সুপ্রিয় ব্লগারগণ, সবাইকে কোরবানী ঈদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ঈদ মোবারক। আগের ব্লগে দৈনন্দিন বাস যাত্রীদের নিয়ে কিছু প্রকারভেদের ব্যাপারে লিখেছিলাম। এই যানজটের ব্যস্ত শহরে প্রতিদিন নিত্য নতুন বাস যাত্রীদের সাথে চলাফেরা আমার আপনার নিত্য দিনের।

রাত পোহালেই এদের সাথেই আমাদের যাতায়াত করতে হয়। একেক দিন নতুন সহযাত্রীদের সাথে ভ্রমণ তথা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ। সেই আলোকে এই লেখার অবতারণা। তাহলে শুরু করা যাক।

পেইনফুল যাত্রীঃ এই টাইপের যাত্রীগণ বাসে উঠে আপনাকে বা এই যাত্রীর সহযাত্রীদের ভালোই যন্ত্রণা করবে। যেমনঃ বাস জ্যামে দাঁড়িয়ে রইলে গরমে সেইরম টাইপ ছটফট শুরু করবে আর এদিক সেদিক মোরামুরি করবে। এমনিতেই বাসে তিল ধারণের জায়গা নাই আর উনার উফ্ উফ্ এর জন্য আপনার নাকাল অবস্থা। যেন সারা বাসের গরম উনারই লাগছে আর বাসের বাকি যাত্রীদের সবাই যেন গরম লাগে না । এরা বাসে উঠেই অন্য যাত্রীদের পেইন দেয়ার জন্য।

এরা মূলত সহযাত্রীদের পেইন দেয়ার জন্য বাসে উঠে

অধৈর্যশীল যাত্রীঃ এসব যাত্রীদের মাঝে ছটফটের প্রবণতা বেশী। যেমন বাস জ্যামে পরলে প্রথমে ড্রাইভারকে গালমন্দ করবে এবং বলবে “আরে ব্যাটা একটু আগে আইলেই তো সিগন্যালে পরতি না বা “বাস খালি বামে চাপাস কেন??? ডান দিক চিনস না“। এরপর পর কনডাক্টরকে সামনে পেলে ও কে দুচার কথা শুনিয়ে দিবে কারণ ন্যায্য ভাড়া থেকে দু-একটা বেশী নিয়েছে বলে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওনাদের ধৈর্য সহ্য একবারেই মাইনাসের কোঠায় বললেই চলে।

মোবাইল কথক যাত্রীঃ এই হল আরেক টাইপের যাত্রী। দিনের বেশীর ভাগ সময়ই মনে হয় মোবাইল কানে লাগিয়েই রাখে, সেটা কাজেই হোক আর অকাজেই হোক। আর বাসে উঠলে মাত্রাটা আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল। তীব্র জ্যাম আর বাসের আশে পাশের অন্যান্য যানবাহনের হর্ণ এবং যাত্রীদের চিল্লাচিল্লি ইত্যাদির মাঝেও উনারা দিব্যি কথা বলে যায়। কথা বলার ক্ষেত্রে একটুও সমস্যা হয় না। আর এমন আস্তে আস্তে কথা বলে যে পাশের সিটের বা পাশে দাঁড়ানো লোকও উনাদের কথা শুনতে পায় না।

আর যারা আসলেই মোবাইল কথক যাত্রী এবং মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় তাদের কাছে কনডাক্টর যদি ভুল করে ভাড়া চেয়ে বসে তাহলে রক্তচুক্ষ দেখিয়ে ছাড়ে। মনে হয় কনডাক্টর ভাড়া চেয়ে যেন বিশাল পাপ করে ফেলেছে!!!

ইন্টারনেট যাত্রীঃ এসব যাত্রীরা দিন রাত ২৪ ঘন্টাই মনে হয় ইন্টারনেটে পরে থাকে। বাসে উঠলে এদের ফেইসবুক, ভাইবার, স্কাইপ, ওয়াটস-এপ, নিমবাজ ইত্যাদির কথা মনে পরে। আর টাইম টু টাইম এসব সোস্যাল জায়গা গুলোতে আপডেট দিতে থাকে। বাসে এসব যাত্রীদের মধ্যে ৯০% ই “FaceBook” বা অন্যান্য সোস্যাল ইউজার যাত্রী থাকে। বাকি ৫% অন্যান্য যেমন- ইমেইল, পেপার, শেয়ার বাজার ইত্যাদি ভিজিট করে। বাকি ৫% এর কাছে নরমাল মোবাইল “আলু-খালু [হ্যালো]” ছাড়া আর কোন আলাপ করে না।

*জ্যাম-ফি/সেলফি যাত্রীঃ এই যাত্রীকে দেখা আমার এক নতুন তরতাজা অভিজ্ঞতাও বলতে পারেন। এসব যাত্রীরা তীব্র জ্যামই থাকুক বা ঝুলেই থাকুক উনারা “সেলফি/কুলফি/জ্যাম-ফি” ইত্যাদি পিক অনলাইনে শেয়ার দিতে ভুলে না। আর এর জন্য উনাদের সর্বোত্তম জায়গা হচ্ছে বাস। এদের সাথে ইন্টারনেট যাত্রীদের মিল রয়েছে।

যেমনঃ ঐদিন মার্কেটিং করে নিউমার্কেট থেকে ২৭ নং বাসে উঠে বাসার দিকে ফিরছিলাম। আমি একে বাসে বাসের শেষ দিকটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি যে সিটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঐ সিটের একজন উনার “ইষমাট ফোন” দিয়ে কিছু মরা মার্কা, ঘামাচ্ছন্ন ছবি তুলল। তখন বাস কলাবাগানের সিগন্যালের জ্যামে আটকা। এরপর দেখি উনি সাথে সাথে “FaceBook” লগ-ইন করে উনার মরা মার্কা পিক গুলো শেয়ার করল। এই হচ্ছে নতুন টাইপের “জ্যাম-ফি” যাত্রী  neutral

জ্যাম-ফি নাম টা কিন্তু আমার দেয়া”  tongue

পাঠক যাত্রীঃ এই টাইপের যাত্রীরা বাসে উঠলেই দেখবেন যে হাতে কোন পত্রিকা/বই/খাতা রয়েছে। বাসে এত জ্যাম, ভীড় যাই থাকুক না কেন উনারা সাবলীল ভাবে উনাদের পড়া চালিয়ে যান। খুবই মনযোগী যাত্রীও বলা চলে এদের। আর কিছু যাত্রী এসব না পেলে বিল-বোর্ড, রাস্তা ঘাটের সাইনবোর্ড ইত্যাদি পাঠ করে নতুবা পাশের জনের কাছে থাকা পত্রিকা উঁকি মেরে পাঠ করে।

ঝুলন্ত যাত্রীঃ এসব যাত্রীদের দেখা বেশীর ভাগ সময়ই বাসের দরজার সামনেই দেখবেন। এরা বাসে ঝুলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে। যেমন বাসে যখন তিল ধারণের ও ঠাঁই থাকে না তখন বাস যদি জ্যামে বা সিগন্যালে আটকা পরে তখন এদের উপস্থিতি ঘটে। হেলপারের শত মানা করা সত্ত্বেও এরা ঝুলেই থাকে। এরা অনেকটা দন্ডায়মান যাত্রীদের মতই। বাসের দরজা থেকে এদের সহজে সরানো যায় না।

*লেডী ভিলেন যাত্রীঃ এই টাইপের যাত্রীরা বেশ বিরল। এসব যাত্রীরা বেশীর ভাগই মধ্য বয়স্ক মহিলারাই হয়। তবে এরা ভাড়া নিয়ে প্রায়ই কনডাক্টরের সাথে কম-বেশী ঝগড়া করে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাটা এখানে খানিক ভিন্ন।

ঐদিন ৫০% মার্কেটিং শেষ করে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম বাকিটা শেষ করব বলে। বাস ইডেন কলেজের সামনে এসে সিগন্যালে পরল। ঠিক ঐ টাইমে একজন মেয়ে ব্যাগ-প্যাক নিয়ে ঐ বাসে উঠল গাবতলী যাবে। কনডাক্টর মামাও খানিক সাহায্য করল একা মেয়েটিকে। মেয়েটি যেই সিটে বসেছিল তার ঠিক সামনের সিটে একজন ছেলে বসেছিল। বসার পর বৃষ্টি নামল আর বাস তো যথারীতি সিগন্যালে। হঠাৎ বাসে ঝগড়ার শব্দ। দেখি যে ঐ দুজন ঝগড়া করছে বাসের জানালা বন্ধ করা নিয়ে। কারণ ছেলেটির গায়ে বৃষ্টির পানি পরছিল বলে ছেলে টি জানালা বন্ধ করেছিল। আর মেয়েটির গরম লাগছিল বলে উনি জানালা খুলে দিয়েছিল। সে কি ঝগড়া রে!!! বাসের কেউ সাহস করে ঝগড়া থামাতে গেল না। ঝগড়ার এক পর্যায়ে মেয়েটি বলে উঠে আমি অমুক কলেজের ছাত্রী। আর একটা কথা বললেই সমস্যা হবে কিন্তু বলে দিলাম, মেয়েটি সেই ছেলেটিকে রক্কম টাইপের থ্রেট দিল। এরপর দেখলাম যে, ছেলেটি কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে রইল।

আর যাই হোক এসব লেডী ভিলেন থেকে সাবধান থাকিয়েন। কোন সময় না আবার হিতে বিপরীত হয়ে যায়। তাই চুপচাপ থাকাটাই মঙ্গল।

মাইক-কন্ঠী যাত্রীঃ এসব যাত্রীদের এমনটি নামকরণের একটা কারণ আছে। কেননা এদের গলা কোন অংশে মাইকের চেয়ে কম না। মোবাইল বা কারও সাথে এমন ভাবে কথা বলবে যে, সারা বাসের সবাইকে যেন সেটা জানাতেই হবে অর্থাৎ গলা ফাঁটিয়ে চেঁচানো যাকে বলে। আর কনডাক্টর যদি ভাড়া চায় তাহলে সেটার প্রতিউত্তর ও মাইকের কন্ঠে দেয়।

দলবল যাত্রীঃ এরা কোন সন্ত্রাসী যাত্রী না। মানে দুয়ের অধিক যাত্রীদের এরূপ নামকরণ করা আর কি। এই টাইপের যাত্রীরা বেশীর ভাগই ছাত্র-ছাত্রী, একই অফিসের স্টাফ বা কয়েকজন বন্ধু মিলে হয়ে থাকে। এদের বেশীর ভাগ সময়ই আস্তানা বাসের পিছনে হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এদের পরস্পরের কথা বলার প্রাবল্যতা মাইক-কন্ঠী যাত্রীদের সাথে মিলে যায়।

*ডিজুস/উদ্ভট যাত্রীঃ এসব যাত্রীদের দেখবেন মাথায় এক ঝাঁকড়া চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। আবার অনেকের ঘন ও থাকতে পারে। পরনে থাকে রং বেরঙের টি-শার্ট ও ছিঁড়া-ফাঁড়া বা জোড়া তালি দেয়া জিন্সের প্যান্ট। ডিজুস ভাষায় যেটাকে “ইষটাইল” বলে আর কি। পায়ে থাকবে ঝিকঝ্যাক টাইপের কনভার্স/স্নিকারস বা কোন স্পোর্টস ওয়্যার টাইপের জুতা। কানে সর্বদা হেডফোন লাগানোই থাকে মনে হয়।

বাসে উঠা মাত্রই দেখবেন যে সবাই উনার দিকে একবার হলেও তাঁকাবে। বাসে মুরুব্বী টাইপ কেউ থাকলে হয়ত বা মনে মনে “ডিজিটাল ভিখারী” এর খেতাব ও দিয়ে দিতে পারে।। অতঃপর ডিজুস গানের তালে তালে মাথা ঝুলাবে এবং জ্যামের মজা উপভোগ করবে। ও আরেকটা ব্যাপার এদের বাচনভঙ্গি ও ডিজুস টাইপের। ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন এসব ডিজুস যাত্রীগণ খুব “ইষটাইল” করে কথা বলবে। এটা উনাদের ডিজুস ভাষা tongue

*ক্ষতিকারক যাত্রীঃ এসব যাত্রীদের থেকে আমাদের মত সাধারণ যাত্রীদের বিশেষ সর্তক থাকতে হয়। কারণ এরা অজ্ঞান বা মলম পার্টি, পকেটমার, চোর ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে আমাদের মত সাধারণ যাত্রীদের ক্ষতি করে। পকেটমারের ক্ষেত্রে এসব করার সবচেয়ে ভালো জায়গা হল ভীড় বাস। অজ্ঞান বা মলম পার্টিদের বেশীর ভাগ সময় দূরপাল্লার বাসেই টার্গেট থাকে। আর চোরেরা তো সব পরিবেশেই ক্ষতি করে বসে। এদের গ্রুপে নারী-পুরুষ সবই থাকে। সাধারণ যাত্রীদের ক্ষতি করার জন্য এরা নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে চলে।

তাই যাত্রাকালে যথা সম্ভব সাবধান থাকবেন। নিজেও সর্তক থাকবেন এবং অন্যকেও সর্তক করবেন।

যাই হোক এই ছিল নতুন পাওয়া আরোও কিছু বাস যাত্রীদের প্রকারভেদ। আপনারা যদি নতুন কোন টাইপের যাত্রীর খোঁজ পান তাহলে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

পূর্বের ব্লগটি যারা মিস করেছেনঃ রম্য পোস্টঃ বাস যাত্রীদের প্রকারভেদ-জীবন থেকে নেয়া

৫৩২জন ৫৩২জন
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ