনি একজন আমেরিকান। গ্রুপের সদস্যদের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করে সদস্যদের মধ্য থেকে এডমিন নিয়োগ দেন। তাঁর আচরন অত্যন্ত ভালো। কোন প্রকার বিনয়ের ঘাটতি নেই। তাছাড়াও রয়েছেন এক ঝাঁক এডমিন/ মডারেটর, যারা একেকজন একেক রকম,একেক দেশের, একেক বয়সের।কিন্তু সবার মাঝেই রয়েছে আন্তরিকতা।
এবার আসি সদস্যদের কথায়। সদস্যরা আগেই বলেছি নানান দেশের। তাঁরা সবাই এখানে নিজ দেশের সম্মান বজায় রাখার চেষ্টা করেন। সাধারনত কেউ এমন কোন আচরন করেন না, যেটার জন্য তার দেশের মান সম্মান নষ্ট হয়, বাকিদের মনে তার এবং তার দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়। সপ্তাহে একটা মিউট, মাসে হয়ত একটা ব্যান করতে হয়। কোন কোন সপ্তায়/মাসে এমনো হয় যে কোন সদস্যকেই মিউট/ব্যান দিতে হয় না।
***তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে তখন, যখন দেখি মাসে একটাই ব্যান করতে হলো, তাও আবার সেটা আমার স্বজাতীকে!!! প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাবির ইংরেজি বিভাগের এক ছেলে (ইনফোতে মিথ্যাও লিখতে পারে) সেদিন একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না বলে পোস্টদাতাকে গাল দিচ্ছে Mother f***r!!! কী অদ্ভূত আচরন! পোস্টদাতা ছিলেন একজন ভীনদেশী এডমিন, তিনি চুপচাপ ব্যান দিয়ে চলে গেছেন। আমি গিয়ে কমেন্টটা ডিলিট করলাম, করার সময় তার বায়োটাও দেখলাম সে বাংলাদেশী! এরকম বেশ কিছু লোকজনকে আমিই গ্রুপ থেকে বের করে দেই গালি গালাজ করার জন্য, যাদের বেশির ভাগ আমারই স্বজাতি! কতটা যে লজ্জা হয়, কতটা অপমানিত হই, এটা কেবল আমিই তখন বুঝি! (যদিও এডমিনদের কেউ কখনো এটা নিয়ে আমাকে কিছু বলেন না।)
ইউটিউবের বিভিন্ন লিঙ্কে গেলে দেখা যায়, অন্য দেশের মানুষ গঠনমূলক সমালোচনা করে, আর বাঙালি নোংরা গালাগাল দিয়ে কমেন্ট করে! পত্রিকার পেইজগুলোতে দেখা যায়, কোন ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় গালিগালাজ। কমেন্টে গালির ঝড় ওঠে। এমনকি, কোন মেয়ের নাম্বারে ফোন দেয়া হলো, মেয়েটি চিনতে না পেরে কথা বলতে চাইলো না, ম্যাসেজে দাও গালি। সেদিন পথ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় লক্ষ্য করলাম, স্কুল ড্রেস পরিহিত ২/৩ টা ছেলে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। তাদের গল্পের একটাই লাইন, “ঐ ন*র পুত, তুই বল,হিহিঃ হাহাঃ ” অথচ কেউ কোন প্রতিবাদ করছেনা কেন একজন মাকে, একজন ভদ্রমহিলাকে কথায় কথায় ন* বলে নোংরাভাবে সম্বোধন করা হচ্ছে!
মাঝে মাঝে কিছু নিউজ শুনি বাঙালি অমুক দেশে রেইপ করেছে, তমুক দেশে ছিনতাই করেছে, ২ নম্বরী করেছে, এখন জেলে আছে! এরা কি কোনদিন বদলাবে না? এরা কি আজীবন এমনই থাকবে? কোনদিন কি নিজের তথা দেশের সম্মান বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে না? দেশকে আর কত ডিজিটাল করতে হবে এদেরকে সহবৎ শেখাতে?
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এই যে শিশু, কিশোর, যুবক সমাজ এভাবে নোংরা ভাষা আর গালিগালাজে অভ্যস্থ হয়ে পরছে, তার কারন কি? কি কি কারন থাকতে পারে এর পেছনে? কিভাবেই বা এর থেকে মুক্তি মিলবে? এটা কি আমাদের দেশের জন্য তথা বাংলা ভাষার জন্য হুমকি স্বরূপ নয়?
আবার ইতিহাস ঘেঁটে শান্তি পাই,আমরাই সে জাতি, যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। পরক্ষণেই মনে পড়ে, আমরাই সে জাতি যারা ভাষাটাকে নোংরা গালিতে ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এর থেকে মুক্তির উপায় কি? কিভাবে গঠন করা যায় একটি ভদ্র সভ্য সমাজ?
২১টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
লেখাটা পড়ে খারাপ লাগল।আসলে আমরা এমন কেন?আমরা অন্যের উপর প্রভাব বা দোষ দিতে খুব পারদর্শী অথচ ভাবিনা নিজে কেমন বা কতটা জ্ঞানী।লেখাটা চমৎকার হইছে।আপনি খুব ভাল একটা গ্রুপে এড এবং এডমিনে আছেন।আমাকেও এড করিয়েছেন সে জন্য ধন্যবাদ।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তবে এর থেকে মুক্তির উপায় বের করতে হবে, নয়ত এটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে
মাহমুদ আল মেহেদী
মানুষ তার অসভ্যতার প্রকাশ ঘটায় গালির মাধ্যমে। এতে যে সবচাইতে খুঁশি হয় শয়তান বেচারা তা আমরা বুঝিনা । ভালো লাগলো লেখাটা অনেক।
নীরা সাদীয়া
মানুষ গালি দিয়ে তাতে আনন্দ খুঁজে, বিকৃত রুচির বিনোদন।
ইঞ্জা
বড়ই দুঃখজনক এই দেশের মানুষ কত যে জংলি রয়ে গেল।
নীরা সাদীয়া
এদেরকে সভ্যতা শেখানোর কৌশল আবিষ্কার করা জরুরী।
ইঞ্জা
সমস্যা হলো এরা শিখেনা, ভদ্রতা শেখানো যায়না নিজে থেকেই শিখতে হয়।
সাবিনা ইয়াসমিন
দুঃখজনক। আর কথাগুলো একদম সত্যি। গ্রুপ ও পাব্লিক পোষ্টের কমেন্ট পড়লে প্রায় সময়ে এটা দেখতে পাই। সুগঠিত মন্তব্য করার চেয়ে কিছু মানুষ গালাগাল আর হাস্যকর মন্তব্য দিয়ে নিজেরাই নিজেদের নিন্ম মানুষিকতার পরিচয় দিতে থাকে। আর পথে–ঘাটে বাস্তব জীবনেও তারা এগুলো বর্জন করতে পারে না।
আমাদের দেশে অক্ষর জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু ভাষার ব্যবহার আর জন– জীবনে শিক্ষার প্রভাব ঠিকমতো কাজে আসছে কম। অসভ্যতা থেকে যেদিন এই জাতি সঠিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারবে সেদিনই আমরা নিজেদের গর্বিত জাতি ভাবতে পারবো।
সমসাময়িক অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন, ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে।
ভালো থাকুন। শুভ কামনা ও ভালোবাসা রইলো। ❤❤
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। এর থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে একদিন আলোচনা হোক।
তৌহিদ
আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
নীরা সাদীয়া
অবশ্যই পরিবর্তন দরকার। শুভ কামনা জানবেন।
জিসান শা ইকরাম
পুরোই হতাশ আমি দেশের মানুষ নিয়ে,
এরা দেশের মান সন্মান নিয়ে ভাবে না, দেশাত্মবোধে এদের মধ্যে নেই। বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে আশা জনক কিছু পাওয়া যাবেনা।
এর সমাধান কি তাও জানিনা।
নীরা সাদীয়া
দাদা, এর থেকে পরিত্রানের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। এটা নিয়ে ব্লগে একদিন আলোচনা হতে পারে।
মোঃ মজিবর রহমান
লেখাটা বাস্তবতায় ভরপুর আপু। কিন্তু কিভাবে এখান থেকে মুক্তি জানিনা। এর অনেক কারন আছে। তাঁর মধ্যে প্রধান কারন হল, পরিবারের মাঝে এই বিষয়ে শাসন বা আদব, উপদেশ, গুরুজন/মুরুব্বিদের মাঝে এখন শিক্ষার বড়ই অভাব।
১. আমরা সন্তানদের নকল করার উপদেশ দিই এবং নকল কিনে তা করার মত অতি জঘন্য অপরাধ আমরা অভিভাবক রা করি।
২. আর এর জন্য ঘুষঘোরজাতিই দায়ী। কারন টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়া যায়।
৩. এখন একক ফ্যামিলিতে বাবা-মা না(বাবা-মা চাকরিজীবী হোলে) থাকায় ছেলে-মেয়েরা ডিজিটালে চলে শেখে।
৪. কাজের বুয়া/ছেলের কাছে ছেলে-মেয়ে রেখে গেলে কতটুকু অ্যাডোব জাগ্রত হবে?
৫. আমাদের ঢাকা শহরে অনেক ফ্যামিলিতে আছে বাবা-মা বাচ্চার সামনে একে অপরকে গালিগালাজ করে।
৬. আমার একজন শিক্ষক বলেছিলেন, “বাবা যদি রাত বারোটার পর বাসায় ফেরে ছেলে তো রাত একটার পর ফিরবেই।” (কাজ বাদেও অনেক বাবা অকাম কুকাম করে বাসায় ফেরে তাঁদের জন্য।)
৭. বাবা যখন ঘোরে বসে মদ খেয়ে মাতলামী করে ছেলে উচ্ছুন্নে যাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নায়।
৮. সরকারের মাঝে দিয়ে , শিক্ষকের মাঝে দিয়ে , মুরুইব্বিদের মাঝে দিয়ে, বড়ভাইদের মাঝ দিয়ে( একজন ছেলে বা একজন মেয়ে ) শিক্ষার একটা ছিল তা আজ উঠে গেছে।
আরো এরকম আছে বলে লাভ কি আপু।
নীরা সাদীয়া
আপনি অনেকগুলো পয়েন্ট তুলে ধরেছেন।এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। প্রতিটি কথাই খুব সত্য।
অপার্থিব
//আমরাই সে জাতি যারা ভাষাটাকে নোংরা গালিতে ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি//
পৃথিবীর সব ভাষায় গালি আছে এবং সব জাতির মানুষ রাগ, ক্ষোভ, ঈর্ষায় কিংবা অন্য কোন কারনে কাউকে মানসিক শাস্তি দিতে গালি ব্যবহার করে। আপনি হয়তো বলতে পারেন এদেশের যুব সমাজের মত আর কেউ এভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে না। আপনার বুঝতে হবে যে সোশাল মিডিয়া বা ফেসবুক হচ্ছে এই মুহূর্তে দেশের মানুষের প্রধান বিনোদন মাধ্যম । এদেশের তরুণ সমাজের হাতে এখন বিপুল অবসর সময়, এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে শিক্ষিত বেকারত্বের হার বৃদ্ধি। জীবনের প্রতিদ্বন্দীতায় পিছিয়ে পড়া এই হতাশা গ্রস্থ প্রজন্ম একটু বিনোদনের খোঁজে ফেসবুকে আসে। তারা গালি দিয়ে বিনোদন পায়, এমনকি বিনোদন পায় গালি শুনেও। যাপিত জীবনের সব ক্ষোভ হতাশা তারা ভার্চুয়াল লাইফের তর্ক বিতর্ক আর গালি গালাজের মধ্যে উগড়ে দিয়ে এক ধরনের মানসিক শান্তি নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। অন্য দেশের সাথে কম্পেয়ার করতে গেলে এই আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার পার্থক্যের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে।
নীরা সাদীয়া
ভাই, নোংরা ভাষা ব্যবহারের পেছনে অনেক এক্সকিউজ দেয়া যায়, কিন্তু এটা কোন সমাধান হলো না। এদের ব্যক্তিত্বে সমস্যা রয়েছে। তাই জাতিকে ঠিকপথে ফেরাতে হবে।
আর হ্যাঁ, বেকারত্ব সত্যিই একটা ভয়াবহ সমস্যা। এটার থেকেও মুক্তির পথ খুঁজতে হবে।
নিতাই বাবু
যাক! আমার দুঃখের কথাটা দিদির পোস্টে এবার বলা যাবে নিশ্চয়! ইউটিউবে বাঙালি ভাইয়েরা যেসব মন্তব্য করে থাকে, তা আর ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ইউটিউবে আমার একটা চ্যানেল আছে। সেখানে আমার আপলোড করা অনেক ভিডিও আছে। গত দুইবছর আগে নারায়ণগঞ্জ শ্মশানঘাট থেকে দাহ করার একটা ভিডিও ধারণ করি। তারপর ভিডিওটা সামান্য এডিটিং করে সাথে একটা ভক্তিমূলক গানে সংযোজন করে ইউটিউবে আপলোড করি। সেই ভিডিওটা প্রায় দুই লক্ষ ভিউয়ার হয়ে যায়। আর মন্তব্য, হয়েছে প্রায় পাঁচশত মতন। হায়রে মন্তব্য! কি যে গালাগালি, ফালাফালি, মালাউন, ছাড়াল ইত্যাদি ইত্যাদি বলে।শেষতক সেই ভিডিওটা আমি নিজেই ইচ্ছায় ডিলিট করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারপর ইউটিউব আমাকে নোটিশ জারি করল, আমি জবাব দিলাম। ইউটিউব আমার জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এরপর ইউটিউব আমাকে ভিডিও ডিলিটের জন্য তিনমাসের অবরোধে রাখল। আমি এই তিনমাসে আর কোনও ভিডিও ইউটিউবে দিতে পারিনি। আমরা সেই বাঙালি দিদি। নিচে আমার চ্যানেলের লিংক দিলাম, দেখবেন আশা করি।
https://m.youtube.com/my_videos?disable_polymer=true&csn=lPdyXJaoLsnUowP_wpOIBg
নীরা সাদীয়া
অনেক কষ্ট নিয়ে আপনি এটা লিখেছেন বুঝতে পারছি । আসলে আমাদের মাঝে সহনশীলতার খুব অভাব, ধর্মের লেবাসে অধর্মই হচ্ছে বেশি। এটাই মূলত সমস্যা।
শুন্য শুন্যালয়
গালাগালি দিয়ে স্ট্যাটাস দেয়া আজকাল আধুনিকতার প্রমাণ। ফেসবুক সেলিব্রেটিদের কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা গালাগালি শিখছে।
তবে এরা জানেনা সেগুলো কোথায় কোনটা ব্যবহার করতে হবে। শিখে যাবে, গালাগালি ব্যব্যবহারের সঠিক নিয়ম কোর্স চালু হলেই শিখে যাবে।
নীরা সাদীয়া
সামাজিক অবক্ষয় এর এই চূড়ান্ত পর্যায় থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে, আর এটাই উপুক্ত সময়। নইলে এসব গালাগালির ভিড়ে আমাদের প্রানের ভাষা, মিষ্টি বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে বহুদূরে।