তারপর প্যাকেটটা এমনভাবে বাঁধা হল যে, কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে খুলতে। আমরা তাঁকে উপহার দিয়েই ভাগব। এই ফটোর মধ্যে ছিল মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই, শুধু শরীরটা আছে, বস্তি, মসজিদে আগুনে জ্বলছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, এমনই আরও অনেক কিছু। মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তাঁর লোকেরা দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে।
আমরা নারকেলডাঙায় মহাত্মাজীর ওখানে পৌঁছালাম। তাঁর সাথে ঈদের মোলাকাত করব বললাম। আমাদের তখনই তাঁর কামরায় নিয়ে যাওয়া হল। মহাত্মাজী আমাদের কয়েকটা আপেল দিলেন। আমরা মহাত্মাজীকে প্যাকেটটা উপহার দিলাম। তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করলেন। আমরা অপরিচিত সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নাই। তবে বুঝতে পারলাম, তাঁর নাতনী মনু গান্ধী আমার চেহারা দেখেছে ব্যারাকপুর সভায়, কারণ আমি শহীদ সাহেবের সাথে প্লাটফর্মে বসেছিলাম। আমরা উপহার দিয়ে চলে এলাম তাড়াতাড়ি হেঁটে। শহীদ সাহেব তখন ওখানে নাই। বন্ধু ইয়াকুবের এই ফটোগুলি যে মহাত্মা গান্ধীর মনে বিরাট দাগ কেটেছিল তাতে সন্দেহ নাই। আমি শহীদ সাহেবকে পরে এ বিষয়ে বলেছিলাম।
আমাদের পক্ষে কলকাতা থাকা সম্ভবপর না, কারণ অনেককে গ্রেফতার করেছে। জহিরুদ্দিনের বাড়ি তল্লাশি করেছে। আমাদেরও ধরা পড়লে ছাড়বে না। ভাগতে পারলে বাঁচি। একটা অসুবিধা ছিল, আমি ও আমার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সাহেব একটা রেস্টুরেন্ট করেছিলাম পার্ক সার্কাসে। সে বাড়ি গিয়েছে আমার বোন ও রেণুকে পৌঁছে দিতে। আসতে দেরি করছে। আমি দেখাশুনা করি না, ম্যানেজার সব শেষ করে দিচ্ছে। তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়ে আমি রওয়ানা করব ঠিক করলাম। শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তাঁকে রেখে চলে আসতে আমার মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার মন বলছিল, কতদিন মহাত্মাজী শহীদ সাহেবকে রক্ষা করতে পারবেন? কয়েকবার তাঁর উপর আক্রমণ হয়েছে। তাঁকে হিন্দুরা মেরে ফেলতে চেষ্টা করছে। বিজ্ঞান কলেজের সামনে তাঁর গাড়ির উপর বোমা ফেলে তাঁর গাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি কোনোমতে রক্ষা পেয়েছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম, “চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন?” বললেন, “যেতে তো হবেই, তবে এখন এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে? দেখ না, সমস্ত ভারতবর্ষে কি অবস্থা হয়েছে, চারদিকে শুধু দাঙ্গা আর দাঙ্গা। সমস্ত নেতা চলে গেছে। আমি চলে গেলে এদের আর উপায় নাই। তোমরা একটা কাজ কর দেশে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক গোলমাল যাতে না হয়, তার চেষ্টা কর, যাতে হিন্দুরা চলে না আসে। ওরা এদিকে এলেই গোলমাল করবে, তাতে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে পূর্ব বাংলায় ছুটবে। যদি পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের মুসলমান একবার পূর্ব বাংলার দিকে রওয়ানা হয়, তবে পাকিস্তান বিশেষ করে পূর্ব বাংলা রক্ষা করা কষ্টকর হবে। এত লোকের জায়গা তোমরা কোথায় দিবা আমার তো জানা আছে। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দিও না।”
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ৮১ ও ৮২)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (পর্ব-৬৯)
৭টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হুম! সব এক। জাতিদাংগা লেগেই থাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এর যেনো আর শেষ নেই।
নীলাঞ্জনা নীলা
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৃথিবী ধ্বংস না হলে শেষ হবেনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মানুষ কেনো মানুষকে মানুষের বিবেচনায় দেখে না! এ মানুষজন কি করে সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব?
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু সেরা জীব আর মানুষ নয়!
জিসান শা ইকরাম
কি বীজ যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো বৃটিশরা, এখনো চলছে তা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
চলছে। রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে রাজনীতির কুশীলবরাই এখন তা জিইয়ে রাখছেন। এই বিষাক্ত বিষের থাবা সভ্যতার মূলে কুঠারাঘাত স্বরুপ। দিনে দিনে তা সভ্যতাকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে।