নিউইয়র্কে আজ চমৎকার ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল একটি দিন ছিল। আমার ছয় বছরের রিহানকে নিয়ে এ বছর আজই প্রথম পার্কে যাওয়া। অন্য বাচ্চাদের সাথে সে খেলছে, দৌড়াচ্ছে। অল্প দূরত্বে থেকে খেয়াল রাখছিলাম। হঠাৎ রিহানের ডাক। আশ্চর্য হবার ভঙ্গিতে বলে উঠে, আম্মু, দেখো দেখো ! আমি ফিরে চাই। বিশেষ ভাবে তৈরি এক ধরনের হুইল চেয়ারে বসা একজন মানুষ। আমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে আবারো তাকাই। মুখমণ্ডল, হাসি ২৬/২৭ বছরের পরিনত এক যুবক যেন। হাত, পা এবং শরীর ৭/৮ মাসের এক শিশুর মতন ! নড়বড়ে ঘাড় ডানে, বাঁয়ে হেলে যাচ্ছিলো। সুইচ টিপে বিশেষ চেয়ারটি নিজেই অপারেট করে এদিক সেদিক যাচ্ছে। সাথে এক যুবক, যে তাঁকে সতর্কতার সাথে কোলে নিয়ে দোলনায় বসিয়ে দিচ্ছিল, দোলাচ্ছিল। যদি ভিন্নরকম এই মানুষটি শিশু হয়ে থাকে, তবে সাথের যুবকটি তাঁর বাবা হবে, হয়তো। কিংবা অন্য কেউ, যারা পৃথিবীতে ভালোবাসা দিয়ে এমন মানুষদের আনন্দে বাঁচিয়ে রাখবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। পার্কের অন্য বাচ্চারা, মায়েরা আড় চোখে দেখছে, ভয়ে একটু দূরে সরে যাচ্ছে। আচমকা এমন একজন মানুষকে দেখে ভীত আমিও একটু দূরে সরে যাচ্ছিলাম।
খুব অপরাধী হয়ে বলি___
বলতে দ্বিধা নেই, এদিক ওদিক ছুটোছুটি করা রিহানকে বারবার ডেকে কাছে কাছে রাখি। আগলে রাখি। যেন মানুষটি ছোঁয়াচে কিছু ! বেশিক্ষণ সেখানে ভাল লাগছিলো না। পাশেই শপিং মলের ফুডকোর্টে গিয়ে রিহানকে পছন্দের খাবার খাওয়াই। কিন্তু আমি কিছুই খেতে পারলাম না। বাড়ি ফিরে নামাজ শেষে যতবার মোনাজাতে হাত তুলেছি, ততবারই মানুষটির মুখটি ভেসে উঠে। ভেসে উঠে নিরব প্রার্থনায়।
শিশির ভেজা ঘাসের মাঠে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া, কিংবা সবুজ খোলা মাঠে উদ্দাম দৌড়ের আনন্দ সবার ভাগ্যে জুটে না !
আমি এবং আমার আশেপাশের অসংখ্য সুস্থ মানুষের বেঁচে থাকাটা যে কত অসাধারন প্রাপ্তি, আজ আবারও অনুভব করলাম। তবুও, সুস্থ দেহে বেঁচে থাকা আমরা কারনে অকারনে কত তুচ্ছ বিষয় নিয়েই না হানাহানি করি !
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৪টি মন্তব্য
লীলাবতী
আপু, একদম সরল স্বীকারোক্তি, অকপটে বললেন যে আপনিও ভীত হয়ে একটু দূরে সরে যাচ্ছিলেন। আমরা নিজেদেরকে হিরো/হিরোইন হিসেবে দেখানোর জন্য কত মিথ্যে বলি। অনেক মানুষ আছেন, যারা নিজেদেরকে সেরা প্রমাণিত করার জন্য বলবেন ‘ সবাই দূরে সরে গেলেও আমি তার কাছে যাই, কুশল বিনিময় করি’।
আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা সুস্থ্য হয়ে বেঁচে আছি। এভাবে বেঁচে থাকায় সৃষ্টি কর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
আপনাকে ধন্যবাদ আপু।
ইকবাল কবীর
আপনার সাথে আমি একমত পোষন করছি লীলা আপু। আমরা অনেকেই শো-অফ এত বেশী করি যে নিজেকে নিজেই চিনতে ভূল করি।
লীলাবতী
ধন্যবাদ কবীর ভাইয়া। মিথ্যে দিয়ে নিজেকে জাহির করি আমরা।
রিমি রুম্মান
লীলা’পু, পৃথিবীর আলো বাতাসে সুস্থ দেহে মুক্ত বিহঙ্গের মত অবাধে ঘুরে বেড়ানো __ এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। তবুও যেন আমাদের চাওয়ার শেষ নেই। কোন কিছুতেই তৃপ্ত নই আমরা।
ইকবাল কবীর ভাই, মানুষটিকে দেখে ভয় পেয়েছি, দূরে সরে থেকেছি নিজের অজান্তেই। কিন্তু প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে মোনাজাতেও সেই নিজের অজান্তেই নীরবে প্রার্থনা করেছি।
ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।
ইকবাল কবীর
অনেক বাস্তব কথা লিখেছেন আপনি। আমরা সব সময় মনে করি আমরা খুব খারাপ অবস্থানে আছি, আসলেই কি তাই?? আমাদের চার পাশে অনেক মানুষ আছে যারা জন্মান্ধ, হাত নেই, পা নেই আরো অনেক কিছু তাদের দিকে তাকিয়ে আমরা কখনো শোকরিয়া আদায় করি না যে আমরা কত ভাল আছি।
রিমি রুম্মান
আমরা আমাদের চেয়ে যে ভাল অবস্থানে আছে তাঁর সাথে নিজেকে তুলনা করি। কিন্তু আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থানে যে আছে, তাঁর সাথে তুলনা করলে জীবন, পৃথিবী অনেক সুন্দর হতো। মানুষ হতো সমস্ত লোভ-লালসার বাইরে। তবে প্রতিনিয়ত আমি স্মরণ করি__ সুস্থ দেহে বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর এবং মূল্যবান আর কিছু নেই।
ভাল থাকুন সবসময়।
ইনজা
সরল স্বীকারোক্তি দেখে আপনার মনটাকে আরও জানতে পারলাম আসলে আমরা নিজেরাই এতো স্টান্টবাজী করি যেখানে ভয় পেয়েছি এই কথায় বললে যেন আমাদের জাত যাবে।
অটিষ্টিক ব্যাক্তি বা মানুষ দেখলেই যেন নিজেরাই একটু অন্যরকম হয়ে যায় কিন্তু তারাও যে মানুষ তা আমাদের খেয়াল থাকেনা আর আমাদের উচিত নিজেদের শুধরিয়ে এদের কাছাকাছি যাওয়া, ওদেরকে হেল্প করা যেন তারাও বুঝতে পারে তারাও মানুষ আর মানুষের পাশে মানুষ থাকবে এই তো সাভাবিক, নয় কি?
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। তবে কিছু মহান মানুষ সবসময়ই এমন মানুষদের আগলে রাখে।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। শুভকামনা রইল।
দীপংকর চন্দ
বোধের প্রতি শ্রদ্ধা।
প্রার্থণা করি, বোধগুলো আমাদের যাপিত জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনুক।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
শুভকামনা রইল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সুস্থভাবে বেঁচে থাকা বা পূর্ণাঙ্গ নিয়ে জন্মানো আসলেই ঈশ্বরের দান। অথচ একথাটা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন আপু। আশেপাশের এমন কিছু অসম্পূর্ণ মানুষ আমাদের বোধকে নাড়া দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত।
ব্লগার সজীব
আপনি সচরাচর যেভাবে লেখেন, এই লেখাটিকে একটু আলাদা হিসেবেই গন্য করছি আপু। একদিনে নিজের অপরাগতা অন্যদিকে বিবেক বোধ দুটোও এসেছে এই লেখায়। আমরা তো আত্মোপলব্ধিকে ভুলেই গিয়েছি। আমরা ভালো আছি এটিই আমাদের কাছে আল্লাহ্র সেরা নেয়ামত।
রিমি রুম্মান
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। তবুও আমরা ভুলে যাই। অযথাই হানাহানি করি। একে অন্যের মনঃকষ্টের কারন হই।
ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন। শুভকামনা।
ইলিয়াস মাসুদ
কি বলব জানি না, তবে লিখাটা পড়ে নিজেকে সুধরে নিতে ইচ্ছে করছে………. অনেক অনেক ভাল থাকুন আপু
রিমি রুম্মান
এভাবেই চারিপাশের ঘটনাগুলো আমাদের বোধকে নাড়া দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। এভাবেই আমরা সংশোধন হই।
ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।
খসড়া
সত্য বলার সৎসাহস একটি বড় গুন। আমরা প্রতিবন্ধীদের থেকে দূরে থাকতে চাই। অস্পৃশ্য যেন তারা। সে নারী কিংবা পুরুষ রা তৃতীয় লিঙ্গ। আমার নিজের ভাইয়ের পাশেই আর বসা হয় না। দু’টি কথা বলা হয় না। কোথাও বেড়াতে যাবার সময় মনে মনে আশা করি ও যেন বলে না যাব না।
জিসান শা ইকরাম
সুস্থ্য হয়ে বেঁচে আছি, এটি অনেক বড় প্রাপ্তি আমাদের
আমরা এই প্রাপ্তিকে ভুলে গিয়ে হানাহানিতে মেতে উঠি, অসুস্থ্য বানাই অন্যদের।
ভালো থাকুন সুস্থ্য থাকুন প্রিয় মানুষ, আন্তরিকভাবে এই দোয়া করি।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার এমন একজন ক্লায়েন্ট ছিলো। হুম ‘ছিলো’তে চলে গেছে। কি অসহায় জীবন। হুম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম, তারপর এমন অসহায় মানুষটির জন্যে প্রার্থনা করেছি চলে যাক। এভাবে নি:শ্বাস নেয়া বড়ো যন্ত্রণার। একজন ক্লায়েন্ট চলে যাওয়া মানে পে-চেক কমে যাওয়া, তাও প্রার্থনা করেছি।
আপু তোমার লেখায় কতো কিছু যে মনে এসে যায়। আমাদের পেশায় ডিটেইলস বলা বারণ। তাই লিখতে পারিনা, ইচ্ছে করে জানাতে সকলকে কতো রোগীর মুখোমুখি হতে হয়।
ভালো থেকো আপু।
মেহেরী তাজ
সুস্থ জীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ।
আপনার এই লেখা টায় একটু অন্য রকম কি যেনো আছে,যা ঠিক আপনার মত নয়…..
স্বপ্ন
আপু এমন মানুষদের দেখলে আমিও ভয় পাই। আল্লাহ্ জীবন যখন এনাদের দিলেন, এভাবে কেন দিলেন? মন খারাপ হয়ে যায়। সুস্থ্য হয়ে বেঁচে আছি এটিই জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি।
অনিকেত নন্দিনী
“শিশির ভেজা ঘাসের মাঠে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া, কিংবা সবুজ খোলা মাঠে উদ্দাম দৌড়ের আনন্দ সবার ভাগ্যে জুটে না!” এইটা উপলব্ধি করতে পারাটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। এভাবে সবাই ভাবলে আর প্রার্থনায় দুর্বলদের রাখলে দুনিয়া বদলে যেতো গো আপু।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সাবধানের মাইর নেই তবে প্রতিনিয়ত এ দুনিয়ায় মনে দাগ কাটে এমন সব ঘটনা ফের মনে না আসাই শ্রেয়।ভাবতে হবে এটা কোন এক মুভির দৃশ্য ছিল।
রিহানকে নিয়ে সবাই ভাল থাকবেন এই কামনা। -{@
মৌনতা রিতু
সহজ সরল স্বীকারোক্তি। কখনো কখনো আমরা এই অপরাধগুলো করে নিজেই ভাবি কেন এমন কোরলাম? আমার সাথেও হয়েছে একবার এমন।
সেই অপরাধবোধে কয়েকদিন ঘুমাতে পারিনি।