
জানি না করোনার কারণে এবার পবিত্র হজব্রত পালন হবে কিনা! তবে, দ্রুত করোনা মুক্ত হোক পৃথিবী।
একসময় হজযাত্রা এখনকার মতো সহজ ছিলোনা। আজ থেকে চার দশক আগেও বাঙালি মুসলমানের জন্য এটা দুঃসাধ্য ছিলো। সব মুসলমানরাই স্বপ্ন দেখে মক্কা মদীনা যাবেন। হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে নিজেদের পবিত্র করবেন।
সেকালে, এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন হাতে গোনা কয়েকজন লোক। যাঁদের অর্থবিত্ত ছিলো, দৃঢ় মনোবল ছিলো, — শুধু তাঁরাই য়েতে পারতেন এই কাঙ্খিত স্থানে।
সমাজে এইসব ভাগ্যবান হাজীর কদর ছিলো খুব। বংশে এরকম হাজী থাকলে, সেই বংশের মান মর্যাদাও বেড়ে যেতো কয়েক গুণ। এমন কি গ্রামের নামও পাল্টে যেতো। যেহেতু, প্রস্তুতি নিতে কয়েকবছর লেগে যেতো; সেহেতু তাঁরা সব ধরণের বৈষয়িক লেনদেন মুক্ত করে হজে যেতে চাইতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সবাই বয়স করেই হজে যেতেন। হয়তো সেজন্যই সবাই ভয়ে থাকতেন, যদি আর না ফিরেন! কারণ বিপদ সংকুল যাত্রায় অনেকেই পথিমধ্যে রোগে শোকে মারা যেতেন।
সেসময় হাজীদের বিদায় দেয়া হতো ঘটা করে। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই স্টেশন বা ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার জন্য যেতেন। ঐ দিন হাজী সাহেব বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতেন। আর সবারি ফরিয়াদ থাকতো, উনি যেনো মদীনায় সবার ছালাম পৌঁছে দেন, নবীজির রওজামোবারকে।
বাংলাদেশের হাজীরা আনাচ কানাচ, গরুর গাড়ি, নৌকায় করে মুম্বাই পৌঁছাইতেন। ওখান থেকে জাহাজে করে রওনা হতেন পাকিস্তানের করাচীতে। সেখানে আরও হজযাত্রী উঠতেন। এরপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে, কতে ঝড়ঝঞ্জা সয়ে পৌঁছাতেন এডেন বন্দরে।
জাহাজে থাকাকালীন সব হাজীরা মিলেমিশে কাজ করতেন। কেউ রুটি বানাতেন, কেউ ভাজতেন, কেউ তরকারি কাটতেন, কেউ রান্না করতেন।
অনেক সময় সমুদ্রের ঝড়ে তখনকার কাচের থালাবাটি, বাসন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতো। যাত্রীরা ভয়ে ডেকে মলমুত্র ত্যাগ করতেন। জাহাজের শিকল ধরে গুণতেন মৃত্যুর প্রহর।
পথিমধ্যে শহর নগর সামনে আসলে, মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হতো। সবাই আনুসাঙ্গিক জিনিসপাতি ক্রয় করতো।
আবহাওয়া রৌদ্রজ্জ্বল থাকলে, সাগরে তিমি, হাঙ্গর কতো প্রকার যে মাছ দেখা যেতো।
এডেনের পর ইয়েমেনের উপকূলীয় দ্বীপ কামারানে হাজীদের কোয়ারাইন্টানের জন্য নামিয়ে দেয়া হতো। এখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে ১ সপ্তাহ বা ১ মাসও লাগতো। কোয়ারাইন্টান শেষে জাহাজ অবতরণ করতো জেদ্দায়। পথিমধ্যে ইয়ালামলাম নামক স্থানে ইহরাম বাঁধতে হতো। এটা ভারতীয় উপমহাদেশের মিকাত।
জেদ্দা থেকে কাফেলা রওনা হতো মক্কা। দুরত্ব ছিলো ২৫০ মাইল। মক্কায় পৌঁছে সুবিধামতো তাঁবু গেড়ে হজের মূল কার্যাদি সম্পন্ন করতেন হাজীরা। সবচেয়ে কষ্টকর ছিলো এই মরুর যাত্রাপথ। একে তো জলন্ত পিন্ড। অন্যদিকে বেদুঈন দস্যুদের অত্যাচার। পথে মন্জিলে মন্জিলে পাওয়া যেতো জ্বালানি কাঠ, পানি, খেজুর, তরমুজ, চা। আবার গোসলও সারা যেতো। রাতে বেদুঈনদের থামাতে টাকা দিয়ে খুশি করতে হতো। অনেক সময় তাঁরা সর্বসান্ত হয়ে যেতো। ঐ সময় তারা আরব লোকদের বাড়ি গিয়ে উঠতো। আর আরবরা কখনোই কার্পণ্য করেনি আতিথেয়তায়।
মদীনায় হযরত মোহাম্মদ ( সাঃ) এর রওযা মোবারক দর্শনে কেউ কেউ এতোটাই আত্মহারা হয়ে উঠতেন যে তাঁরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।
অতঃপর আবার যাত্রা শুরু ঘরের দিকে। তখন কাফেলার জনসংখ্যা আর আগের মতো থাকতো না। অনেেকেই মারা যেতেন।
ছয় সাত মাস পর কোন এক রাতে জমজম কূপের পানি আর খেজুর নিয়ে পৌঁছাতেন পরিবার পরিজনের কাছে। তখন আনন্দে সবাই কেঁদে ফেলতো।
নতুন হাজী ফিরছেন, এই কথা শুনেই পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হতো তাঁকে দেখতে। আর হয়তো হজ যাত্রার গল্প বলতে বলতে মাস ছয়েক কেটে যেতো।
অথচ, আজ কতো সহজ হজযাত্রা। রাব্বুল আল আমিন আমাদেরকে তৌফিক দান করুন হজ করার।
আমিন।
২৪টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
আপনার এই লেখা সত্য তবে সূত্রের উল্লেখ করা দরকার ছিল।
আরজু মুক্তা
কিছুটা ছোটবেলা থেকে শোনা বা দেখা। বাকিটা সংবাদপত্র পড়ে।
শুভকামনা
ছাইরাছ হেলাল
সে সময়ের হজ্জ্বের কথা এখন আর কেউ ভাবেনা, সব কিছু পরিত্যাগ করে শুধু আল্লাহ -রাসূলের জন্য
জীবনের মায়া ত্যাগ করে ছিল সে যাত্রা। এখন কী হচ্ছে আমরা তা দেখতেই পাচ্ছি।
আল্লাহ আমাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করুক এ প্রার্থনা রাখি।
আরজু মুক্তা
ঠিক বলেছেন। এখন লোক দেখানি হজ।
তবুও সবার মনোকামনা পূরণ হোক
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাহ্ হজ্ব যাত্রা নিয়ে অনেক কিছু জানা হলো। ধন্যবাদ আপনাকে। শুভ কামনা রইলো
আরজু মুক্তা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
আলমগীর সরকার লিটন
সুন্দর লেখেছেন মুক্তা আপু
শুধু দুরভাগ্য আমাদের———–
করোনা কি যে করবে
আরজু মুক্তা
থিমটা না বুঝেই মন্তব্য করলেন!!!
পড়েন। মন্তব্য না করলেও চলবে।
ভালো থাকবেন
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
হজ যাত্রা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ সুন্দর লেখা। আসলে তখন হজ যাত্রা অনেক কঠিন এবং কষ্টসাধ্য ছিল যা লেখায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। পুরানো একটা রীতির কথা মনে করিয়ে দিলেন — “সেসময় হাজীদের বিদায় দেয়া হতো ঘটা করে। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই স্টেশন বা ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার জন্য যেতেন। ঐ দিন হাজী সাহেব বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতেন। আর সবারি ফরিয়াদ থাকতো, উনি যেনো মদীনায় সবার ছালাম পৌঁছে দেন, নবীজির রওজামোবারকে”। আমার বাবা সম্ভবত ১৯৭৪ সালে হজে যান। আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে ছিল মেইন রোড। এতটুকু পথ গ্রামের শত শত মানুষ শিশু কিশোরসহ আল্লাহু আকবর সহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে এগিয়ে দিতে আসেন। এবং হজ থেকে ফেরার সময় দেখি মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। আল্লাহ্ সবাইকে হেফাজত করুণ। পবিত্র হজ করার তৌফিক এনায়েত করুণ। শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই
সুপায়ন বড়ুয়া
“নতুন হাজী ফিরছেন, এই কথা শুনেই পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হতো তাঁকে দেখতে। আর হয়তো হজ যাত্রার গল্প বলতে বলতে মাস ছয়েক কেটে যেতো। “
সত্যি আপু হাজীদের দেখলে মনটা ভড়ে যেতো
এখন সহজ ও হাজী বেড়ে যাওয়াতে কদরটাও কমেছে
যুবক নেতারা হাজীকে পদবী হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনের আগে।
খুব ভালো হজযাত্রা বিশদ ভাবে তুলে ধরার জন্য।
আরজু মুক্তা
হাজীদের কদর কমে গেছে।
আবার সুদিন ফিরুক
প্রদীপ চক্রবর্তী
যথার্থ লেখনী।
করোনা মুক্ত হোক সারা পৃথিবী।
মানুষ আবার সৃষ্টিকর্তা প্রার্থনায় মেতে উঠুক। পুনরায় সকলের পবিত্র হজযাত্রা শুভ হোক।
আরজু মুক্তা
আমিন।
জিসান শা ইকরাম
অতীতে কত যে কস্ট করে হজ্জ্ব করতে যেতেন আমাদের দেশের মানুষ, তা বর্তমানে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। যারা হজ্জ্বে যেতেন তাঁরা ধরেই নিতেন আর ফিরবেন না। কয়েকমাস ব্যাপী বিপদসংকুল ভ্রমনের যাওয়া আসার পথে অনেকেই মৃত্যুকে বরন করে নিতেন।
তখনকার হাজ্জ্বী সাহেবদের অনেক সন্মানের চোখে দেখা হতো। এখন কে কখন হজ্জ্বে যান তাই জানা হয়না।
বিস্তারিত বর্ননা দিয়ে এমন একটি পোস্ট দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ সুন্দর কমেন্টের জন্য।
আমি কৃতজ্ঞ ও অনুপ্রাণিত।
তৌহিদ
হজ্জ্ব হবে তবে শুধুমাত্র সৌদিআরবে যারা থাকেন তারাই করতে পারবেন এটাই জেনেছি। হজরে আসওয়াদ পাথরে কেউ চুম্বন দিতে পারবেনা এবার। বাকি আল্লাহ্রর ইচ্ছে।
ভালো থাকুন আপু।
আরজু মুক্তা
ও আচ্ছা।
নিশ্চয় পরিবেশ ভালো হবে।
ধন্যবাদ ভাই তথ্যটি দেয়ার জন্য।
সাজেদুল হক
হজ্জ্ব নিয়ে সুন্দর একটা পোস্ট।
ভালো লেগেছে উপস্থাপন।
আরজু মুক্তা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভকামনা
খাদিজাতুল কুবরা
আপু হজ্জ্ব নিয়ে এতো সুন্দর লিখেছেন ।
আগেকার দিনের হজ্জ্ব যাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
আশা করি আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। আবার মানুষ হজ্জ্ব পালন করে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাটি পূরণ করতে পারবে।
এরকম একটি গুরুত্ববহ লেখা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আপু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও ধন্যবাদ কষ্ট করে লেখাটা পড়ার জন্য।
অবশ্যই পরিবেশ ভালো হবে।
আমিন।
ভালো থাকবেন সবমসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
অতীতে যারা হজ্ব পালণ করতে গেছেন, তাদের মুখে সেসব দিনের বিভিন্ন বর্ণনা শুনলে অবাক হই। আর মনে মনে তাদের ঈমানের প্রশংসা না করে পারি না। এখন অনেকের কাছেই হজ্ব আদায় করতে যাওয়ার অর্থ হলো নামের আগে হাজ্বীর সার্টিফিকেট পাওয়ার মতো। কিন্তু অতীতের ঈমানদার ব্যক্তিদের কাছে হজ্বব্রত পালন করা ছিলো সারাজীবনের সাধনার বিষয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের নেক-মনোবাঞ্ছা পুরুণ করে পবিত্র ভূমিতে হজ্ব আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
ভালো থাকুন, বেশি বেশি লিখুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলেনা। কথাটা পুরোন হলেও সত্য। এখন টাকা আছে। চলো পদবী লাগাই হজ করে আসি। হয়ে গেলো। মর্ম বোঝে না।
শুভকামনা।