আমাদের বাড়িটা দো’তলা। আজকাল এরকম বাড়ি খুব একটা দেখা যায় না। লোকেরা সামর্থ্য থাকলে পাঁচ তলার বিশাল অট্টালিকা গড়ে, মাসশেষে হাজার টাকা ভাড়া গুণেই শান্তি নেয়! কিন্তু আমাদের বাড়িটা একেবারে আলাদা। আমাদের ঘরের সামনে ছাদটুকুকে আমরা উঠোন হিসেবেই ব্যবহার করি।সেই উঠোনে দিনের শুরুতে সূর্যের আলো আছড়ে পরে। এরকম আবহাওয়াতে হু হু করে বাতাস বয়, দক্ষিণে একটা সজিনা গাছ আছে।গাছটার পাতায় উঠোনটা ছেয়ে যায়। রাতের ছাদটা আরো উপভোগ্য! বিশেষকরে চাঁদনী রাতে। মনখারাপের সময়টাতে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গোটা একটা রাত কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে।
আমাদের একটা বড় ঝুল বারান্দা আছে। বৃষ্টির দিনগুলোতে বারান্দাটা বৃষ্টির দখলেই থাকে। সেদিন আমার ছোট ভাইটার আব্দারে বারান্দাটার উত্তরে একটা মাটির ঘট ঝুলিয়ে দিয়েছি। তাতে কিছু খরকুটো দিয়ে রেখেছি। ও ভাবছে ওখানে নাকি চড়ুই বাসা বাঁধবে! কি পাগলামি! হ্যাঁ, কিছুদিন আগে কয়েকটা রঙ বেরঙের মাটির টবে কতোগুলো লতানো গাছ লাগিয়েছি। গাছগুলো বড় হয়েছে বেশ। বারান্দার গ্রিলটাকে আষ্ঠেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। সবুজ লতার ফাঁকে ফাঁকে গাঢ় গোলাপি ছোট ছোট ফুল উঁকি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ভুল করে দু একটা চড়ুই এসে বসে বারান্দাটায়। তা দেখে আমার ছোট ভাইটার কি যে আনন্দ…
আমাদের জানালাগুলো বেশ বড়। পূর্বের জানালাটা দিয়ে যেরকম সূর্য উদয়ের সময়ে রোদের সরু আলো উঁকি দেয়, পশ্চিমের জানালা দিয়ে দিন বাড়ার সাথে সাথে রোদের প্রখর তাপে উৎপাতও বেশ অসহ্য! তবে পশ্চিমের জানালা দিয়ে বিকেল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমাদের এদিকে এখনো বেশকিছু ধানক্ষেত দেখা যায়। অনেক গাছপালাও আছে। বিকেলে ধানক্ষেতের উপরে নানা রঙয়ের ফড়িং উড়ে। আমার খুব ইচ্ছে হয় খেতের আইলগুলোতে একা একা হাটতে। কিন্তু কিসব ভেবে যেন যাই না। হয়তো সারাদিন ক্লাস করে ফেরার পর ক্লান্তিটাই আমাকে গ্রাস করে ফ্যালে…
ওহ, আমাদের বাড়িতেদুটো আমগাছ আর একটা মেহদী গাছ আছে। এবার একটা গাছে একটা মাত্র আম ধরেছিলো। আম্মু বলেছে, দেখিস, এবার দুটো গাছেই আমের ধরবে। সেই কথা শুনে আমার ছোট ভাইটা এই সিজন থেকে আমের কুঁড়ি এসেছে কিনা তা নিয়ে মহাচিন্তায় থাকে!! একটা বিশাল টবে আম্মু কিছু লাউয়ের চারা বুনেছে।সেদিন দেখলাম মাটি ফুঁড়ে গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। তাই ছাদের একপাশে বাবা একটা জাংলা করে দিয়েছে , জাংলার লাউ নাকি দেখতে সুন্দর হয় !
আমার কিছু পাগল বন্ধু বান্ধব আছে। কয়েকদিন আগে এসেছিলো। ওরা বলছে এবার পরীক্ষার শেষে আমাদের বাসায় নাকি পিকনিক করবে। শিলা বলেছে, ওরা নাকি নিজের হাতে রান্না করবে। পাগলগুলোর এরকম কথা শুনে আম্মু হেসেই শেষ!
আমরা পাঁচটা মানুষ থাকি বাড়িটাতে। সত্যি বলতে কি, আমাদের সেরকম কোন আত্মীয়স্বজন নেই। তাতে কি, আমরা পৃথিবীর সবাচাইতে সুখী পরিবারের একটি। আমরা কেউ কারো কাছে কোন কথা গোপন করি না, গোপন করে রাখতেই পারিনা বলতে গেলে। সারাদিন তিন ভাইবোনের খুনসুটি, মাঝে আম্মুর সামান্য বকা; আমরা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করি ! রাতে যখন বাবা বাসায় ফেরে, সারাদিন যাবতীয় ঘটনার সারসংক্ষেপ বলার দায়িত্ব আমার। বাবা যেন ঐ মুহুর্তেরই অপেক্ষায় থাকে যে, কখন আমি কথার ঝুড়ি নিয়ে বসবো।
আমি আর মা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন রান্নাবান্না করি। নিজেরাই অদ্ভুত সব খাবার বানাই। যদি ভালো হয় তবে তো কথাই নেই, না হলে আর কি করা ! আসলে, আমরা প্রচুর ভোজনরসিক একটা পরিবার। খুব বেশি খাই না, তবে নানান পদের খাবার খাই। প্রতি শুক্রবার আমাদের জন্য ঈদের দিন ! বাবা বাসায় থাকে, আম্মু অনেক রান্না করে- ব্যস খাওয়া দাওয়া একেবারে জমে যায়। আমি রান্না পারি, তবে কিছুটা। এখনো মায়ের মতো হতে পারিনি, পারবোও না হয়তো।
এমন একটি পরিবেশে থাকলে অসুস্থ থাকলেও যেমন সুস্থ হয়ে যেতে বাধ্য, তেমন কিছুতেই একাবারে অনেকক্ষন মন খারাপ করেও থাকা যায় না।আচ্ছা, স্বর্গটা কি এর চাইতেও সুন্দর আর উপভোগ্য হয়?
১৫টি মন্তব্য
নীতেশ বড়ুয়া
কথাগুলো থরে থরে সাজানো ঠিক যখন যেখানে যেমন দরকার। ঠিক যেন আপনার বাড়ি।
ও হ্যাঁ, এই থরে থরে সাজানো কথায় ঠিকই আপনার আবড়িকে চিনে নিয়েছি।
এমন বাড়ি সবার হোক। -{@
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ -{@
নীতেশ বড়ুয়া
😀 -{@
ব্লগার সজীব
আপু আমি আপনার বাড়ি দেখতে যাবো।এমন মায়াময় একটি বাড়ি দেখি আমি স্বপ্নে।এমন বাড়িতে থাকলে স্বর্গ দিয়ে কি হবে? -{@
ফাতেমা জোহরা
হুম, সেটাই 🙂
সময় এবং সুযোগ পেলে অবশ্যই দেখতে আসবেন আমাদের বাড়িটা -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
যেনো আমি আমার বাড়ী থেকে ঘুরে এলাম। নাহ ওখানে মন খারাপ ব্যাপারটা দুঃখকে বিলাস করার মতো।
ওই বাড়ীটার মতো আপন পৃথিবীতে আর কোনো বাড়ী নেই।
জানেন একেবারে আমার ফেলে আসা জীবনটা আপনার লেখায় পেলাম? বাপি যেদিন বাসায় থাকতো, সেদিন আমার আনন্দ আকাশ-ছোঁয়া থাকতো। আমরা চারজন দিয়ে পরিবার ছিলো না তো। বাসায় যারা কাজ করতো, তাদের ছাড়া আমাদের আনন্দ নাচতোই না।
আবেগটা এমন কাঁপছে কেন? ভালো থাকুন। -{@
ফাতেমা জোহরা
আমার কাছে আমার বাড়ির মতো আপন আর সুখকর জায়গা আর একটিও নেই। মজার ব্যপার হল, আমি দুইদিনের বেশি কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না। মন শুধু কখন বাড়ি ফিরবো, কখন বাড়ি ফিরবো করতে থাকে।
ভালো থাকুন আপু। শুভকামনা নিরন্তন -{@ (3
নীলাঞ্জনা নীলা
ফাতেমা ওই বাড়ীর মতো বাড়ী যে পৃথিবীতে আর কোথাও থাকেনা। আমরা মেয়েরা ওই বাড়ীহারা হয়ে যাই। তারপর যে ছাদ পাই আমার হলেও আমার হয়ে থাকেনা। কারণ এই বাড়ীর ছাদ হই আমরা, আর ফেলে আসা বাড়ীর ছাদ আমাদের বাবা-মায়েরা।
ভালো থাকুন আপনিও। -{@ (3
ফাতেমা জোহরা
এই কথাগুলো মনে হলে খুব খুব অশান্তি লাগে আপু !! কতো যে শান্তিতে আছি এখন। কিন্তু যখনই ভাবি, আর মাত্র ক’টা দিন, তখনই আর কিচ্ছু ভালো লাগেনা 🙁
অরুনি মায়া
বাহ এমন ই একটা বাড়ি ই তো আমার চাই। কিন্তু শহরে ধান ক্ষেত আর কোথায় পাব। চমৎকার আপনার বাড়ি। একদিন বেড়াতে যাব। বসতে দিবেন তো? 🙂
ফাতেমা জোহরা
কেন দিবো না !! বসতে দিবো, মায়ের হাতের রান্না খাওয়াবো, গল্প করবো, চাইলে থাকতেও দিতে পারি 🙂
জিসান শা ইকরাম
শান্তির একটি বাড়ি চিনিয়ে দিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে
এমন একটি বাড়ি হলে আর কিছুই চাইনা
শ্নেহ,ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,সুখ,আনন্দ সব মিলে মিসে একাকার হয়ে থাকে এখানে।
লেখায় যে আপনি কতটা দক্ষ,তা এ লেখায় বুঝা যাচ্ছে।
আপনার ধারনাটি নিলাম আমি 🙂
শুভ কামনা।
ফাতেমা জোহরা
কি যে বলেন ভাইয়া ! আমিই তো আপনাদের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে লিখি। আপনাদের উৎসাহে লিখি 🙂
লেখাটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ -{@
লীলাবতী
এ যে মায়াময় একটি বাড়ি।আমি যাবো।থাকতেও চাই দু একদিন,কেউ যদি বলে 🙂
ফাতেমা জোহরা
কেন বলবো না আপু !! অবশ্যই আসবেন, থাকবেন। শুধু দুদিন কেন ! চাইলে আরো অনেকদিন থাকতে পারেন 🙂