বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ যাবত। অনেক বাস আসা যাওয়া করছে কিন্তু আমার রুটের কোনও বাসের দেখা মিলছে না। বাসের আশায় ডানদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে বেশ বিরক্ত লাগছে। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুড়িয়ে ঘাড়টিকে একটু সোজা করে নিই। এদিকে আকাশ বেশ মেঘলা। যেকোনো মুহূর্তেই বৃষ্টি আসতে পারে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। আমি আশেপাশে তাকালাম। নাহ বসার মত কোনও কিছু দেখা যাচ্ছে না। দুচারটি দোকান যা আছে তা আমার থেকে খানিকটা দূরে। প্যান্টের বাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলটি বের করে সময় দেখলাম। প্রায় কুঁড়ি মিনিট হয়ে গেছে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তায় কোনও গণ্ডগোল হয়েছে কিনা কে জানে। আমার মত এমন অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের রুট আলাদা হওয়াতে তারা যে যার মত চলে গেছে। এমুহূর্তে আমিই এক মাত্র প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছি। আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘগুলো কিছুটা কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে। বৃষ্টি প্রায় চলেই এলো বলে। ডান দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে দেখছি। এতক্ষণ ছিল না। মাত্রই এলো বোধহয়। লোকটার সাথে বেশ বড় সাইজের একটি ব্যাগ। পরনে পাঞ্জাবী-পায়জামা। মাথায় টুপি নেই। চুলগুলো পাতলা। খানিকটা টাক পরেছে মাথায়। মুখমণ্ডলে কাঁচাপাকা দাঁড়ি গোঁফ। পান চিবাচ্ছেন আর একটু পরপর পিচ করে পানের পিক ফেলছেন। পান চিবানোতে তার দাঁড়ি সহ থুতনি উঠানামা করছে। দেখে মনে হচ্ছে দাঁড়িগুলো যেন দোল খাচ্ছে। আমার রুটের যাত্রী হবে হয়তো। লোকটির বয়স অনুমান করার চেষ্টা করলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলালাম। বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন হবে হয়তো। ধীরেধীরে লোকটির দিকে এগিয়ে গেলাম।
-‘আংকেল যাবেন কোথায়?’
-‘পলাশপুর যাব’।
মনে হল বেশ বিরক্তি নিয়েই উত্তর দিল লোকটা। আমার দিকে ঘুরে ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল। কুঁড়ি মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি বিরক্ত হবার কথা আমার। আর উনি আসতে না আসতেই বিরক্ত কেন বুঝলাম না। লোকটিকে আরও একটু বিরক্ত করতে মন চাইছে। কিছু একটা নিয়ে সময় কাটানো দরকার।
-‘আংকেল আমিও পলাশপুর যাব। বিশ মিনিট ধইরা দাঁড়াইয়া আছি, বাস নাই। রাস্তায় কোনও গ্যাঞ্জাম হইছে নাকি? একটু খবর নিয়ে দেখেন তো কি অবস্থা।’
লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে নিলেন। আমার প্রশ্নটি মনেহয় উনি পছন্দ করেননি। আমিও ঘাড় ঘুড়িয়ে বাস আগমনের দিকে দৃষ্টি দিলাম। দূর থেকে দেখলাম একটা বাস আসছে। বাসের সামনের প্রান্তে কাঁচের উপর লেখা গন্তব্য স্থলটি পড়ার চেষ্টা করছি। পলাশপুর যাবার বাস এটা। আমি বাম হাত বাড়িয়ে সংকেত দিলাম। লোকটিও হাত বাড়াল। বাস এসে থামল আমাদের সামনে। বাস ভর্তি প্যাসেঞ্জার। দাঁড়িয়ে যেতে হবে। অগত্যা কোনও উপায়ন্তর না পেয়ে বাসে উঠলাম। লোকটিও উঠতে যাবে এমন সময় কন্ডাক্টর লোকটিকে নেবার অপারগতা প্রকাশ করলো। লোকটির সাথে এই বড় ব্যাগটির জন্য কন্ডাক্টর তাঁকে উঠতে দেবে না। বাসটি চলা শুরু করলো। দেখলাম লোকটি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি রড ধরে দাঁড়িয়ে আছি বাসের দরজার কাছেই। আমার মুখ বাসের সামনের দিকে। মহিলা সংরক্ষিত ৪টি আসনও আমার সামনের দিকে। চারজন বসে আছে। চারজনই মধ্য বয়স্কা আর একজনের বয়স উনিশ-কুঁড়ি হবে। সাজুগুজু করা মেয়েটি বাসের সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আশেপাশে তাকালাম। দেখলাম দুচারজন পুরুষ একটু পরপর মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না দিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ইতোমধ্যে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। যারযার সীটের পাশের জানালাগুলো লাগানো হচ্ছে। বাস চলছে ধীরে ধীরে। এবার আমি ভাবছি লোকটির কথা। লোকটি বিরক্ত হবার কারণগুলো বের করার চেষ্টা করছি।
-‘আংকেল একটু চাপেন। সামনের স্টপেজে নাইমা যামু’।
আমি কিঞ্চিৎ বিরক্ত আর বিস্মিত ভাব নিয়ে একটু চেপে দাঁড়ালাম। প্যাসেঞ্জারটি আমাকে অতিক্রম করে বাসের দরজার সামনে দাঁড়ালো। কন্ডাক্টরকে বাস থামাতে বলল। আমি তাকালাম তার দিকে। বিশ-একুশ বছরের তরুণ হবে। বৃষ্টি ততোক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটি নেমে গেল। আমি আমার জায়গায় রইলাম। বাস আবারও চলা শুরু করে দিয়েছে। আমাকে আংকেল বলার হেতু বের করার চেষ্টা করছি এবার। ছেলেটির বয়স যদি কুঁড়ি-একুশ হয় তবে আমার চাইতে চৌদ্দ-পনের বছরের ছোটই হবে। এই বয়সে আংকেল শুনাটা কেমন যেন লাগে। বড়ই বেমানান মনে হয়। যদিও মাথার কিছু কিছু চুল পেকে গিয়েছে। তবে এখন বেশ বিরক্ত লাগছে ছেলেটির উপর। আংকেল না বলে কি ভাই বলা যেত না আমাকে! লোকটির কথা মনে পরে গেল আবারও। আচ্ছা ঐ লোকটিও কি আংকেল বলাতে বিরক্ত হয়েছিল, আচ্ছা লোকটির ভ্রু গুলোও কি দাঁড়ির মত কাঁচাপাকা! বাস এগিয়ে যাচ্ছে আর আমি মনে মনে লোকটির ভাবছি……
১৩টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আঙ্কেল শুনতে কারোই ভাল লাগে না,
কিন্তু আঙ্কেল আমাদের সবার জন্য অপেক্ষা করছে কাছে দাঁড়িয়ে।
রুমন আশরাফ
তাইতো দেখছি।
নিতাই বাবু
কথা হলো গিয়া, রাস্তায় চলাফেরা করনের সুম যে যাকে যেভাবেই সম্বোধন করতে পারে। এতো ভাবনা চিন্তার দরকার কি? কেউ তো আর ঘনিষ্ঠ আপনজন নয়! পথ চলার মাঝে পথচারী। বলুক, চাচা আর ভাই; আর নাহয় জেঠা।
গন্তব্যে পৌঁছানোর গল্প কিন্তু খুবই ভালো লেগেছে দাদা।
রুমন আশরাফ
হা হা হা ধন্যবাদ দাদা।
আরজু মুক্তা
ভালোই লাগলো
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ মুক্তা আপু।
জিসান শা ইকরাম
আংকেল শুনেই লোকটা বিরক্ত হয়েছে নিশ্চিত,
আমার এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে আংকেল ডাকে 🙂
রুমন আশরাফ
আমারও অভ্যাস করতে হবে আংকেল ডাক শুনতে। হা হা হা।
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ সুপর্ণা দিদি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া ভালো লাগলো
রুমন আশরাফ
ধন্যবাদ সুপর্ণা দিদি।
এস.জেড বাবু
বলতে দেন যে যা বলে, বলার মানুষটা খুশি হউক।
কেউ নিজের ভাই বানায় আর কেউ বানায় পূর্ব প্রজন্মের ভাই।
শুভেচ্ছা রইলো
রুমন আশরাফ
আপনাকেও শুভেছা।