চলে আসার আগের সন্ধ্যা। ছাদে আধো অন্ধকারে, আধো নিয়নের আলোয় আমরা দু’টো মানুষ। সমস্ত উচ্ছলতা পিছনে ফেলে থমথমে দক্ষিণা বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই প্রথম নিরবতা ভেঙে ছল্ছল চোখে শিখা বলে উঠলো, “রিমি, আমেরিকা গিয়ে তুমি কি আমায় ভুলে যাবে ?” আমি রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে অনিচ্ছার হাসি হেসে বলি, “ধুর্, ভুলে যাওয়া কি এতো সহজ !”
অতঃপর আমি ভুলে গেলাম। বেমালুম ভুলে থাকলাম “শিখা সাহা” নামের আমার কৈশোরের বন্ধুকে। যে আমায় প্রতি পূজা’য় যত্ন করে পাশে বসিয়ে সন্দেশ, নাড়ু খাওয়াতো। গান গেয়ে শোনাতো।
একদিন অনেক বছর বাদে যখন দেশে গেলাম, মনের গহীনে খুঁজে বেড়ালাম প্রতিনিয়ত সুখ দুঃখের গল্প করা সেই বন্ধুটিকে। শুনেছি তাঁর বিয়ে হয়েছে। স্বামী, সংসার নিয়ে চট্টগ্রাম থাকে।
মনে প্রাণে চাইলে সৃষ্টিকর্তা কাউকে ফিরিয়ে দেয়না, শুনেছি।
পারিবারিক এক বিয়ে উপলক্ষে আমি তখন সেই শহরে। কেবলই মনে মনে খুঁজে ফেরা। এতো কাছাকাছি এসেও দেখা হবে না আমাদের ! বাবা’র কাছ হতে ঠিকানা, ফোন নাম্বার যোগাড় করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যাই। হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত আমি বেলা শেষে সেই বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাই। আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি বাঁধ ভাঙা আবেগে। সে এক বর্ণনাতীত পরিবেশ ! এ অনুভূতি কোন শব্দ দিয়ে প্রকাশ করবার নয়। কেবলই অনুভবের। শাঁখা, সিঁদুর, আর শাড়িতে পরিপূর্ণ এক নারী আমার কৈশোরের বন্ধু শিখা সাহা। সেদিনও যত্ন করে পাশে বসিয়ে খাওয়ালো। গল্প হল। জমে থাকা যত কথা, সব… স-ব। এরপর আবারো কেটে গেলো এক যুগেরও অধিক সময়। নিউইয়র্কে আমার বাড়ির সামনে পিছনে দু’টো মন্দির। সেখানে পূজা দেখতে যাই। শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর দেয়া নারীদের দেখি।
প্রতি পূজো’য় শিখাকে খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই সন্ধ্যার আধো অন্ধকার আর নিয়নের আধো আলোয় ছল্ছল চোখ জোড়া। যেন কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে কেউ বলে উঠে___ “রিমি, আমেরিকা গিয়ে তুমি কি আমায় ভুলে যাবে ?” এবার আর বলে উঠি না___” ধুর্, ভুলে যাওয়া কি এত সহজ !”
শুধু আন্মনে আবৃত্তি করি___
অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দু’জনেই দু’জনকে বলবো,
“অনেকদিন দেখা হয়নি”।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়তো জানা যাবে
বা হয়তো জানা যাবে না, যে
তোমার সঙ্গে আমার, অথবা
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
২৪টি মন্তব্য
নীতেশ বড়ুয়া
🙂
আপনার ফেলে আসা দিনের অনেক বন্ধুদের সাথেও আপনি এখনো কি সুন্দর যোগাযোগ করে চলেছেন আর তাঁদের নিয়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে এখনো মলিন হতে দেননি।
খুব ভাল লাগে এইসব স্মৃতিকথা পড়তে।
-{@
রিমি রুম্মান
সংসার, স্বামী, সন্তান, ব্যস্ততা … সবমিলে সীমাহীন ব্যস্ততার পরেও দিনশেষে আমরা আমাদের নিজস্ব ভুবনে বিচরন করি। সেখানে আমার প্রিয়জনেরা ফিরে ফিরে আসে। তাঁরা থাকে মনের গহিনে।
ভাল থাকুন সবসময়। -{@
ছাইরাছ হেলাল
দেখা হোক বা না হোক আপনি সবাইকে মনে রাখছেন এও কম কথা না।
আমরা তাও রাখি না, রাখতে পারি না।
রিমি রুম্মান
আমি যখন দেশে যাই, মনে হয় এই সেই দেশ যেখানে আমার প্রিয় মানুষগুলোর বসবাস। যেখানে চাইলেই আমি সবাইকে দেখতে পাবো। সবকিছু কেমন কাছের মনে হয়। সময় সুযোগ থাকলে খুঁজে খুঁজে সবাইকে দেখতে যাই। ওরা খুশি হয়। আত্মায় আত্মায় মিশে থাকে সম্পর্কগুলো।
ভাল থাকবেন। শুভকামনা নিরন্তর।
লীলাবতী
আপনি তো ভুলে যেতে পারেননি আপু।প্রায় সবাই ভুলতে পারলেও কেউ কেউ ভুলতে পারেনা।এমন ভাবে লিখলেন ছোট বেলার সন্ধ্যার কথা মনে পরে গেলো।
রিমি রুম্মান
কিছু মানুষ মনের গহিনে থেকে যায়। সময়ে সময়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন প্রতি পুজোয় “শিখা সাহা” নামের বন্ধুটিকে খুব বেশি মিস করি।
ভাল থাকুন। -{@
অরুনি মায়া
এইতো দেখা হয় মনের উঠোনে প্রতিদিন না হোক মাঝে মাঝে
রিমি রুম্মান
দৈনন্দিন ব্যস্ততার যাঁতাকলে আমরা ভুলে থাকি সবই। কিন্তু আসলেই কি ভুলে থাকি ? এইযে ফিরে ফিরে আসে সময়ে, একে কি ভুলে থাকা বলে ? দেখা হয় মনের উঠোনে …
জিসান শা ইকরাম
আপনার লেখা গুলো পড়ে আমিও স্মৃতি আক্রান্ত হই।
রিমি রুম্মান
পূজা, প্রতিমা, বাড়ির পাশের মাসিমার উলুধ্বনি এসব ভীষণ মনে পড়ে পূজার সময়টাতে।
শুন্য শুন্যালয়
কবিতাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেছে। টেকনোলজির যুগেও আমরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরে সরে যাই, একি শুধু সময়ের দোষ? নাহ।
সবকিছু হয়ে ওঠেনা মন চাইলেও। স্মৃতিরা বেঁচে থাকুক এমনি করে শিখা হয়ে।
রিমি রুম্মান
কবিতাটি ভীষণ প্রিয় আমার।
ভাল থাকুন আপু। ভাল থাকুন সবাইকে নিয়ে। -{@
মেহেরী তাজ
ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ আপু??
চাইলেও পারা যায় না।
ভালো থাকুন আপনি এবং ভালো থাকুক আপনার সেই বন্ধু।
রিমি রুম্মান
ভুলে যাওয়া যায় না কিছু মানুষ, কিছু স্মৃতি। শৈশব তোমারে হারায়ে খুঁজি…
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমার তেমন একটা বন্ধু ছিলো খুব ছোট্টবেলার। অনেকদিন তাঁর সাথে দেখা নেই। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন তাঁর বিয়ে হয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে প্রায় ২০/২১ বছর পর একদিন জানলাম তাঁর ছোট ভাইর সাথে আমার ছোটভাইর ফ্রেন্ডশিপ। আমি তাঁকে বলি সাহানা আসলে যেনো খবর দেয় আমি দেখা করবো। আমি তাঁকে দেখার জন্য খুব উদগ্রীব ছিলাম।
কিন্তু তারপর! তারপর আরেকদিন ছোট ভাইর বন্ধুটির সাথে দেখা হতেই জানলাম, আমার সেই বন্ধুটি আর বেঁচে নেই। শুনে দুহাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষন ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছিলাম।
সে ডেলিভারি কেইসে মারা গিয়েছিলো।
রিমি রুম্মান
আমাদের জীবনটা আসলে খুব বড় নয়। কিছু মানুষের হারিয়ে যাওয়া দেখে অন্তত তাই মনে হয়। একেকবার দেশে গিয়ে যাঁদের সাথে সুন্দর হাসি-ঠাট্টার সময় কাটিয়ে মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরি, পরেরবার তাঁদের কেউ কেউ থাকে না। থাকে না মানে কোথাও থাকে না। একেবারেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে, দুর্লঙ্ঘ্য এক দেয়ালের ওপারে।
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুধু বলি… দেখা হবে আবার, অন্য কোথাও …
নাসির সারওয়ার
আপনার ভালো মনের ছোঁয়াটা লাগুক আমাদের গায়ে।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন ভাইয়া। শুভকামনা রইলো। -{@
ব্লগার সজীব
কত কিছু মনে এসে ভীড় জমাল।
রিমি রুম্মান
পূজা, প্রতিমা বিসর্জন, উলুধনি, সন্দেশ, নাড়ু ___ এমন স্মৃতি কম বেশি আমাদের সকলেরই আছে, তাই না ?
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু আপনি তো তাকে ভোলেননি। আমি সবসময় একটা কথা বলি আমার প্রিয় মানুষদের। মনে তাকেই করতে হয়, যাকে আমরা মনে রাখিনা। মনে যে থাকে তাকে মনে করতে হয়না। আপনার মনে বান্ধবী দিদিটা থেকেই গেছেন, তা নইলে আজ কেন লিখতে বসলেন?
আপু আমার শৈশব কিংবা কিশোরী বেলায় কোনো বন্ধু ছিলোনা। কতো লাকী আপনি।
বন্ধুতার জয় হোক। শুভ বন্ধুতা -{@
রিমি রুম্মান
কিছু মানুষ গহীনে থেকে যায়। নইলে অনেক বছর বাদে আমি কেন তাঁকে খুঁজে বের করে দেখা করতে যাবো ? কেনই বা এত বছর বাদে তাঁকে নিয়ে লিখবো ? পূজার সময়টাতে এখন আর কেউ পাশে বসে যত্ন নিয়ে সন্দেশ খাওয়ায় না। বলে না___ আরেকটা খাও, রিমি …
স্বপ্ন
লেখাটি মনে দাগ রেখে গেলো।
রিমি রুম্মান
কিছু মানুষ দাগ রেখে যায় মনে কিছু ঘটনার মত করে…
ভাল থাকবেন। শুভকামনা নিরন্তর।