বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী একদিন পূজার জন্য ফুল তুলতে গেলে সুন্ধ্যা গ্রামের জয়ানন্দের সাথে দেখা হয়। প্রথমদর্শনেই জয়ানন্দ চন্দ্রাবতীর প্রেমে পড়ে যান এবং প্রেম নিবেদন করে একটি বিদায় পত্র লেখেন। একসময় তাদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। এরইমধ্যে এক মুসলমান তরুণী তাদের মধ্যে ঢুকে পরলে আসন্ন প্রণয়কাব্য জয়ানন্দ কর্তৃক মন্দিরের দরজায় লেখা পত্রের মধ্য দিয়ে করুণ উপাখ্যানে পরিণত হয়। চন্দ্রাবতীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর উপর গীতিকাব্যটি রচনা করেছেন নয়ানচাঁদ ঘোষ, আনুমানিক ২৫০ বছর আগে। নেয়া হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে। মোট ৩৫৪টি ছত্র আছে এতে, দীনেশচন্দ্র সেন এগুলোকে ১২টি অঙ্কে ভাগ করেছেন।
(১) ফুল তোলা
“চাইরকোনা পুষ্কুনির পারে চম্পা নাগেশ্বর।
ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।।”
“আমার বাড়ী তোমার বাড়ী ঐ না নদীর পার।
কি কারণে তুল কন্যা মালতীর হার।।”
“প্রভাতকালে আইলাম আমি পুষ্প তুলিবারে।
বাপেত করিব পূজা শিবের মন্দিরে।।”
“বাছ্যা বাছ্যা ফুল তুলে রক্তজবা সারি।
জয়ানন্দ তুলে ফুল ঐ না সাজি ভরি।।
জবা তুলে চম্পা তুলে গেন্দা নানাজাতি।
বাছিয়া বাছিয়া তুলে মল্লিকা-মালতি।।
তুলিল অপরাজিতা আতসী সুন্দর।
ফুলতুলা হইল শেষ আনন্দ অন্তর।।
এক দুই তিন করি ক্রমে দিন যায়।
সকালসন্ধ্যা ফুল তুলে কেউনা দেখতে পায়।।
ডাল যে নোয়াইল ধরে জয়ানন্দ সাথী।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী।।
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায়।।
(২) প্রেমলিপি
পরথমে লিখিল পত্র চন্দ্রার গোচরে।
পুষ্পপাতে লেখে পত্র আড়াই অক্ষরে।। *
পত্র লেখে জয়ানন্দ মনের যত কথা।
“নিতি নিতি তোলা ফুলে তোমার মালা গাঁথা।।
তোমার গাঁথা মালা লইয়া কন্যা কান্দিলো বিরলে।
পুষ্পবন অন্ধকার তুমি চল্যা গেলে।।
কইতে গেলে মনের কথা কইতে না জুরায়।
সকল কথা তোমার কাছে কইতে কন্যা দায়।।
আচারি তোমার বাপ ধর্ম্মেকর্ম্মে মতি।
প্রাণের দোসর তার তুমি চন্দ্রাবতী।।
মাও নাই বাপ নাই থাকি মামার বাড়ী।
তোমার কাছে মনের কথা কইতে নাহি পারি।।
যেদিন দেখ্যাছি কন্যা তোমার চান্দবদন।
সেইদিন হইয়াছি আমি পাগল যেমন।।
তোমার মনের কথা আমি জানতে চাই।
সর্ব্বস্ব বিকাইবাম পায় তোমারে যদি পাই।।
আজি হইতে ফুলতোলা সাঙ্গ যে করিয়া।
দেশান্তরি হইব কন্যা বিদায় যে লইয়া।।
তুমি যদি লেখ পত্র আশায় দেও ভর।
যোগল পদে হইয়া থাকবাম তোমার কিঙ্কর।।”
* আড়াই অক্ষর : অতি সংক্ষিপ্ত। আড়াই অক্ষরে মন্ত্রের কথা অনেক প্রাচীন বাঙ্গালা পুঁথিতেই আছে। ময়মনসিংহের গীতি-কাব্যগুলির মধ্যে অনেক জায়গাতেই আড়াই অক্ষরে লিখিত চিঠির কথা পাওয়া যায়।
(৩) পত্র দেওয়া
আবে করে ঝিলিমিলি সোনার বরণ ঢাকা।
প্রভাতকালে আইল অরুণ গায়ে হলুদ মাখা।। *
হাতেতে ফুলের সাজি কন্যা চন্দ্রাবতী।
পুষ্প তুলিতে যায় পোথাইয়া রাতি।। **
আগে তুলে রক্তজবা শিবেরে পূজিতে।
পরে তুলে মালতীফুল মালা না গাঁথিতে।। ***
হেনকালে নাগর আরে কোন কাম করে।
পুষ্পপাতে লইয়া পত্র কন্যার গোচরে।।
“ফুল তুল ডাল ভাঙ্গ কন্যা আমার কথা ধর।
পরেত তুলিবা ফুল চম্পা-নাগেশ্বর।।”
“পুষ্প তোলা হইল শেষ বেলা হইল ভারি।
পূবেত হইল বেলা দণ্ড তিন চারি।।
আমারে বিদায় কর না পারি থাকিতে।
বসিয়া আছেন পিতা শিবেরে পূজিতে।।”
“আজিত বিদায় লো কন্যা জনমের মত।”
চন্দ্রার হাতে দিল আরে সেই পুষ্পপাত।।
পুত্র নাইসে নিয়া কন্যা কোন কাম করে।
সেইক্ষণ চল্যা গেল আপন বাসরে।।
* আবে … … … মাখা : অরুণদেবের স্বর্ণ বর্ণ মেঘ ভেদ করে ঝিলমিল করছে। তিনি হলুদ দ্বারা স্নাত হয়ে উদিত হয়েছেন।
** পোথাইয়া : পোহাইয়া
*** “না” অর্থশূন্য হলেও এখানে “হ্যাঁ” অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে মূলত কথাটার উপর জোর দেয়ার জন্য।
২০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
অনেক অনেক ধন্যবাদ চন্দ্রাবতীকে তুলে এনেছেন এখানে
আমরা যারা আধুনিক কাব্য চর্চা করি , তারা অনেকেই এই চন্দ্রাবতী গীতিকা জানি না।
কৃতজ্ঞতা এমন পোস্ট দেয়ার জন্য
শুভকামনা
কাফি রশিদ
সঙ্গীতের অ্যাতো চমৎকার একটা ধারা আমাদের আছে এটা অনেকে জানেই না। যারা জানে তাদের অনেকে নাক সিটকায় এর ভাষার ব্যবহারে, এটা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। “মৈমনসিংহ গীতিকার ভাষা গ্রাম্য, এগুলো দরিদ্র মুসলমান আর চাষা-ভূষাদের গান” – দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও এইরকম কথাবার্তার সম্মুখীন হয়েছেন।
ধন্যবাদ জিসান শা ইকরাম।
জিসান শা ইকরাম
আমার আগ্রহ খুব প্রবল এটি নিয়ে । এসব বাংলা ভাষার সম্পদ ।
নাক সিটকানোর কিছু নেই।
অপেক্ষায় থাকবো বাংলা ভাষার এক বিশাল ভান্ডার আপনার মাধ্যমে প্রকাশের জন্য।
কাফি রশিদ
বাঙলার বৈচিত্রময় সম্পদগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কিছুদিন পর অন্তর্জালে খুঁজে দ্যাখার মতোন মানুষও পাওয়া যাবে না। 🙁
জিসান শা ইকরাম
ঠিক বলেছেন । কতজন আর ভাবেন এসব নিয়ে !!
ব্লগার সজীব
কিছুটা কঠিন লাগছে ভাই । আরো পড়তে হবে :p
কাফি রশিদ
এটা শুনেন : http://www.mediafire.com/download/qm8qg9cv584xrxz/Radhe+%28Cover%29+Prithwi+feat.+Jajabor+Rasel.mp3
আরেক মৈমনসিংহ গীতিকা মহুয়া’র অনুকরণে রাঁধা-কৃষ্ণের গান।
আদিব আদ্নান
অনেকবার শুনলাম , আমার কাছে অসাধারন লাগল ।
আমি এমন গান আরও শুনতে চাই ।
ধন্যবাদ দিলে অনেক কম বলা হবে ।
ছাইরাছ হেলাল
আপনাকে অবশ্যই ধন্যবাদ , এখানে না পেলে আমাদের এ অমূল্য সম্পদে চোখ
বোলানো হোত না । এই গীতিকাটি নিয়ে আমার একটু সামান্য আগ্রহ আছে ।
চলতে থাকুক এটি ।
কাফি রশিদ
পুরোটা লেখা শেষ, আকারে বড়ো হওয়ায় একসাথে সবটা দিচ্ছি না। আবার কয়েক পর্বে পোস্ট করলে হোমপেইজে আমার পোস্টে ভরে যাবে। তাই একটু সময় নিয়ে পোস্ট করছি। শুভ কামনা।
ছাইরাছ হেলাল
ঠিক আছে আস্তে আস্তে দিতে থাকুন ।
প্রজন্ম ৭১
ধন্যবাদ আপনাকে মৈমনসিংহ গীতিকা : চন্দ্রাবতীকে এনেছেন বলে। ভাবতে ভালো লাগে যে এই অতি আধুনিক যুগে এসব নিয়ে কেউ চর্চা করেন (y)
কাফি রশিদ
প্রাচীন সাহিত্য আর ইতিহাসে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ। শুভ কামনা।
মিসু
অসাধারন । চন্দ্রাবতি এই প্রথম পড়লাম । ভালোলেগেছে খুব । অপেক্ষায় আছি
কাফি রশিদ
ধন্যবাদ মিসু।