অামার বন্ধু কথিত বেশ্যা ছিলো, অামি তার হাত ছাড়িনি।
মেয়েটা অামার স্কুলের বন্ধু ছিলো। অামরা একসাথে বউচি, গোল্লাছুট, সাতচাড়া খেলতাম।
ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন এলাকার এক মাস্তানের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে।
এলাকার মানুষ মেয়েটাকে খারাপ বলতে লাগলো। মাস্তানের সাথে পালাইছে বলে হেন কোনো অপবাদ নাই মেয়েটাকে দেয়া হয়নি।
অামি শুনে ভীষণ কষ্ট পেতাম।
তারপরেও কান পেতে থাকতাম কেও তার ব্যাপারে কিছু বলে কিনা।
অামার বন্ধুর কথা।
হঠাৎ মাস ছয়েক পরে তাকে গ্রামের রাস্তায় দেখতে পাই।
ভীষণ লজ্জায় সে কুঁকড়ে যায়। অামারও সামনে পা চলেনা! কি বলবো ওকে! কি জিজ্ঞেস করবো ওকে! অামাদের দুজনের মাঝখানের রাস্তাটা হেটে অাসতে কয়েক যুগ লেগে যায়।
মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করি “কিরে কেমুন অাছস? কি খবর তোর?
-ভালা অাছি, তুই কেমুন অাছস?
-ভালোরে। কই যাছ?
-বাড়িতে যাই।
-তুই নাকি ***কে বিয়া করছস!
-বিরাট অপরাধী মুখ করে ও মাথা নারে উপর নীচে।
যাইগা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
ভীষণ খারাপ লাগতেছে ওর জন্য।
অামার ন্যাংটা কালের বন্ধু। দেখে বুঝলাম ভালো নাই।
তারপরে বাল্যকালের প্রথাগত ব্যস্ততা, পড়াশোনার চাপে বন্ধুর কথা ভুলেই যাই।
একদিন খুব ভোরে শুনি ওর জামাইকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
দৌড়ে ওর বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি ও মাটিতে গড়িয়ে কাঁদতেছে। অার সবাই তামশা দেখতেছে।
ভীষণ মায়া, কষ্টে, রাগে অামি বাড়িতে চলে অাসলাম।
অাসেপাশের মানুষের কাছ থেকে শুনলাম বাপের বাড়ি, শ্বসুর বাড়ি কোথাও তাকে জায়গা দেয়না, খাবার দেয়না। পালিয়ে বিয়ে করায় দুখানেই সে অযাচিত।
ডাকাতির দায়ে বন্ধুর স্বামীর যাবজ্জীবন জেল হয়।
অাবার ভূলে গেলাম। মেট্রীক পরীক্ষা, প্রাইভেট, ক্রিকেট খেলা। অামার কি অার সময় অাছে তার কথা মনে রাখার….
একদিন সন্ধ্যায় পাড়ার দোকানে সদাই অানতে গিয়ে শুনি, অামার বন্ধুকে নাকি কোন এক রাইস মিলের মালিকের সাথে অসামাজিক কার্যকলাপের দায়ে গ্রাম্য সালিশে বেধড়ক পিটান হয়।
সদাই নিয়ে দোকানে থেকে চলে অাসি।
প্রথম কোনো বন্ধুর জন্য খুব কাঁদি।
অাবার ভুলে গেলাম। কলেজের পরীক্ষা, ক্রিকেট, স্কাউট, খেলোয়ার ফেম-ফেমাস!!!
জীবন তখন বিন্দাস।
ইন্টার পরীক্ষা শেষ সারাদিন খেলে বেড়াতাম। তখর একটু বড় হয়েছি। খান বাড়ির ছেলে হিসাবে সমাজে তরুনদের লিডটা স্বাভাবিকভাবে হাতে চলে অাসে।
গ্রীষ্মের কাঠফাটা রৌদ্রে দেখি অামার বন্ধু হাতে একটা ঝুলা মাথায় নিয়ে হেটে অাসতেছে। জিজ্ঞেস করলাম –
-কিরে কি খবর? কেমুন অাছস?
-এবার অার লজ্জ্বা,অপমান, অপরাধ প্রবনতা ফুটে ওঠেনি ওর মুখে।
সরাসরি জবাব দেয়
-ভিক্ষা করি।
অামি কিছু বুঝে ওঠার অাগেই হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
অামার জীবনের সকল অাবদার অামি মা’র কাছে করেছি। অামার মা অামার জীবন অামার দুনিয়া। মা’কে গিয়ে বললাম –
– মা ওকে অামাদের বাড়িতে কাজ দেও। অামাদেরতো কাজের লোক লাগেই। মা রাজি হলো।
কোনোদিন কোনো কাজ অামার বন্ধুকে অামি দেইনি। ভীষণ মানসিক কষ্টে থাকতাম এই ভেবে যে, অামার বন্ধু অামাদের বাড়িতে কাজ করে।
অামার অনার্স শেষ অামি ঢাকায় চলে অাসি।
কয়েকদিন পরে বাড়িতে এসে শোনি বন্ধুটা মফস্বলের কোনো এক টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়েছে।
শোনে ভালো লাগলো।
তার কয়েকমাস পরে শোনলাম তার জামাই জেল থেকে ৭ বছর সাজা কেটে মুক্তি পেয়েছে।
ও রোজগার করে ওর জামাই তাস জুয়া খেলে, চুরি করে। ধরা পরে জেলে যায়, ছাড়া পায় অাবার ধরা পরে। এভাবেই চলতে থাকে তার জীবন।
বন্ধুটার কোনো সন্তান হয়না, কারণ সে বাঁজা। গ্রামের মানুষ বলে “নডিগর পুলাপাইন হয়না “।
অামি জানি অামার বন্ধুর চোখে অামি তা দেখিনি।
দীর্ঘ কয়েকবছর মিলে কাজ করে সে কিছু টাকা জমায়। অামার ফোন নাম্বার যোগার করে ফোন দেয়। বলে,
– ইমইন্না অামি ****। একটা কাজ করে দিবি ভাই।
– অামি তথমতো খেয়ে যাই। বলি -হ্যা বল।
– অামাকে একটা পাসপোর্ট করে দিতে পারবি? বিদেশ যামু
– তুই বিদেশ যাবি! অনেক টেহা লাগবো তো!
– মিলে কাজ কইরা ৩৫ হাজার টেহা জমাইছি।
– কসকি! অাচ্ছা শোন, অামি চাচাকে (অামার চাচা চেয়ারম্যান) বলে দিচ্ছি। সব করে দিবে।
তার মাস তিনেক পরে ও অাবার ফোন দেয় –
– ইমইন্না, কালকে অামার ফ্লাইট। মরিশাস যাইতাছি। দোয়া করিস।
– যা, ভালো থাকিস।[[ভীষণ আনন্দে চোখ ফেটে জল আসলো। আমার বন্ধু এই অপমানের জিন্দেগি ,এই প্রতারণার সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে…]]
কিছুদিন অাগে গ্রামে গেলে শোনি ওর টাকায় ওর জামাই গ্রামে একটা দোকান দিছে। এখন অার চুরি করেনা। দুই রুমের একটা দুচালা বাড়ি করেছে।
সেদিন দোকানে অাড্ডা হচ্ছিলো।
একজন বললো “বিদেশ গিয়া কাম দেয়, তাই বাড়ি করতে পারছে।”
ধুম করে একটা লাত্থি মারলাম।
শালা কুলাঙ্গারের বাচ্চা, দেশে যদি তোদের মতো জানোয়ারের কাছে ‘মারা দেয়া ‘ লাগে তবে, বিদেশে গিয়ে দেয়া তারচেয়ে ভালো।
[[ অামরা মনে করি বিধাতা বা কোনো এক জাদুকর এসে সব ঠিক করে দিবে। কিন্তু, অাদৌ না কোনো জাদুকর পেরেছে না বিধাতা।
হতে পারে তোমার বন্ধু বিপথগামী কিন্তু তুমি কি নাক সিঁটকে সড়ে যাবা নাকি হাত টেনে তাকে নড়ক থেকে তোলার চেষ্টা করবা?
You should try to be humane enough ]]
১৪টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
এমন জীবন কারো ভাগ্যে জেন না হয়।
আপনাকেও লাল স্যালুট।
ইমন
মজিবর ভাই
দোয়া করবেন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সমাজটা এমনই। আপনি জানতেন, আপনার বন্ধুটির গায়ে যে কালিমা লেপন করা হয়েছে, সে আসলে তেমন নয়। কারন আপনি তাঁর চোখে কোনদিন তা দেখতে পাননি। কিন্তু সমাজ তাই বলছে। সমাজের ধারাটাই এমন, কুৎসা রটনাতে যতোটা এগিয়ে, মানবিক ভুমিকায় ততোটা এগুতে পারেনা। আর নারী চরিত্র হলে তো কথাই নেই। ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক, রটিয়ে দিতে পারলেই হলো; ব্যস সে নারী অচ্ছুৎ।
যাহোক, আপনার বন্ধুটিকে স্যালুট। সে হাল ছেড়ে দেয়নি, বরং সমাজের বুকে চপেটাঘাত করতে পেরেছে। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জন করতে পেরেছে, সে প্রকারেই হোক। কুরআনে আছে, জীবিকার প্রয়োজনে যেকোন পেশাই হালাল।
আর আপনাকেও সালাম, কাপুরুষের মতো সমাজের ভয়ে নাক সিটকায়ে সরে না গিয়ে বরং বন্ধু হিসাবে বন্ধুটির দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
ইমন
রুবা
আপনার সুন্দর বিশ্লেষণী মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। 🙂
সমস্যা হচ্ছে আমরা লেখে আর বলেই দাইত্ব শেষ মনে করি। সবচেয়ে নির্মম আমরা হাতটা ছেড়ে দেই। 🙁 চেষ্টাটাও করিনা কাছের মানুষটাকে দুর্বিসহ অবস্থা থেকে উঠে আসতে …..
জিসান শা ইকরাম
বেঁচে থাকুক এমন বন্ধুত্ব।
ভালো থাকুক আপনার বন্ধু………
ইমন
জিশান ভাইয়া
ধন্যবাদ দোআ করবেন। 🙂
লীলাবতী
এমন বন্ধুত্বকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। ++++
ইমন
লীলাবতী
ধন্যবাদ দোআ করবেন।
শুন্য শুন্যালয়
মেয়েটিকে শ্রদ্ধা জানাতেই হচ্ছে। আমাদের সমাজে এমন মেয়েদের সংখ্যা অনেক, সমাজের অসহযোগিতার জন্য অনেককেই অসামাজিক কর্মে জড়িয়ে পরতে হয়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমন মনমানসিকতার জন্য। ভালো থাকুক বন্ধুত্ব।
ইমন
শুন্য আপু
ধন্যবাদ আপনাকেও 🙂
আমি, আপনি ,আমরা তাদের হাত ধরে রাখার শপথ নিলাম….
সিনথিয়া খোন্দকার
আপনার বন্ধু সমাজকে মিডল ফিঙ্গার দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের তো আবার লজ্জা নাই। নিজের পশ্চাতদেশের কাপড় তুলে মাথায় দিয়ে অন্যকে বেহায়া বলতে বেশ লাগে।
স্যালুট আপনার বন্ধুটিকে। যে একই সাথে গভীর ভালোবাসা আর ভীষন কাঠিন্য ধারন করে। আর তার সংগ্রামের সঙ্গী হিসেবে আপনাকেও …
ইমন
সিনথিয়া আপু
সেটাই। আমরা যখন বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করার কথা তখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে দায়িত্ব পালন করি। ধন্যবাদ আপু আপনাকে। 🙂
কৃন্তনিকা
আমাদের সমাজটা এমনই। কেউ ভালভাবে বাঁচতে চাইলেও পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেই…
আপনার বান্ধবী যেভাবে বাঁধা অতিক্রম করেছেন, সেভাবেই যেন চলতে থাকেন…
আপনার বান্ধবীর জন্য শুভকামনা রইল।
ইমন
কৃন্তনিকা
আপনার শুভেচছা আর অভিনন্দন আমার বন্ধুকে পৌছে দিবো। ভাল থাকবেন। 🙂