চমকে উঠে জোবায়ের করিম। তার শরীরটা ঝাকুনি দিয়ে যেন অন্তরাত্মাসহ কেঁপে উঠে। সে টেব থেকে ভিডিওটি পর পর আরো কয়েকবার মন দিয়ে শুনে। ইউটিউব থেকে একজন ইসলামীক স্কলারের লেকচার শুনছিলো জোবায়ের করিম। বক্তা পরিস্কার ভাষায় কোরআনের আয়াতে উল্লেখিত তথ্যকে দৃঢ়তার সাথে উপস্থাপন করেছেন। অনেকসময় বক্তার উপস্থাপনার যাদুকরী কৌশলের ফলে অনেক গতানুগতিক পুরোনো জিনিসকেও নতুন করে উপলদ্ধি করা যায়। আবিস্কার করা যায়।
কোরআনের উক্ত আয়াতে এমন কিছু মুসলমানের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে যারা মসজিদে গিয়ে নিয়মিত নামায পড়ে। যাদেরকে মুসল্লি বলা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহ নিজেই সেসব নামাযিদের ধ্বংসের ঘোষণা দিয়েছেন। সেজন্যেই জোবায়ের করিম চমকে উঠেছে। যদি এখানে বেনামাযির ধ্বংসের কথা বলা হতো তাহলে জোবায়ের করিম এতোটা চমকে উঠতো না। ‘ফাওয়াইলুল্লিল মুসাল্লীন! আল্লাজী নাহুম…………’
এরপর থেকে জোবায়ের করিম অসম্ভব রকম নিরব ও গম্ভীর হয়ে পড়ে। খানাপিনা তার কাছে তিতা লাগে। দুনিয়াবী কাজকাম অসার মনে হয়, অর্থহীন মনে হয়। কোরআনের আয়াতটি কোন সূরার কত নাম্বার আয়াত তা জোবায়ের করিম খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ লেকচারে সূরা ও আয়াত নাম্বার বলা হয়নি। সে আরো কয়েকবার ভিডিওটি শুনে দেখলো। কিন্ত না, শায়েখ বার বার জোর দিয়ে বলেছেন বটে এখানে নামাযিদের কথা বলা হয়েছে। বেনামাযির কথা বলা হয়নি। বেনামাযির শাস্তি কী হতে পারে তা এ থেকেই কল্পনা করা যায়! তবে তিনি বক্তেব্যের কোথাও সূরা বা আয়াতের কথা উল্লেখ করেন নি ।
কয়েকদিন পর জোবায়ের বন্ধুদের সাথে আলাপকালে প্রসঙ্গটি তুললো এবং আয়াতটি কোন সূরার তা কেউ জানে কিনা জানতে চাইলো। সেখানে তাদের মধ্যে দু’জন কোরআনে হাফেজও ছিলো। আয়াতটি পুরোটা জোবায়ে বলতে না পারায় তাদের খুঁজে বের করতে কষ্ট হলো। অনেক্ষণ চেষ্টার পর তারা সূরাটি খুঁজে পেল। আয়াতটি হল সূরা মাউন এর ৪ ও ৫ নম্বর আয়াত। এটা জানার পর জোবায়ের করিম বাসায় গিয়ে নেট থেকে পিডিএফ কপি ডাউনলোড করা কয়েকটি তাফসির থেকে সূরা মাউনের ঐ অংশটি ব্যাখ্যাসহ পড়ে দেখলো। ঠিকই আছে, ঐ ইসলামিক স্কলারের কথা এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। জোবায়ের করিমের চিন্তা, টেনশন, উদ্ভীগ্নতা আরো বেড়ে যায়।
নামায আদায় করার জন্য অনেক অল্প-শিক্ষিত মুসলমান কয়েকটি মাত্র সূরা মুখস্থ করে থাকেন। সূরা মাউন তাদের মধ্যে একটি। বেশীরভাগ মুসলমানই নামাযে প্রতিদিন কয়েকবার করে এই সূরা পাঠ করেন। অথচ নামাযে আমরা প্রভূর দরবারে দাঁড়িয়ে কী পড়ছি তা কি আমরা বুঝি? তা কি আমরা জানি? তার সঠিক উপলদ্ধী কি আমাদের আছে? আমাদের কী তা জানা উচিত নয়? জোবায়ের করিম নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন! কি্ন্তু তিনি এর সঠিক উত্তর খুঁজে পান না।
সে ভাবে তার পঞ্চাশ বছর জীবনে যে নামায পড়েছে তা কি ঠিক ছিল? নাকি ঐ নামাযই তাকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাবে! নামায আদায় করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। আরামের ঘুম ত্যাগ করে আলো আধারে বের হয়ে ফজরের নামায আদায় করা বড় ধরনের ত্যাগ বটে! দিনের বেলা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় মত নামায পড়াও বেশ কষ্টের। তাছাড়া একবার নামায পড়ার জন্য পবিত্র শরীর-মন-কাপড় নিয়ে পবিত্র জায়গায় গিয়ে নামায পড়তে হয়। এতসব করার পরও যদি নামাযিদেরকে ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হয়, দূর্ভোগে পড়তে হয় তাহলে তারমত দূর্ভাগা আর কে হতে পারে! এসব ভাবতে ভাবতে জোবায়ের করিম অস্থির হয়ে পড়ে।
সূরা খুঁজে পাওয়ার পর জোবায়ের ঘটনার আরো গভীরে প্রবেশ করে। বিভিন্ন তাফসিরকারকগণ উক্ত আয়াতগুলো নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সে স্টাডি করে । এবার তার কাছে বিষয়টি ভালোভাবে উপলদ্ধিতে আসে। আসলে এখানে এমনসব নামাযির কথা বলা হয়েছে যারা লোক দেখানো নামায পড়ে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আউয়াল ওয়াক্ত ছেড়ে যঈফ ওয়াক্তে নামায আদায় করে। যারা জানা সত্বেও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক নামায আদায় করে না। রুকূ-সিজদা, উঠা-বসা যথাযথভাবে করে না। ক্বিরাআত ও দো’য়া-দরূদ ঠিকমত পাঠ করে না। পাঠকৃত কোন কিছুর অর্থ বুঝে না বা বুঝবার চেষ্টাও করে না। আযান শোনার পরেও যারা অলসতাবশে নামাযে দেরী করে বা জামা’আতে হাযির হওয়া থেকে বিরত থাকে। নামাযে দাঁড়াবার সময় বা নামাযে দাঁড়িয়েও অমনোযোগী থাকে এমনসব লোকদের কথা এখানে বলা হয়েছে।
আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, আর তিনিও তাদের ধোঁকায় ফেলেন। যখন তারা নামাযে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোককে দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।
ইবনু কাছীর বলেন, ‘তারা তাদের ছালাত থেকে উদাসীন’ অর্থ হ’ল, তারা নিয়মিতভাবে বা অধিকাংশ সময়ে আউয়াল ওয়াক্তের বদলে আখেরী ওয়াক্তে ছালাত আদায় করে। (ইবনু কাছীর)।-তাফসীরুল কোরআন, পৃষ্টা ৫০৪। বুঝা যাচ্ছে যারা নামাজ আদায় করে তাদেরকে মিন করেই আল্লাহ ধ্বংস বা দূর্ভোগের কথা বলেছেন।এটা তাদের জন্য যাদের নামাযে কোন না কোন ত্রুটি আছে। মূলত যাদের পরকালে বিশ্বাসের মধ্যে দূর্বলতা আছে তাদের নামাযেই এসব ত্রুটি থাকবে। ন্যায় বিচার, ভাল-মন্দের বিনিময় হাসর কিয়ামত যারা পূর্ণভাবে বিশ্বাস করবে তাদের নামায কোনদিন লোক দেখানো নামায হবে না। সেই নামাযে কোন ত্রুটিও থাকবে না।
সব জেনে জোবায়ের দৃঢ়চিত্তে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয় নামাযে সে আর কখনও অবহেলা করবে না। যতই জরুরী কাজ পড়ুক, যতই চিন্তা-টেনশন-উৎকণ্ঠা থাকুক, যতই ব্যবসা-বানিজ্যের তাড়া থাকুক, যতই পারিবারিক-সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা থাকুক, আওয়াল ওয়াক্তে মসজিদে গিয়েই সে জামা’আতের সাথে নামায আদায় করবে। কারণ আগে নামায, পরে সমাজ। জোবায়ের করিম চায় না ধ্বংস বা দূর্ভোগের মধ্যে পতিত হতে। অতপর জোবায়ের করিমের হতবিহবল ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যায়।
(ইহা একটি আসমানী মেসেজ পরিবেশনা)
# সূরা মাউনের ৪ ও ৫নং আয়াত অবলম্বনে।
৪টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
সুন্দর গল্প।
মন হলো চঞ্চল। সেই মনকে স্থির রাখতে যে পারে, সে-ই প্রকৃত মানুষ।
আমরা যতোই নামাজ পড়ি বা পূজা করি মনের ভেতরে থাকে হাজারো চিন্তা। স্থির মন নিয়ে কেউ কি আর সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে?
চাটিগাঁ থেকে বাহার
যারা স্থির মন নিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে পেরেছেন তারাই হয়েছেন লাখের একজনা। -{@
প্রহেলিকা
শুদ্ধ এবাদত আমরা করতে পারছি কোথায়! চারদিকে কেবল নষ্টগল্প। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ছে ঠিক, সাথে জারি আছে ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করা। ধর্মের দোহাই দিয়ে খুন হচ্ছে অজস্র মানুষ। তারা মসজিদে গেলেও তাদের ধ্বংসই কাম্য।
আগে নিজের আত্মশুদ্ধিতা প্রয়োজন।
ভালো পোষ্ট।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন। -{@ -{@