দিনগুলো দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাপিকে আর গ্রামের বাড়ীতে রাখা যাবেনা। বাজারে থাকলে বড়ো মামা এসে দেখে যেতে পারবে, যে কোনো সময়ে আসতে পারবে।  আর ওরা ছোট বোন মৌয়ের বাসাতেও থাকতে চায়না। আজীবন চা’ বাগানে থাকতে থাকতে শহর তাদের কাছে অসহ্য। ঠিক করলাম শমশেরনগর বাজারে একটা বাসা ভাড়া করে দেবো। ওখানেই থাকবে ওরা। কিন্তু বাপিকে হাসপাতাল থেকে না ছাড়লে কোথাওই যেতে পারছিনা। কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না যে কি অবস্থায় আছি আমি। সময় নেই, মানসিক অনেক দায়িত্ত্ব। কিভাবে কি করবো, রাতে সবাই ঘুমাতো আর আমি ভাবতাম। যাক বাপিকে ছেড়ে দেয়া হবে। যেদিন আসবো এম্বুলেন্স লাগলো। মৌয়ের বাসায় নিয়ে আসা হলো। ওহ এর আগে বলে নেই সব ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে আয়াদেরকে দক্ষিণা দেয়া হলো। রীতা নামের এক সিস্টার বললো, বাপির তো রোজ ইনসুলিন নিতে হবে উনি এসে দিয়ে যাবেন। বললাম খুবই ভালো। আমাদের আর আলাদা করে খুঁজে নিতে হবেনা। এম্বুলেন্সের প্রধান দায়িত্ত্বে যিনি উনাকে বললাম দু’ সপ্তাহ পর মৌলভীবাজার যেতে হবে। বেশ পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো ওই ভদ্রলোকের সাথে। মজা হলো দেশ থেকে ফিরেও ফোন দিয়েছিলাম, ঠিক চিনতে পেরেছেন আমার কন্ঠ। একটা কথা না বললেই নয়, হয় কাকের মতো গলা নয়তো কোকিল…তা নইলে মোটামুটি যে একবার আমার কন্ঠ শোনে ঠিক চিনে ফেলে। কষ্ট একটাই প্রিয় কাউকেই সারপ্রাইজ দিতে পারিনা।   ;(

বাপিকে বাসায় নেয়া হলো। হাতে মাত্র সাত দিন বাকী। ২৮ মার্চ আমার ফ্লাইট। কিভাবে কি করবো ভাবতে পারছিনা। ওদিকে বান্ধবী সুস্মিতা-মধুছন্দা-লাকী ওদেরও ইচ্ছে অন্তত একটা বেলা ওদের সাথে কাটানো। ইচ্ছে তো আমারও করে। মামনি বললো, “আজ চলে যা, গিয়ে ঘুরে আয়। দেখা করে নে। এদিকে তো আর তেমন কিছু নেই। তোর মামী আছে, আমিও।” যাক সুস্মিতাকে বললাম বাসায় গিয়ে বসতে পারবোনা। বল কোথায় তোর সুবিধা? ও বললো আড়ঙের ওখানে একটা কফিশপ মনে হয় আছে(নাম ভুলে গেছি) ওটাতে গিয়ে বসলাম। আমি-তীর্থ আর ভাই রানা। জমজমাট আড্ডা। মাছরাঙ্গা বিকেল কাটলো সেদিন। কতোকাল পর মন খুলে আড্ডা। কোনো কাটঝাঁট নেই, ভুল বোঝাবুঝি নেই। গল্প যা পোষাবে না(গল্প যে অনেক জটিল হয়, তা আগে জানতাম না), যদিও অমন মুহূর্ত সেদিন অব্দি আসেনি সুস্মিতার সাথে। এখন যে কোনো বন্ধুত্ত্বে ভাবতে হয়, কি বলা ঠিক আর কোনটা ঠিক না। বেলাটা গড়িয়ে গেলো। বাসায় ফিরলাম। আচ্ছা আমি কি বদলে গেছি? কেন তাহলে সবাই বলে ওরা সেই একই রকম! এ কি আমার মুখোশ? নাকি সত্যি আমিটা মরে গিয়ে অন্য এক আমি তার জায়গা দখল করে নিয়ে পাওয়ার খাতায় শুধু একটা বিস্ময় এবং প্রশ্ন-বোধক চিহ্ন(!+?)রেখে গেছে আমার জন্য?

পরের দিন ২২ মার্চ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থেকে ভাশুরের দুই ছেলে এলো। তীর্থর সাথে দেখা করতে। আবার গেলাম দেবরের বাসায়। এতো আদর-আপ্যায়ণে থেকে যেতে হলো। যাক পরেরদিন আবার দৌঁড় সি.এন.জি করে মিরপুর থেকে ইন্দিরা রোড। ওদেরকে নামিয়ে দিয়েই আমি ছুট। একা একা আবার শিখে গেছি ঢাকা শহর ঘোরাফেরা। বাপির জন্যে বাজার সেরে ফিরছি, নার্গিস আপু (বান্ধবী শিল্পীর বড়ো আপু)র ফোন। “নীল কবে আসবে আমাদের বাসায়? তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাবো।” দেশে আসার আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলো বড়ো আপু অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। পরের দিনের কথা বললাম। ওদিকে বান্ধবী লাকীর ফোন, “নীলাঞ্জনা তোকে দেখতে দিবি না?” বললাম কাল কনফার্ম। পরেরদিন সকালে বাপির রাগ কেন যাচ্ছি? মামনি বললো, “মেয়েটা দিন নেই, রাত নেই হাসপাতালে রইলো। একটু কি ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করবে না? একটু তো ওকে ঘুরে বেড়াতে দাও।” কথাগুলো কানে বাজছে। এতোদিন খেয়াল করিনি হাসপাতালে যেমন-তেমন ভাবে গিয়েছি। এখন বেড়াতে, কি পড়বো? মৌ বললো, “দিদিভাই এখন দেশে টপ-জিনস সমস্যা না। সকলেই পড়ে।” এতো দৌঁড়ের মধ্যে মুটি হয়ে গিয়েছিলাম, তাই এমন সমস্যা। যাক রেডি হয়ে নীচে নামতেই দেখি বড়ো আপু গাড়ী নিয়ে দাঁড়ানো। আপুকে বললাম সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে যাবো। বান্ধবী লাকী ওখানেই শিক্ষকতা করে। গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে একজন টিচার বললেন ও নামে কেউ নেই এখানে, আপনি দেখুন ভেবে উনি কি স্কুলের কথা বলেছেন? এবারে গেলাম স্কুলে। লাকী দাঁড়ানো, বললো, “সেই একই আছিস। বে-খেয়ালী।” কত্তো বছর পর লাকীকে দেখলাম! দৌঁড়ে জাপটা। সবগুলো ছাত্রী চেয়ে রইলো। লাকী নাকি খুব কড়া শিক্ষিকা। ওর এমন রূপ একটু তো অন্যরকম লাগবেই। গাড়ী ছুটলো গুলশানের দিকে। প্রথমে আড়ং। লাকী বললো, “তুই আমার সাথে যাবিনা? তোকে খাওয়াবো, বাসায় নিয়ে যাবো। তারপর জানিস তোর প্রিয় শাড়ী কিনেছি!” আবার জড়িয়ে নিয়ে বললাম, এবারকার মতো থাক। দেখ আপুকে কি করে বলি! তুই তো বেশী বুঝিস আমায়। বড়ো ভালো ভাগ্য নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছি, এমন বন্ধু ক’জনার জোটে? আড়ং থেকে আপু তীর্থর জন্যে কিনলেন। কোনোভাবে আটকালাম আমার জন্যে কিনতে না। শিল্পী বলেছে আপু নাকি অনেক কিছু কিনে রেখেছে। হাত জোড় করে বললাম এখন পায়ে বসে পড়বো কিন্তু, তা নইলে কি আর থামে? লাকীকে নামিয়ে দিয়ে সোজা আপুর বাসায়। ভাইয়া আসবেন সন্ধ্যার সময় তখন বের হবো। বিশাল বড়ো লাইব্রেরী, আহ! আর কি চাই!! পুরো বাড়ী ঘুরে এসে চিকেন বিরিয়ানী খেলাম। খাওয়ার মধ্যেই ভাইয়া মিষ্টি পাঠিয়ে দিলেন(ঐতিহ্যবাহী সব মিষ্টি, কিন্তু নাম ভুলে গেছি)। ভাইয়া কিছুক্ষণ পরেই চলে এলেন। যা হলো ভাইয়া আর আপু সান্ধ্যভ্রমণে গেলেন বাইরে, ওই ফাঁকে আমি বই পড়া শুরু করলাম। কিন্তু শেষ করতে পারিনি। আপু এসে আমার জন্যে দুটো শাড়ী(জামদানী আর তাঁতের), একটা ফতুয়া—গিফট আমায় টানেনা। কিন্তু আপুর ওই আদর, কিভাবে ভুলি? গাড়ী পাঠিয়ে ছোট বোন মৌ আর তীর্থকে নিয়ে আসা, এমন ক’জন করে? আমি জানিনা। তবে আপু পেয়েছিলাম, একজন বড়ো বোন। মজা হলো ভাইয়ার দেয়া একটা নাম আছে আমার, সেটাও জানলাম ওই সেদিনই। বড়ো যত্নে রাখা একটা নাম।

সেই রাতে ধানমন্ডিতে একটা চায়েনিজ রেষ্টুরেন্টে বহু বছর পর প্রিয় খাবারগুলো খেলাম। রেষ্টুরেন্টের নামটা ভুলে গেছি। যাক ওখান থেকে বেড়িয়ে বাসায় ফিরেই আবার রেডি, পরেরদিন শমশেরনগর যেতে হবে বাপির ব্যাঙ্কের কাজে। কিন্তু আমাকে একা যেতে দেয়া হবেনা। সে পরের কথা।

নয়! এমন পাবার কথা ছিলো কি?
ভেঙ্গে ভেঙ্গে কেবলই ভালোবাসা জমে ওঠে দিনের একেকটি পৃষ্ঠায়
উহু! এ কি করে সম্ভব!!
ওভাবে কঠিন শহরের মলাটে্র ভেতর এমন প্রাঞ্জল গল্প,
সুনিপুণ গল্পকারের পক্ষেই সম্ভব।
হয়, হয়। এমনই হয়।
হতে হয়, এবং হয়েও যায়।
লেখায়-বলায়-চিত্রকলায় শহর হার মানে শহুরে নাগরিকের কাছে,
আসলে ভালোবাসা পরাজিত হয় ভালোবাসার কাছেই।

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ইং।

সুস্মিতা...ইডেনে প্রথম পরিচয়...
সুস্মিতা…যার কাছে অনেক ঋণ আমার… 
মামা-ভাগ্নে...
মামা-ভাগ্নে…
ক্রিকেট খেলা দেখায় মগ্ন তিন ভাই...
ক্রিকেট খেলা দেখায় মগ্ন তিন ভাই…
নাতীদের সাথে ঠাকুমা...
নাতীদের সাথে ঠাকুমা…
গুলশান আড়ঙ-এ...
গুলশান আড়ঙ-এ…
লাকী যাকে অস্থির করে তুলতাম হলে থাকার সময়...
লাকী যাকে অস্থির করে তুলতাম হলে থাকার সময়…
আপুসহ...
আপুসহ…
ভাইয়া-আপু-মৌ-তীর্থসহ আমি...
ভাইয়া-আপু-মৌ-তীর্থসহ আমি…
৫১৯জন ৫১৮জন
0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ