শৈশবের খেলার সাথী দিনাকে হিংসে হতো খুব। ওদের কতো বড় পরিবার ! নানা-নানু, মা, মামা-খালা সবাই একসাথে। কি ভয়ানক আনন্দের জীবন ওদের ! দুপুরে যখন পুরো শহর নিথর হয়ে থাকতো কিছুক্ষনের জন্যে, বাসার সবাই ঘুমিয়ে, আমি পা টিপে টিপে ছুটে যাই। ওর নানাভাইয়ের বড় বাড়ি। বড় উঠোন। ছুটোছুটি খেলি। অনেকটা খাঁচার পাখি ছাড়া পাবার মত। যেন বিশাল আকাশে ডানা ঝাপটে উড়োউড়ি। ওদের ছাদে উঠি। যদিও সেখানে উঠবার কোন সিঁড়ি নেই। তবুও বিপদজনকভাবে দেয়াল বেয়ে উঠা। ছাদে নুইয়ে থাকা আতাফল গাছ। পাকা আতাফল খাই। গল্প করি। বাড়ির পেছনে গভীর পরিত্যক্ত ডোবা কচুরিপানায় ভরপুর। ছাদ থেকে নীচে তাকাই। ভাবি, অসাবধানে পরে যাই যদি কখনো, কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের। কচুরিপানার নীচেই ভেসে থাকবো হয়তো অনাদিকাল সকলের অজানার মাঝে। রেলিঙবিহীন সেই স্যাঁতস্যাঁতে ছাদ থেকে ছোট্ট দু’টি শিশু পরে যাবার অনেক কারন ছিল যদিও…
প্রায়-ই দুপুরে বাবা লাঠি হাতে তীব্র বেগে ছুটে আসেন। দূর থেকে দেখে আমি ছুটি অন্য পথে বাড়ির দিকে। একদিন আমরা পয়সা জমিয়ে “ছুটির ঘণ্টা” দেখি বাসার পাশের হলে। অন্ধকার হলরুম। পর্দার দৃশ্যকে বাস্তব মনে হয়। ছবিতে__ “অনেকদিনের জন্যে স্কুল ছুটি হয়। ছুটির ঘণ্টা বাজে। সবাই বাড়ি ফিরে যায়। ছোট্ট ছেলেটি যেতে পারেনি। সে বাথরুমে আটকে পরেছে। স্কুলের সবাই সব তালা দিয়ে চলে যায়। ছেলেটিকে পরিবারের সবাই পাগলের মতন খুঁজছে। এইদিকে না খেতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে বাথরুমেই নিস্তেজ হয়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে।”___ আমি চিৎকার করি, ঐ যে… ওখানে… ও-খা-নে। হলভর্তি মানুষ। কেউ আমার কথা শুনতে পায় না। আমি চেঁচাতে থাকি… চেঁচাতেই থাকি। গলা বসে যায়, জোর কমে আসে। অতঃপর …একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো… গানটি স্লোমোশনে বাজতে থাকে। অন্ধকার হলরুমে আলো জ্বলে উঠে। দিনা এবং আমি, আমরা একে অপরের চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পরতে দেখি…
ধীরে ধীরে আমি বড় হই। আমার পরিধি বাড়ে। কলেজ পেরিয়ে ঢাকায় ভর্তি হই। দিনা সেই শহরেই থাকে। ওর পরিধি বাড়ে না। বরং সংকুচিত হতে থাকে। নানাভাই, নানু, মা মারা যায়। মামা-খালা’দের আলাদা সংসার হয়। ততদিনে আমি বুঝতে শিখেছি, দিনার জীবন আসলে ভয়ানক আনন্দের নয়। ওর বাবা-মা’র সুন্দর সংসার নেই। মা মানসিকভাবে অসুস্থ। এভাবে তো আর জীবন চলে না। সংসার চলে না। তাই নানার বাসায় থাকে। লোকমুখে শুনেছি, ওর বাবা ভীষণ ভালোমানুষ। যদিও আমি তাঁকে কখনো দেখিনি।
এক সন্ধ্যায় আঁধার ঘনাবার আগে বড়বেলার আমাদের দেখা। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি শুনে খানিক বিষণ্ণ দিনা বলল__ “রিমি, আমেরিকায় তো নাকি সবাই ব্রেড খায়। ভাত ছাড়া তুই ওখানে ক্যামনে বাঁচবি।” আমি চুপ করে থাকি। বুঝি__ সব-ই মায়া। অনেক বছর বাদে ক্ষণিকের জন্যে একবার আমাদের দেখা। ততদিনে আমরা দু’জনেই সংসারী। ফোনে আমার বাবার কাছ হতে খবর নেই। ফোন নাম্বার জোগাড় করে একদিন ফোন দেই। সে কি উচ্ছ্বাস ! হর্হর্ করে বলে যায় যাবতীয় খবরাখবর। উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন করে যায় অনবরত। আমি কেমন আছি… সুখে আছি কিনা… শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কেমন… ওরা আমায় ভালোবাসে কিনা… আপন করে নিয়েছে কিনা…
এরপর লাইন কেটে যায়। সেই নাম্বারে আর কখনোই ফোন যায় না। ফোন করলেই ভেসে আসে___ আপনি ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন। অনুগ্রহপূর্বক পরে আবার কল করুন…
হাজার হাজার মাইল দুরের এই শহরে সব ব্যস্ততা শেষে সবাইকে খাইয়ে বেলা শেষে আমি যখন একাকি প্লেটে ভাত নিয়ে বসি, দিনাকে খুব মনে পরে। একা একা (শব্দহীন) বলি__ দিনা, আমেরিকায় কিন্তু ভাতও পাওয়া যায়। ভাত ছাড়া কি আর বাঙালি বাঁচে !
## কিছু সম্পর্ক কখনো শেষ হয়ে যায় না। যোগাযোগ না থাকলেও, হাজার মাইল দূরে থাকলেও সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, অনুভবে…
২৫টি মন্তব্য
কৃন্তনিকা
কিছু স্মৃতি আজীবন অন্যরকম অনুভূতি দেয়।
ভালো লাগলো। নিজেরো অনেক স্মৃতি ভেসে উঠলো…
রিমি রুম্মান
হাজারো ব্যস্ততার মাঝে আমরা সবাই একান্তে স্মৃতিতে হারাই। বিড়বিড় করে কথা বলি প্রিয় মানুষগুলোর সাথে। তাই না ?
আশা জাগানিয়া
কিছু স্মৃতি কখনোই মরে যাবে না,থাকবে নিজের কাছে আজীবন।ভালো লিখেছেন আপু।
রিমি রুম্মান
কিছু মানুষ থাকে অনুভবে, ভালোবাসায় …
তাঁদের স্মৃতি কি কখনোই হারায় ?
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আপনার এই অনুভুতিগুলো এতো সুন্দর করে প্রকাশ করেন যে, ভাবনায় ডুবে যাই। হ্যাঁ, কিছু সম্পর্ক আসলেই এমন। যোগাযোগ থাকে না কিন্তু ভালবাসায়, অনুভবে বেঁচে থাকে।
অনুভুতির এই প্রকাশগুলো ছুঁয়ে যায় মনকে।
রিমি রুম্মান
এমন কিছু দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি আমাদের সবারই থাকে, তাই না ? জীবনের একটা পর্যায়ে এসে দূরত্ব বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি বাড়ে ?
খেয়ালী মেয়ে
“রিমি, আমেরিকায় তো নাকি সবাই ব্রেড খায়। ভাত ছাড়া তুই ওখানে ক্যামনে বাঁচবি।”—কত্তো মায়াময় জিজ্ঞাসা!!!!!!!!! এমন মায়াময় স্মৃতি সাথে নিয়েই সবাই সামনে এগিয়ে যায়—যে যতোই বলুক না কেনো যে একদিন সবাই ফেলে যাওয়া দিনগুলোর সবকিছু ভুলে যায়, আসলে তা না-সত্যি হচ্ছে ফেলে আসা দিনগুলো একদিন নতুনরূপে নতুন করে প্রিয়কিছু স্মৃতি হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়, করে তোলে আমাদেরকে নস্টালজিক….
আপনার স্মৃতি রোমান্থন দারুন………..
রিমি রুম্মান
স্বল্প পরিধি’তে বেড়ে উঠা আমার বান্ধবীটি’র কত সহজ সরল জিজ্ঞাসা, তাই না ? যাক্ ফেসবুকে লেখাটি দেখে দিনা’কে চেনে এমন একজন কথা দিয়েছে তাঁর ফোন নাম্বার যোগাড় করে দিবে। আমি খুব উচ্ছ্বসিত যে অনেক বছর পর আবারো কথা হবে আমাদের।
খেয়ালী মেয়ে
জেনে ভালো লাগলো যে আপনাদের আবার কথা হবে…
বেঁচে থাকুক বন্ধুত্বতা,ভালো থাকুক মায়ার বন্ধুটি..
শুভকামনা রইলো আপনাদের জন্য..
জিসান শা ইকরাম
অসাধারন আবেগ আনতে পারেন আপনি লেখায়
এমন দুএকটা সম্পর্ক আমারো আছে
কিন্তু আপনার মত লিখে প্রকাশ এই জনমে করতে পারবো না।
দিনা রিমিরা ভালো থাকুক
চির অমলিন থাক এমন সম্পর্ক।
রিমি রুম্মান
কিছু সম্পর্ক কখনো হারায় না। কিছু মানুষ থেকে যায় অনুভবে। এমন সম্পর্ক আমাদের সবারই থাকে। হাজারো ব্যস্ততার মাঝে কেমন করে যেন হঠাৎ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। আবেগি করে। বিড়বিড় করে কথা বলি। এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তবতা।
সোনিয়া হক
কেমন কান্না চলে আসলো আপু।এ যেন আমারই কথা লিখলেন।’কিছু সম্পর্ক কখনো শেষ হয়ে যায় না। যোগাযোগ না থাকলেও’।
রিমি রুম্মান
আমার মনে হয়, আমরা সবাই এমন কিছু সম্পর্ক, এমন কিছু স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে যাই জীবনের কোন না কোন সময়ে… ভাল থাকবেন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সত্যিই ছুটির ঘন্টা ছবিটি নিয়ে অনেকের অনেক মজার ঘটনা আছে।সুন্দর প্রানবন্ত উপস্থাপনা।
রিমি রুম্মান
ধন্যবাদ। শুভকামনা রইলো। ভাল থাকুন সবসময়।
অলিভার
স্মৃতির পাতায় আটকে থাকে সম্পর্ক, এগিয়ে যায় সময়। তবুও সময়ে অসময়ে তারা এসে সামনে দাড়ায়, বলে যায় “ভুলো না, ভুলো না আমায়”
রিমি রুম্মান
মনের অজান্তেই আমরা হারাই সেইসব স্মৃতিতে, সেইসব শৈশবে। এমনটি সকলেরই হয়, তাই না ?
মেহেরী তাজ
পরে কি দিনা আপুরর কোন খোজ আর পেয়েছেন?
বরাবরের মত অন্নেক ভালো লেগেছে। ভাত ছাড়া আসোলেই বাঙালী বাঁচে না।
দূর প্রবাসে ভালো থাকুন আপু।
রিমি রুম্মান
এখনো সন্ধান পাইনি। তবে একজন কথা দিয়েছে, তাঁর ফোন নাম্বার যোগাড় করে দিবে বলে। আমি আশাবাদী, সে চাইলেই পারবে যোগাড় করে দিতে।
রাইসুল জজ্
কিছু সম্পর্ক আত্নার খুব কাছের । দুরত্ব আর সময় কে হার মানায় ।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। শুভকামনা জানবেন।
শুন্য শুন্যালয়
কতো স্মৃতি, কতো মায়া। এমন আবেগে সবকিছু টেনে আনলেন আপু, মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। দূর থেকে কতো কিছুই আমাদের অনেক সুখের মনে হয়!!
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো, ইশ কি ভয়ংকর!! সত্যিই যদি রেলিংবিহীন ছাদ থেকে পড়ে যেতেন।
রিমি রুম্মান
সেই সব স্মৃতি মনে হলেই আমার নিজেরই গা শিউরে উঠে। সেদিন সেই অনিরাপদ ছাদ থেকে ছোট্ট আমি পরে যাইনি বলেই আজ সোনেলায় আপনাদের মাঝে, প্রিয় মানুষদের মাঝে আমি। রাখে আল্লাহ্ , মারে কে !
ব্লগার সজীব
আপনার লেখা পড়ে আমিও স্মৃতির মাঝে ডুবে গেলাম আপু।আপনার লেখায় যে কত আবেগ।বার বার পড়ি।
রিমি রুম্মান
জেনে ভাল লাগলো। এমন মন্তব্যে আমি লেখালেখিতে উৎসাহ বোধ করি। একটি লেখা কেউ যদি দ্বিতীয়বার পড়ে, নিঃসন্দেহে সেটি লেখাটিকে সার্থক করে তোলে। ভাল থাকবেন।