লীগ অফিস রিফিউজি ক্যাম্প হয়ে গেছে, ইসলামিয়া কলেজও খুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা মাদ্রাসা যখন খুলতে যাই, তখন দারোয়ান কিছুতেই খুলতে চাইছে না। আমি দৌড়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে গেলে তিনি নিজেই এসে হুকুম দিলেন দরজা খুলে দিতে। আশে পাশে থেকে কিছু লোক কিছু কিছু খবর দিতে লাগল। বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেল পূর্বেই ভরে গেছে। এখন চিন্তা হল টেইলর হোস্টেলের ছেলেদের কি করে বাঁচাই। কোন কিছুই জোগাড় হচ্ছে না। কিছু ছাত্র দুপুরে চলে এসেছে। কিছু আটকা পড়েছে। বিল্ডিংটা এমনভাবে ছিল যে, মাত্র একটা গেট। চারপাশে হিন্দু বাড়ি, আগুন দিলে সমস্ত হিন্দু মহল্লা শেষ হয়ে যাবে। রাতে কয়েকবার গেট ভাঙবার চেষ্টা করেছে, পারে নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ধরতে পারছি না। ফোন করলেই খবর পাই লালাবাজার আছেন। লালাবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার। নূরুদ্দিন অনেক রাতে একটা বড় গাড়ি ও কিছু পুলিশ জোগাড় করে তাদের উদ্ধার করে আনার ব্যবস্থা করেছিল। অনেক হিন্দু তালতলায়, ওয়েলেসলী এরিয়ায় ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক গোপনে আমাদের সাহায্য চাইল। অনেক কষ্টে কিছু পরিবারকে আমরা হিন্দু এরিয়ায় পাঠাতে সক্ষম হলাম, বিপদ মাথায় নিয়ে। বেকার হোস্টেলের আশেপাশে কিছুকিছু হিন্দু পরিবার ছিল, তাদেরও রক্ষা করা গিয়েছিল। এদের সুরেন ব্যানার্জি রোডে একবার পৌঁছে দিতে পারলেই হয়।
আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ, আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজোবোনের জন্য চিন্তা নাই, কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীরামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিক পড়ে। একেবারে ছেলেমানুষ। একবার মেজো জনের বাড়ি, একবার আমার ছোট বোনের বাড়ি এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কথা বেশি শুনে না। খুবই দুষ্ট ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে! শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে, সে পাড়ায় মাত্র দুইটা ফ্যামিলি মুসলমান।
কলকাতা শহরে মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়! এক এক করে খবর নিতে চেষ্টা করলাম। ছোট ভগ্নিপতি হ্যারিসন রোডে টাওয়ার লজে থাকে। সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে যেয়ে খবর নিলাম, সে চলে গেছে কারমাইকেল হোস্টেলে। নাসের মেজোবোনের কাছেও যায় নাই, আমার কাছেও নাই। আমার সবচেয়ে ছোট ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, “নাসের ভাই ১৬ই আগস্ট আমার এখানে এসেছিল, থাকতে বললাম, থাকল না। আমিও জোর করলাম না। কারণ আমার জায়গাটাও ভাল না। আমাদেরও পালাতে হবে।”
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-৬৫-৬৬)
৬টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আগের পর্ব কয়েকটা মিস হয়েছে আপু সময় করে পড়ে নেবো, আর এই পর্বটা পড়ে বুক ধুক করে উঠলো, যায় আগের গুলো পড়ে আসি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
‘৪৭ এ দেশ ভাগের আগে পরে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল ভারত উপমহাদেশজুড়ে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখলে আমারও ভয় লাগে তা মনে করে।
ইঞ্জা
আপু মানুষ বুঝেনা ধর্ম মানুষের জন্য মানুষ ধর্মের জন্য নয়।
নীলাঞ্জনা নীলা
কি ভয়ঙ্কর! কি বীভৎস!! তারপরেও মানুষের এখনও কি শিক্ষা হয়েছে? ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়না।
আপু ভালো থেকো। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যুগেযুগে কেনো যে মানুষ এমন ধর্মের নামে মানুষ মেরে স্বর্গ লাভ করতে চায়, ভেবে পাই না। অথচ মানুষের সেবার মাঝেই যে সুখ এবং স্বর্গপ্রাপ্তির সুযোগ আছে সে বোধই অদের কাজ করে না। এ কি ঈশ্বরেরই খেলা?
নীলাঞ্জনা নীলা
ধর্মগ্রন্থ পড়ি স্বামী বিবেকানন্দের কথাটা কেউ মনে রাখিনা, “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর!”