সকলে দৌড়ে গিয়ে দেখতে পেল মেধা সেই দেয়াল ঘড়িটা ঠিক করার জন্য আবার নামাতে গিয়েছিল। এবার সেটা হাত ফসকে গিয়ে টুকরো হয়ে গেছে।তাই সে করুন চোখমুখ করে বাবা মার দিকে তাকিয়ে আছে। এ অবস্থা দেখে বাবা কিছু না বলেই ভেতরে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার মেজো নানুরতো তা সহ্য হল না। তিনি বলে উঠলেন,
“হায়রে, বড় আপার (মেধার নিজের নানুর)সংসারের স্মৃতিচিহ্ন ছিল এ ঘড়িটা। আপা এখন চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গেছেন। এসেতো ঘড়িটা ঠিকি খুঁজবেন। কি করল ছেলেটা?”
এসব শোনে মেধার বাবার প্রচন্ড রাগ হল। তিনি ছেলেকে কতগুলো বকা দিয়ে পড়তে বসিয়ে দিলেন।ছেলে মুখভার করে পড়তে বসল। মেধার এ অবস্থা দেখে সারা ও তার মা দুজনেই কষ্ট পেলেও কিছুই করার নেই তাদের। পরদিন সকালে দুজনেই স্কুল গেল। সেখান থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে দুপুরে খাবার টেবিলে বসল। কিন্তু তাদের প্রিয় চিকেনের কোন কিছুই টেবিলে নেই। তাই আয়েস করে খেতেও পারল না। খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিতে গেল। এবার গিয়ে দেখে মা সে জায়গায় আরেকটা নতুন ঘড়ি টাঙিয়েছেন। সেটা দেখেই খুশিতে সব ভুলে গেল মেধা। কখন সে এ ঘড়িটা খুলবে সে অপেক্ষায় আছে। কি মনে করে বা কি ভেবে যে সে ঘড়ি নিয়ে এত মেতে থাকে তা বাড়ির অন্য আর কেউ জানেনা। এদিকে তার বাবা আজ সন্ধ্যের ফ্লাইটে চলে যাবেন সেনেগাল। সে দিকে তার কোন খেয়াল ই নেই। সে আছে ঐ ঘড়ি নিয়ে। যখন বাবাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে যাবে সকলে, তখন মেধা ঐ ঘড়িটাকে খুলবে। কিন্তু যদি এমন কিছু হয় আবার আগের মত, ভেঙে যায় ঘড়িটা কিংবা যদি নষ্ট হয়ে যায় তো? এত ভেবে কি হবে? যা হবার হবে? কটা বকাইতো শুনতে হবে,ওটা তার গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষা।
সন্ধ্যা হয়ে এল। বাবা বাড়ি ছেড়ে বেরুচ্ছেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।মা, সারা, মেজো নানু, রান্নার লোকেরা সকলেই অাছেন,অথচ মেধার দেখা নেই। বাবা অনেকক্ষণ ডেকে ডেকে অবশেষে আবার বাড়ির ভেতরে এলেন, এসে দেখতে পেলেন, মেধা চুপচাপ তার নিজের চেয়ারে বসে আছে। বাবা চলে যাবে তাতে তারো মন খারাপ হচ্ছে কিন্তু তা সে বাকি সকলের মত প্রকাশ করতে পারছে না। বাবা এসে তার মাথায় দুটো চুমু খেয়ে একটু আদর করে চলে গেলেন। এবার মেধা রাজত্ব পেয়ে গেল, নতুন ঘড়িটা খুলে দেখল। ওটা নিয়ে নানা গবেষণা চলল।তারপর তার মাথায় কি যেন একটা ঘুরতে লাগল। কিছু একটা চিন্তা মাথায় আসে, আবার সেটা সরে সরে যায়। সে ভাবতে গেলেই ভাবনাটা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সেটা সে একত্রিত করতে পারছে না। এভাবে এলোমেলো ভাবনারা তার মাথায় তালগোল পাকাতে লাগল। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামল। মা, সারা এবং অন্যরা সকলেই বাবাকে বিদেয় দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।রাতের বেলায় আবার সেই অপছন্দের খাবার খেয়ে ঘুমুতে হল। এজন্য মায়ের ওপর খুব জেদ হচ্ছে মেধার।কেন মা মেজো নানুর সব কথা শোনে, কেন তাদের কথা ভাবে না? মা খুব পচা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
এভাবে দিন যেতে লাগল, মায়ের ওপর রাগ আর বিতৃষ্ণা ও চরম আকার নিতে লাগল। মেধা কিছুতেই মাকে আর আগের মত ভালবাসতে পারেনা। মাও মনে মনে কষ্ট পান,কিন্তু কিছুই বলতে পারেন না। মেজো নানুর অত্যাচার দিন দিন আরো বাড়তে লাগল।বাবা থাকলে এমনটা হত না। মেধাও যেন দিন দিন আরো কেমন হয়ে যেতে লাগল। একা একা থাকে আর বিষন্নতায় ভোগে। বাড়িতে কোন অতিথি এলেই মেজো নানু মেধা ও সারাকে ডেকে আনেন আর সবার সামনে তাদের এমন পরিচয় তুলে ধরেন যা শুনে অতিথিরাও লজ্জা পান। যেমন মেধার কথা বলেন,
“এই হল মেধা।নাম মেধা হলে কি হবে, মাথার ভেতর কিচ্ছু নেই।একদম গোবর ঠাসা।একে দিয়ে হাল চাষ ও হবে না। পড়ার কোন খবর নাই, সারাদিন শুধু খায় আর খায়। আমি যে এদের বাসায় আছি, দেখে শুনে রাখছি তাই ওকে আজ ভাল দেখতে পাচ্ছেন। নইলে ময়লা গায়ে মেখে কোথায় না কোথায় বসে থাকত। আর ও হল সারা। কাজ কম্ম কিচ্ছু জানেনা। নিজের কাজ তো নিজে করতে পারেইনা, সব কাজ আমার করে দিতে হয়।এ মেয়ের যে কি ভবিষ্যত হবে কে জানে?”
এসব শোনার পর বাচ্চা দুটো অপমানে মুশড়ে পড়ে।তারপরো কিচ্ছু বলতে পারেনা। মনে মনে কুকড়ে যায়। এসব সহ্য করতে করতে দিন দিন তারা মানষিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কোন কিছুতে মন নেই, শুধু মনমরা হয়ে বসে থাকে।ওদেরকে দেখে খুব মায়া হয় রান্নার বুয়াদের।কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারেনা। আরেকদিন হল কি, মা কোলের কাছে বসিয়ে মেধা ও সারাকে খুব আদর করছেন। যথারীতি মেজো নানুর আগমন, তিনি এসে বললেন,
“বাচ্চা দুটোকে কেন এত আদর করছ, করোনা। মনে রেখ,মেয়েকে একদিন বিয়ে দিতে হবে। আর ছেলে, বউ এলে সেও পর হয়ে যাবে।”
বাচ্চাদের সাথে মা একান্তে যেটুকু সময় কাটান, যেভাবে তাদের আদর করেন, অন্যকারো সামনে তা সম্ভব হয় না। তাই মা তাদের কাছ থেকে উঠে গেলেন। ফলে মায়ের প্রতি মেধার আক্রোশ আরো তীব্র হল।কিন্তু সারা ঠিকই বুঝল যে এটা মেজো নানুর জন্য হয়েছে। মায়ের কিছুই করার নেই। কিন্তু সবারতো আর বোঝার ক্ষমতা সমান হয় না।
মিসেস শবনম ড্রাইভারকে বাজারে পাঠালেন।তিনি বাজারের লিস্ট আর এক হাজার টাকার নোট দিলেন ড্রাইভারের হাতে। তখন আবার সেই ঘষেটি বেগম এসে উপস্থিত।
“করছ কি? এত টাকা দিচ্ছ কেন? বাজার করতে তো এত টাকা লাগে না। আমাকে দাও, আমি করে আনছি।”
এই বলে ঠিকই হাজার টাকার নোট হাতে নিলেন। এবার বাজারে গিয়ে ড্রাইভারকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে তিনি একাই গেলেন বাজারে। তারপর সব তাজা জিনিস রেখে বাজে পোকাপড়া সবজি আর পচা মাছ কিনে আনলেন স্বস্তায়। এতদিন যাও রান্না মুখে তোলা যেত, চিকেন ছাড়াও তারা অল্প স্বল্প কিছু খেতে পারত, আজ থেকে আর তাও হবে না। বাচ্চাগুলোর করুন দশা দেখে যে কারো চোখে পানি আসবে।বাড়ি ফেরার পর মেধার নিজের নানু ফোন দিলেন। দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরল তার মেজো নানু। তারপর ফোনে যা বলল, তা অনেকটা কমেডির মত শোনাল,
“হ্যাঁ, অাপা, আমরা সবাই ভাল আছি। আরে আমিইতো ওদের দেখে শুনে রাখছি। নাহলে যে এদের কি অবস্থা হত।”
রাত এগারোটা। কেউ আজ কোন খাবার মুখেই তুলতে পারেনি। তাই মা সবার জন্য হরলিক্স বানিয়ে আনলেন। হরলিক্স আর বিস্কুট খেয়ে তারা ঘুমোতে গেল। কিছুতেই ঘুম আসছে না মেধার। খালি এপাশ ওপাশ করছে। হঠাৎ মনে পরল ক্লাসের মিলি ম্যামের কথা। মেধা ভাবতে লাগল
“ম্যাম বলেছিলেন কি যেন একটা মেশিন….টাইম মেশিনের কথা। সেটা দিয়ে জানা যায় প্রাচীন কালে কি ঘটেছিল,ভবিষ্যতে কি ঘটবে ইত্যাদি। আচ্ছা এমন একটা যন্ত্র থাকলে কেমন হত,যেটা সাধারন ঘড়ির কাজ করবে, আবার তাতে যে কোন স্থানের সময় ও মানচিত্র তুলে দিলে দেখাতে পারে সে সময়ে সে স্থানে কি ঘটেছিল বা ঘটছে কিংবা ঘটবে?
চলবে……
১১টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
এমন বোকা মায়ের উপর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কি দরকার এমন আত্নীয় প্রশ্রয় দেওয়ার। মেধা ও সারার জন্য এখন সত্যি খারাপ লাগছে। রাগ হচ্ছে আমারো মেধার মায়ের উপর।
মেধা টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলবে নাকি!
নীরা সাদীয়া
কিছু সহজ সরল মানুষ আজো আছেন, মেধার মায়ের মত। দেখা যাক,মেধা কি আবিষ্কার করে। শুভকামনা জানবেন আপি।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার সামনে যদি এই টাইপ পাবলিক আসতো, তাহলে বুঝতো “কতো ধানে কতো চাল!”
মেধার মায়ের উপর আজকের পর্বে বেশী মেজাজ গরম হচ্ছে। :@
নীরা সাদীয়া
স্বচক্ষে দেখলে আরো রেগে যেতেন আপনি। যা হোক, অনেক শুভকামনা রইল। খুব ভাল থাকুন আপি।
মোঃ মজিবর রহমান
“ম্যাম বলেছিলেন কি যেন একটা মেশিন….টাইম মেশিনের কথা। সেটা দিয়ে জানা যায় প্রাচীন কালে কি ঘটেছিল,ভবিষ্যতে কি ঘটবে ইত্যাদি। আচ্ছা এমন একটা যন্ত্র থাকলে কেমন হত,যেটা সাধারন ঘড়ির কাজ করবে, আবার তাতে যে কোন স্থানের সময় ও মানচিত্র তুলে দিলে দেখাতে পারে সে সময়ে সে স্থানে কি ঘটেছিল বা ঘটছে কিংবা ঘটবে?
এই জানার আগ্রহ মেধাকে বড় ক্রবে ইনশা আল্লাহ
নীরা সাদীয়া
দেখা যাক কি ঘটে। আরো জানা যাবে নতুন পর্বে। পাশেই থাকবেন আশা করি। শুভরাত্রি।
মোঃ মজিবর রহমান
সংগে আছি তো আপু।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ। নতুন পর্বগুলোতে আমন্ত্রণ রইল।
অলিভার
গল্পের মোড় কি রহস্যের দুনিয়ায় পদার্পণ করতে করতে যাচ্ছে?
দেখা যাক আগামী পর্বে নতুন কি চমক আসে..
অপেক্ষায় রইলাম 🙂
নীরা সাদীয়া
দেখা য্ক কি ঘটে। ধন্যবাদ। নতুন পর্বেও পাশেই পাবব, সে প্রত্যাশা রইর। শুভরাত্রি।
নীরা সাদীয়া
নতুন পর্বে আমন্ত্রণ রইল। শেষপর্বে পাশেই থাকবেন আশা করি।