হারিস মন্ডলের গরুকে রামু ও কৃষ্ণার বিষ খাওয়ানো
অবস্থাসম্পন্ন হারিস মন্ডলের বাড়ি। একটা কুকুর করুণ স্বরে ডাকছে। টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কুপির তীর্যক রশ্মি দেখা যায়। বেড়ার বুননের ফাঁক দিয়ে কুপির আলো দেখা যায়। এমন নিশুতি রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই কানে আসে না। ডোমপাড়ার সবাই সন্ধ্যারাতেই অতল ঘুমে তলিয়ে যায়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর সন্ধ্যা থেকে নেশাজল করার কারণে রাত না হতেই ওদের চোখে গহীন রাত নেমে আসে নিশ্চুপে। হঠাৎ হারিস মন্ডলের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বিছানায় শুয়ে হারিসের সাথে গল্প শুরু করে। খুব ক্ষীণ আলাপান হলেও ঘুমের রাজ্যে সে কথা স্পষ্ট শোনা যায়।
কৃষ্ণা সে রাতেই গরুকে বিষ খাওয়ানোর জন্য মুখে কাপড় বেঁধে হারিস মন্ডলের বাড়ির পাশের ডোবায় ঘাঁপটি মেরে রামুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রামু আসে।
কৃষ্ণা: এতনা দেরী কাহে করে?
রামু: ও গণেশ কাকা যেতনা রাত হোককে তেনি যায় বোলে রাহা। ওকের সঙ্গে বাত বোলতে বোলতে তেনি দেরী হোগা।
কৃষ্ণা: ও আচ্ছা!
হারিস মন্ডল এবং তার স্ত্রী ফাতেমার কথাবার্তা শুনে ওরা সাবধান হয়।
ফাতেমা: শুনছেন! ঘুমাইলেন নাকি।
হারিস : না। বলো শুনতাছি।
ফাতেমা: চারিদিকে নাকি চোরের উপদ্রব হইছে। চোরেরা নাকি দল বাইন্ধ্যা গরুরে বিষ খাওয়াইয়া মারতাছে।
হারিস: তাই নাকি?
ফাতেমা: হ। সেইদিন রাইতে চোর আমেনাগো বড় গরুডারে বিষ খাওয়াইয়া মাঠে লইয়া গ্যাছে। তারপর চামড়া ছিইল্যা গরুর দেহডারে ফালাইয়া থুইয়া গ্যাছে।
হারিস: আমিনা বুঝলো ক্যামনে যে ওইডা অগোই গরু?
ফাতেমা: সকালে উইঠা দেখে গোয়ালের বড় গরুডা নাই। খুঁজতে খুঁজতে চকে গিয়া দেখে বড় গরুডা মইরা পইড়া আছে, গায়ের চামড়া নাই।
হারিস: শালা ওই ডোমেরা অভাবে পড়লেই এই অকাম গুলান করে।
ফাতেমা: টর্চ জ্বালাইয়া একাবার দেইখ্যা আসবা নাকি গরু গুলান ঠিকঠাক মতো আছে কিনা?
হারিস: হাসির কথা কইলা বউ। হারিস মন্ডলের গোয়ালের গরুরে বিষ খাওয়াইবো। এতবড় বুকের পাটা অগো আছে! আমার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এই কাম কইরা কেউ ধরা খাইলে গায়ের চামড়া ছিইলা জুতা বানাইয়া ফালামু না! অনেক রাইত হইছে তুমি ঘুমাও। আমার বাড়িতে এই কাম করার সাহস অগো হইবো না।
রামু: এই কৃষ্ণা শালা তো অভিতক শুতে নেইকে।
কৃষ্ণা: হাম হিয়া খাড়াকে পাহাড়া দেতিন। তে চুপ করেকে চাড়িকে ভিতর চিমোল দেকে আও।
রামু: ঠিক বায় চিমোকে শিশিঠো দোও।
রামু গোয়াল ঘরের দিকে এগুতেই ডোমপাড়ার এক কুকুর তাদের ঘিরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
কৃষ্ণা: রামুরে সর্বনাশ ভোগা। কুত্তা যে ভুকোতে হামনিককে ঘিরমে ধরেবায়। অভি যদি সবকই জাগবায় তব হামনিককে উপায় কা হই!
রামু: আরে ডরাইয়ামত। তব কুত্তা আরো ঘিরকে ধরি। কুত্তার সঙ্গে জানা আদমি এইসন বাত বোলেছে কুত্তা মান যায়ি। আর ঘেউ ঘেউ না করি।
রামু: চু চু চু আরে ঘেউ ঘেউ করিয়ে মত্ দোস্ত। চুপ র চুপ র।
গলায় হাত দিয়ে রামু কুকুরটিকে আদর করার চেষ্টা করে। কুকুর আদর না নিয়ে ওদের ওপড় চড়াও হতে চায়।
ঘরের ভেতরে ফাতেমা আবার হারিস মন্ডলকে বলে…।
ফাতেমা: কুকুরটা অমন ডাকতাছে ক্যান? এই, উইঠা গোয়াল ঘরটা দেইখা আসে তো।
হারিস: রাইত হইছে বউ ঘুমাও…।
হারিস মন্ডলের ঘরের কুপি নিভে গেলে রামু ও কৃষ্ণার বুকে সাহস ফিরে আসে। রামু ও কৃষ্ণা এতক্ষণ ঝিম মেরে ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। কুপি নিভে যাবার সাথে সাথে কুকুরটাও কেমন যেনো নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। আক্রমণ করে না কিন্তু ভয় দেখায়।
রামু: রুটি লিয়াইকে বোলেরিহা লিয়াইবারে?
কৃষ্ণা: হ লিয়াইবানি।
রামু: দে রুটিমে বিষ মিলাইকে কুত্তাকে খিয়াইব্। শালা খুব তেড়িবেড়ি করোতে।
কৃষ্ণা: তো হামনিককে সারারাত কা খাইব্? খালি প্যাটমে তো সারারাত জাগা না যায়ি। রাতিকে শুতযায়েছো তো হামনিককে চামড়া না পাইব্। সকাল বেলা কেউ না কেউ আকে আগে আগেই চামড়া ছুলা শুরু করেদেহি। তব সারারাত জাগকে মিলি ছোটকা এগো ভাগ। তাও যদি ছিলেকে আগে ধরি সক্লেই আর না হকেছে আক্কু গাঁথেসকলি। হামনিককে যায়েকে আগে যদি কেউ পুরাঠো ছিলোলে তব এককো ভাগ না পাইব্ এককো পয়সা কড়িও না পাইব্।
রামু: অভি যদি কুত্তাকে ডাকমে আদমি-জন উঠযায়ে তব ধরাতো পরোব মার এগো মাটিমে না গিরি। তব আমও যাই ছালাও যাই। দো দো রুটি দো!
কুকুর আবার ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। কৃষ্ণা কোনো উপায়-অন্তর না দেখে কোমড়ে বাঁধা গামছার পুটলি থেকে একটা রুটি বের করে রামুকে দেয়। রামু বিষ মাখিয়ে দূরে ছুড়ে মারে। কুকুর সেদিকে ছুটে যায়।
রামু: কৃষ্ণা, তে হিয়া খাড়া র হাম চারিমে চিমোল দেকে আতিন।
কৃষ্ণা: তে আসলেই বুদ্ধিমান রে রামু।
কৃষ্ণা ঝোপের মধ্যে বসে লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকতে থাকে। একটু পরেই রামু আসে।
রামু: খেল খতম। চল কৃষ্ণা ঝরছে খসক যায়া।
কৃষ্ণা: চল।
(……………………………………..চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
১. http://sonelablog.com/archives/12440
২. http://sonelablog.com/archives/12475
৩. http://sonelablog.com/archives/12531
৪. http://sonelablog.com/archives/12788
৫. http://sonelablog.com/archives/12859
৬. http://sonelablog.com/archives/12944
৭. http://sonelablog.com/archives/13003
৮. http://sonelablog.com/archives/13126
৯. http://sonelablog.com/archives/13269
১০. http://sonelablog.com/archives/13617
১১. http://sonelablog.com/archives/14926
১০টি মন্তব্য
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
এত গুলো পর্ব আগে প্রকাশ করেছেন এখানে ? প্রথম থেকে পড়ে মন্তব্য করতে হবে ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, ওয়ালিনা চৌধুরী অভি, টুকটাক লিখি, আর এখানে আমার আরো কিছু লেখা আছে দেখতে পারেন। সাথে থাকবেন।
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
পড়ছি ধীরে ধীরে 🙂
সাতকাহন
ধন্যবাদ ওয়ালিনা।
ব্লগার সজীব
অনেক দিন পরে পোষ্ট দিলেন । পুর্বের পর্বের কাহিনী তো প্রায় ভলে গিয়েছি । নিয়মিত লিখুন ভাই । আপনি অনেক গুনি মানুষ , বুঝেছি তা ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ ব্লগার সজীব, অফিসিয়াল কাজের চাপ আর পিএইচডি’র গবেষণার কাজে পুরো চ্যাপ্টা হয়ে গেছি ভাই। রেগুলার সময় করতে পারি না।
শুন্য শুন্যালয়
আরে আমিতো ভাবলাম আপনি কই হাওয়া হলেন। পড়েছি এবং পড়বো। আমরা পাঠকরা শুধু ভাবি লেখকদের শুধু একটা কাজই হওয়া উচিত -লেখা 🙂
সাতকাহন
শুন্য, ভাইরে ভাটি অঞ্চলের এই পোড়ার দেশে লেখালেখি করে পেটের ক্ষুধা মিটানো যায় না, তাই বাধ্য হয়েই কামলা খাটতে হয়। তবে এই উপন্যাসটি এখন থেকে নিয়মিত চালিয়ে যাবো, আশা করি ২০-২৫ পর্বেই সমাপ্তি টানতে পারবো।
জিসান শা ইকরাম
দির্ঘ বিরতি , আমার মেমোরী কার্ড এ ঝাকি দিতে আছি , আগে কি পড়েছিলাম 🙂
ঝাকি দিতে দিতে মনে পরেছে ।
বর্তমানে শুধু একটি উপন্যাসই পড়ি , সেটা আপনার ।
পর্বের অপেক্ষায় ।
সাতকাহন
জিসান ভাই, এটা আমার সৌভাগ্য।