আমার ছোটবেলার রমজান ছিল ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করা পেট নিয়ে নামাজ আদায় ও কোরআন তিলাওয়াত করা। বিকেল থেকেই ঘড়ি দেখা। আম্মার হাতে বানানো ইফতার প্লেটে প্লেটে সাজানো। সবশেষে ডাইনিং টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে বাবা-মা আর আমরা তিন ভাইবোন আজানের জন্য অপেক্ষায় থাকা। কাগজি লেবুর শরবত, চিড়ার শরবত, পেঁয়াজি, ছোলা বুট, মুড়ি আর খেজুর। পরিমিত খাবার। শেষ কণাটুকু শেষ না হওয়া অবধি তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া। এখনকার মতো এত মুখরোচক আইটেম ছিল না। তবুও একটা সুখ সুখ অনুভূতি ছিল। জীবনটা সুন্দর ছিল।
কয়েক দিন আগে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে এক ইফতারের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। পার্টিহল আমন্ত্রিত অতিথিদের পদচারণায় মুখর। রকমারি খাবারে ইফতার বক্স সাজানো হয়েছিল। আইটেম ছিল পনেরোটির বেশি। ২০ শতাংশ খাবার খেয়েছে সকলে। বাকিটুকু পড়ে ছিল। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা খাবারগুলো বড় গারবেজ ব্যাগে ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া আর কীই–বা করার ছিল? এ দেশে তো আর ক্ষুধার্ত নেই যে তাঁদের দেবে!
আমার সে সময় কোরীয় নাগরিক কিম’কে খুব মনে পড়ছিল। এ দেশে আসার পর শুরুর দিকে আমি যে জাপানি ফুড করপোরেশনে চাকরি করতাম, সেখানে কিম ছিলেন আমারই সহকর্মী। সেখানে রাইস দিয়ে জাপানি খাবার সুসি বানানো হতো এবং তা স্টোরগুলোতে বিক্রির জন্য পাঠানো হতো। প্রায়ই অর্ডারের তুলনায় বেশি খাবার তৈরি করা হতো এবং দিন শেষে বাড়তি খাবার গারবেজে ফেলে দেওয়া হতো।
একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে আমরা সকলেই যখন বিষয়টি এড়িয়ে যেতাম, তখন কিম খুব রাগান্বিত কণ্ঠে বলতেন, সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ খাদ্যাভাবে না খেয়ে থাকছে, অপুষ্টিতে ভুগছে। অথচ তোমরা প্রতিদিনই খাবার ফেলে দিচ্ছ! কথাগুলো বলার সময় রাগে, ক্ষোভে তাঁর মুখাবয়ব লালচে হয়ে উঠত। শরীর কাঁপত। আমার ভেতরের না বলা কথাগুলো আমারই সহকর্মীকে এমনভাবে বলতে শুনে শ্রদ্ধা জাগত।
কিম হয়তো অনেক উঁচু মনের মানুষ। তাই প্রতিদিন এত এত খাবার ফেলে দেওয়ার বিষয়টি তাঁকে নাড়া দিয়ে যেত। তাঁকে ভাবাত সারা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের কথা। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, আমি তেমন করে ভাবতাম না। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজ দেশের ক্ষুধার্ত মুখগুলো ভেসে উঠত চোখের সামনে। শুধু তাঁদের কথাই ভাবতাম। আমার গরিব ছোট্ট একটি দেশ, বাংলাদেশ। সকল ভালোতে কিংবা মন্দতে প্রতিনিয়ত সেই দেশটির মানুষদের কথাই মনে পড়ে। আমার ধারণা, যারা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে দূরদেশে অবস্থান করছেন, তাঁদের সকলেই মনের কোণে এমন অনুভূতি নিয়ে বেঁচে আছেন এবং নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
সংযম হোক সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য।
সংযম হোক না খেতে পাওয়া মানুষদের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভবের জন্য।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
১২টি মন্তব্য
ইঞ্জা
কিমকে স্যালুট
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
শুভকামনা আপু
জিসান শা ইকরাম
কিমে এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
আর তোমাকেও ধন্যবাদ জানাই এমন একটি পোস্টের জন্য।
আমার ছোটবেলার ইফতারীওভতোমার মতই ছিল।
আমরা সবকিছুতে যেন সং্যমি হই।
রোজা রেখে আমরা যেন অনুভব করতে পারি গরীবদের না খেতে পারার কস্টকে।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছ দাদা ভাই। রিপ্লাই দিতে দেরী হল বলে দূঃখিত ।
জিসান শা ইকরাম
তুমি বিজি থাকো, বুঝি। দেরী হতেই পারে।
মৌনতা রিতু
বৈষম্যের পৃথিবীতে আমাদের বসবাস। কেউ খাবার ফেলে, কেউ খেতে পারে না।
রিমি রুম্মান
এমন করেই চলছে, চলবে পৃথিবী এবং তার মানুষেরা …
তৌহিদ ইসলাম
ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি পোস্টের জন্য। সংযম পালন করে কি লাভ যদিনা তা অসহায়, দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষের কথা মনে করিয়ে না দেয়। ধন্যবাদ কিম কে।
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন। আপনার জন্যে শুভকামনা।
খসড়া
কিম কে শ্রদ্ধা
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন। শুভকামনা।