৫.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি মেলায়… বিভিন্ন যায়গা থেকে দলবেঁধে- একা একা অথবা জোড় বেঁধে সুন্দরের প্রতি চিরন্তন আকর্ষনে সবাই এসেছে। সব বয়সের নারী-পুরুষ- শিশু রয়েছে। এ যেন রঙিন প্রজাপতির হাটে রঙের মেলা বসেছে! কত রঙিন পোষাকে দর্শনার্থীদেরকে দেখা যাচ্ছে।এদের মাঝে আমাদের সেই পাগল-পাগলি, রুনা এবং শিহাবও রয়েছে।
তবে আজ একা ওরা।
আলাদা আলাদা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গত পরশুদিন শিহাব মধ্যরাতে রুনার বাসার সামনে এসে রুনাকে দেখে যাবার পর আজ এই প্রথম ওরা বাইরে বের হল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান জহির রায়হান মিলনায়তনে এই এখুনি শুরু হতে যাচ্ছে। তুহিন স্যার, মুকিত মজুমদার বাবু এবং মাননীয় ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সহ প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়্যারম্যান স্টেজে চলে এসেছেন। বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের সুত্রপাত হল। এখন ওনারা বক্তব্য রাখছেন।
অডিটোরিয়ামের সিঁড়ির সামনেই দর্শকদের আসন। সেখানে বসে বসেই রুনা তুহিন স্যারের সূচনা বক্তব্য শুনছে… চোখ সামনের দিকে কিন্তু মন একজনকে খুঁজে ফিরছে। বেশ কয়েকবার ডাইনে-বায়ে তাকিয়েছে… সে আছে কিনা দেখছে। কিন্তু তাঁর চোখ শিহাবের সেই পরিচিত-ভালোলাগা অবয়বকে পায়নি।
রুনার চোখ যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে একেবারে রুনার পিছনে। বেশ পিছনে। তবে শিহাবের ওখান থেকে শুধু রুনার কাঁধ ও মাথা দেখা যাচ্ছে। ওর চুলের সাথে অবহেলায় পড়ে থাকা বেলী ফুলকে সে এখান থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রুনা যে কয়েকবার এদিক সেদিক তাকিয়েছে, সেটা ও দেখেছে। প্রথমে মজা লাগলেও পরক্ষণেই বিষন্নতায় ছেয়ে যায় শিহাবের মন। ওর বন্ধু ওকে খুঁজে পাচ্ছে না… কি অসহায় লাগছে রুনাকে এখন!
নিজের চিন্তায় নিজেই চমকে যায় শিহাব।
বন্ধু?!
আসলেই কি সে বন্ধু ভেবেছে রুনাকে?
এইমাত্র?
দশ দিককে স্তব্ধ করে দিয়ে হৃদয় ও ব্রেইনকে প্যারালাইজড করা এক অনুভুতিতে আচ্ছন্ন শিহাব পায়ে পায়ে সামনের দিকে আগায়। কয়েকজনের সাথে অভদ্রজনিত ধাক্কায় তাঁদের ভ্রুকুটিকে নিজের অজান্তেই উপেক্ষা করে একসময় রুনার কাছে যেতে পারে।
এখন রুনা একবার পিছনে ফিরলেই ওকে দেখতে পাবে। কিন্তু শিহাব সব সময় দেখে এসেছে, জীবনে তোমার যখন অন্তত একবার পিছনে ফিরে দেখা প্রয়োজন- ঠিক সেই সময়টাতে আর ফেরা হয় না। রুনাকে কি সে ডাকবে?
নাকি অপেক্ষা করবে? কখন সে ওকে দেখে। প্রয়োজনে শিহাব এক যুগ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে।
কতক্ষণ ওভাবে ছিল শিহাব নিজেও বলতে পারবে না। তবে পরিচিত কন্ঠের আওয়াজে সে অনেক দূর থেকে কাছে চলে আসে… দেখে সাময়িকভাবে অনেক দূরে চলে যাওয়া সেই প্রিয় মুখ একেবারে ওর কাছে… তাঁর শরীর ভেদ করে হৃদয়ের কোনো এক গভীর থেকে মনকে মাতাল করে দেয়া ভালবাসার পারফিউম ওকে ক্লোরোফর্মের মত সাময়িক বিবশ করে দিতে চায়। চোখে চোখে নীরবে কথা না বলেই সমঝোতা হয়ে গেলো।সঠিক সময়ে দু’জনেই পিছনে ফিরতে পেরেছে। রুনা তাঁর আসন থেকে উঠে শিহাবের পিছু নেয়… দুই পাশে গাছ নিয়ে কালো পীচ ঢালা একটি নির্জন রাস্তা ধরে রুনা-শিহাব হাঁটতে থাকে।
পাশাপাশি থেকেও বেশ খানিকটা ব্যবধানে হাঁটছে ওরা। নীরবে একে অপরের হৃদয়ের ভালোলাগার উত্তাপটুকু অনুভব করছে। এলোমেলো বাতাসে রুনার অবাধ্য চুলগুলো উড়ছে… সেগুলোর সাথে ওর মনটাও কি? একসময় রুনা বলে-
– জানো, এরকম পরিবেশে ‘ওর’ সাথে সেই সময়গুলোতে ওর হাত ধরে হাঁটতে খুব ইচ্ছে করত। কিন্তু সে আমার হাতের থেকে আমার শরীরের বিশেষ যায়গাগুলো স্পর্শ করতে পছন্দ করত।
‘ বাদ দাও তো… যে চলে গেছে লেট হিম গো… গো ফরএভার’
– আরে শোনই না। আমি যখনই তাকে বলেছি, তোমার হাতটা একটু ধরি… চল একটু হাঁটি… সে কি বলত জানো?
‘ কি বলতো?’
– তুমি একটি গেঁয়ো মেয়ে, এই যুগে এখনও হাত ধরাধরি… রাবিশ… আমি নীরবে চোখের জল লুকানোর জন্য ওর সেই অপমান হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্ত বিশ্বাস কর, আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে যেতো। কতবার যে সেটি ছিন্নভিন্ন হয়েছে! তোমায় যদি দেখাতে পারতাম!
‘ তুমি আমার হাত ধরবে?
শিহাবের বাড়িয়ে দেয়া হাতকে দেখে রুনা… ওর চোখের পানে তাকায়। সেখানে নীরবে কিছু একটা খোঁজে… নিজের মনের ভিতরেও একটু ঘুরে আসে। শিহাব হাসে, বলে-
‘ভয় নেই, এটা প্রেমিকের হাত নয়!’
– তবে কার হাত?
‘ বন্ধুর হাত!’
– বন্ধু? হতে পেরেছ?
‘ হ্যা!
– আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? এই হাত মুহুর্তে লোভীর হাতে পরিণত হবে নাতো?
‘ না… একবার বন্ধু হতে পেরেছি যখন… মনে হয় না আর পিছে ফিরতে পারব।
রুনা পরম নির্ভরতায় শিহাবের হাত ধরে… দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার হাত একজন বন্ধুর হাতে পরিণত হয়। একটা লম্বা সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথ ধরে জীবনের বাঁকা পথের পথিক হয়ে ওরা আগাতে থাকে। পিছনে ফেলে যায় কিছু বিষাক্ত নিঃশ্বাস… তিক্ততায় ভরা কিছু মুহুর্ত… আর… আর… ধুত্তুরি, থাকনা ওগুলো পিছনেই পড়ে।।
১৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
প্রকৃত বন্ধুদের মাঝেই আমরা বেঁচে থাকি।
হাঁটুক রুনা ও শিহাব সব বিষ নিঃশ্বাস পেছন ফেলে।
মামুন
গল্পটির প্রতিটি পর্বে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো।
স্বপ্ন
জীবনে তোমার যখন অন্তত একবার পিছনে ফিরে দেখা প্রয়োজন- ঠিক সেই সময়টাতে আর ফেরা হয় না। ***** এটি আসলে বাস্তব।আমার জীবনেই এর প্রমাণ পেয়েছি।
প্রেমিক প্রেমিকার বন্ধুতে রূপান্তর আসলেই কি সম্ভব?হয়ত সম্ভব।একটি বড় গল্পকে এভাবে সমাপ্ত করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
মামুন
খুব সুন্দর মন্তব্য করলেন, অনেক ভালো লাগল।
বন্ধুতে রুপান্তর হলে বাকী জীবনটা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাবে। এজন্যই প্রথমে বন্ধু হওয়া প্রয়োজন।
অনেক ধনযবাদ আপনাকে।
নুসরাত মৌরিন
গল্পটা অসাধারন হয়েছে। (y)
এমন বন্ধু আমরা সবাই খুঁজি যার হাতে নির্ভয়ে হাত রেখে জীবনটা পার করা যায়।
কিন্তু এমন বন্ধু যে পাওয়াই যায় না!!রুনা পেয়েছে দেখে খুব ভাল লাগলো।
আপনি খুব ভাল প্রেমের গল্প লিখিয়ে …(y)
মামুন
গল্পটিতে সাথে থাকার এবং সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ব্লগার সজীব
এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।লেখায় আপনার দারুন দখল।
মামুন
সাথে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভরাত্রি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
তাহলে শেষটায় তাঁরা বন্ধু হতে পারলো! গল্প হলেও অভিনন্দন ওদের।এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।গল্পটির সমাপ্তিতে অনেক সুন্দর একটি রুপ দিয়েছেন।ধন্যবাদ আপনাকে।
আরও গল্প আশা করছি।
মামুন
সহমত আপনার সাথে- ‘এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার’।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
শুভরাত্রি।
মেহেরী তাজ
অসাধারন একটি গল্পের সুন্দর সমাপ্তি।
মামুন
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
শুভরাত্রি।
শুন্য শুন্যালয়
যাক, শিরোনাম এটা কেনো এমন মনে হয়েছে এতোদিন, এবার পুরোপুরি স্বার্থক হলো, তবে বন্ধু তারা হতে পারবে কিনা জানা নেই, ধুত্তুরি, থাকনা ওগুলো চিন্তা পিছনেই পড়ে। সুন্দর সমাপ্তি।
মামুন
অনেক ধন্যবাদ প্রতিটি পর্বে আপনার উপস্থিতি এবং নান্দনিক মন্তব্যের জন্য।
শুভ সকাল।
লীলাবতী
পোষ্ট দেয়ার দিনই পড়েছি। সুন্দর সমাপ্তির জন্য ধন্যবাদ।
মামুন
সাথে থাকার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।