
বিয়ের কিছুবছর পরে আবেগ হারিয়ে স্বামী- স্ত্রী ভাইবোনের মতো হয়ে যায়। যেন বহু দিনের অভ্যাস। পুরোনো কাঁথা বালিশ গায়ে দিতে যেমন আরাম বোধ হয় সেরকম। তাই তারা অভ্যাসবশত থেকে যায়।
মধ্যবয়স পার হতে থাকবার সময়গুলোতে ছেলে- মেয়ে বড় হয়। তাদের বিয়ে-থা হয়ে গেলে কেউ একজন একা বোধ করতে থাকে। হারিয়ে যাওয়া জীবন আর সময়গুলো খুঁজে ফেরে। হিসেব মেলে না। হায়! হায়! এতো পাওনা জীবনের কাছে। প্রচন্ড অভিমান হতে থাকে সঙ্গীর প্রতি। জীবন ভর ঠকে এসেছে আর একজন ঠকিয়ে এসেছে এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। এক বুক কান্নায় বুক ভাসিয়ে কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
ডিভোর্সটাকে আপাত দৃষ্টিতে কঠিন সিদ্ধান্ত মনে হলেও তাদের কাছে খুব স্বাভাবিকই মনে হয়। একজন অভিমান থেকে দুরে সরে যায়। অন্যজন ভেজাবেডাল হয়ে তার প্রাক্তনেই জমে থাকে।
অরুনিমার পাশে এখন একজন গল্প করার, আকাশ দেখবার মানুষ দরকার। অনেক তো হলো নাম, ধাম, যশ, প্রতিপত্তি কামানো। এখন সব গুছিয়ে নিজেকে সময় দেবার পালা। যে মানুষটার সাথে এতোগুলো বছর সে কাটিয়েছে। তাকে একান্ত করে পাবার পালা। তাকে ভালো করে দেখবার পালা। এক পাহাড় কথা বাকি পড়ে আছে সেগুলো তাকে বলবার পালা।
কালক্ষেপণ না করে অরুনিমা পঁচিশ বছর পর তরুনীদের মতো হাঁটু মুরে আসিফকে প্রপোজ করলো- “তোমাকে আমার শেষ সূর্যাস্তে শুধু আমার করে চাই। আমার পাহাড় সম অনেক জমে থাকা কথার পাহাড় বলতে চাই। তোমার সাথে মুখোমুখি বসতে চাই গোধুলীতে। একটা শিশির কণাকে ভাগাভাগী করে গালে মাখতে চাই। প্রচন্ড শীতে নিজের পকেট রেখে তোমার পকেট থেকে ওম নিতে চাই। কিছু না দেবার বেলায়ও তোমার ঝুলন্ত গালে যৌবনা চুম্বন এঁকে দিতে চাই। বলো তুমি রাজী।”
একি পাগল হলো? একবছর পর এসব কেন? আজ মিথ্যে বলতে পারলো না, আসিফের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। এতোবছর এতোটা আবেগ দিয়ে তো অরুনিমা তাকে চায়নি। আসিফ যেভাবে চালিয়ে এসেছে সে সেভাবেই চলেছে। কাজ পাগল মেয়েটি আসিফের চেয়ে তার দেয়া কাজ ও দায়িত্বকেই বেশী পছন্দ করেছে, গুরুত্ব দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে। প্রেমহীন শারীরিক খেলায় মেতে মা হয়েছে। আসিফের সব কিছু আগলে রেখেছে। আসিফ আজকে লোকের কাছে যতটা পরিচ্ছন্ন ভেতর থেকে পুরোটাই অরুনিমার তৈরি।
আসিফ আজ অভিনয় করতে পারলো না। করতেও ইচ্ছে করলো না, ধরা পড়ে গেলো। সুর্যাস্তের এই বেলায়ও তার চোখে- মুখে সকালের রোদের মতো স্পষ্ট হয়ে অরুনিমার কাছে ধরা পড়ে গেলো এতোবছরের অভিনয়। অরুনিমার প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। আসিফ হয়তো মজা নিচ্ছে তাই সে দ্বিতীয় বার প্রপোজ করে অপেক্ষায় রইলো। এবারও আসিফ কিছু না বলে অরুনিমাকে টেনে তুললো।
অরুনিমার অনেকবারই সন্দেহ হয়েছে আসিফ আসলে তাকে করুনা করছে। পাশাপাশি ব্যবহার করছে। আজ সত্যিটা জানতে বড্ড ইচ্ছে করলো। জানা হবার পর সে সিদ্ধান্ত নিলো এতকাল যে অভিনয়ের সাথে সংসার করেছে আর নয়! এবার অন্যজীবনের পালা। নিজেকে সে আর ঠকাবে না। একটা বিশ্বাসহীন, প্রতারনার সম্পর্ক সে ভেঙ্গে দেবার বেলায় তার মনে হলো আজকের এই হিসেবটা ঠিক আছে। যদিও আসিফকে সে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসে এবং মিস করবে।
দীর্ঘজীবন অভিনয় করে যাওয়াও বেশ কষ্টের। আসিফও অনেক কষ্ট করেছে। এতোবছর অভিনয় করে নিশ্চয় সেও হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই আজ সে ইচ্ছে করেই ধরা দিলো। সেও চায় না আর অভিনয় করতে। অন্তত শেষ বয়সে যখন শরীর উপেক্ষিত হয়, মন তার আপন মহিমায় গর্জে ওঠে। তখন অভিনয় নয় সত্যিকার প্রেম দরকার হয়।
“সব সম্পর্কই এক সময় শিথিল হয়ে যায় হোক সে বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার সম্পর্ক। যদিও মনে করি আমরা এর উদ্ধে আসলে তা নয়। অধিকাংশ মানুষই একসময় আর জোডাতালি দিতে পারে না। নতুনত্বের জন্ম দিতে পারে না। এজন্যই শেষ বয়সে এসে ডিভোর্স হয়। গোছানো সংসার ভেঙ্গে যায়।”
আসিফ ইকবাল, একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার। পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক সে সময়ের মেধার এক্সাম্পল হলেও শিক্ষকতা জীবন শুরু করলেন। কিন্তু মন বসাতে পারেননি। উড়ন্ত মন নিজেই কিছু জন্ম দিতে চায়। পরে নিজেই একটা সফটওয়্যার কম্পানী খুলে বসেন। একা একা সব সামলানো যায় না তাই একজন সহযোগী দরকার। অনেকেই এলেন কিন্তু তার সবচেয়ে চটপটে মেধাবী অরুনিমাকেই পারফেক্ট বলে মনে হলো। মনে হলো তারই মেধার অর্ধ কপি।
যে কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে সহযোগী সমান সমান না হলে একটু সমস্যাই হয়। এভাবে তাদের চলা শুরু। আসিফ দিনে দিনে অরুনিমার মেধার মুগ্ধ হয়ে গেলো এবং একসময় তার প্রতিষ্ঠান নামকরা একটিতে পরিনত হলো।
আসিফ অত্যন্ত হিসেবী মানুষ। তার মনে হলো এই মেয়ে যে কোন সময় তার প্রতিষ্ঠান থেকে চলে যেতে পারে। তাকে আটকানোর একমাত্র উপায় প্রেম ও বিয়ে। মেধা ও প্রয়োজন দুটোরই প্রেমেও পডেছেন। এখন বাকিটুকু সেরে ফেলতে হবে। কিছুটা সময় দিতে দিতে প্রেমে না পড়া মেয়েটিও প্রেমে পড়ে গেল। সাতবছর প্রেমের পর তারা ঘর বাঁধলেন।
দু-তিনটে বাচ্চাসহ অত্যন্ত গোছানো এবং চমৎকার একটি সংসার যা অনেক মানুষের আইডল। তাহলে কেন? পঁচিশ বছর পরে আইডল হেলে পড়লো?
আসিফ যখন অরুনিমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো তখন সেটা ছিলো আবেগহীন প্রয়োজন। তাকে আটকে রাখবার জন্য ভালোবাসাহীন একটা সমঝোতা। নিজেকে সেরা করে দেখবার বাসনা। সর্বোপরী আসিফ সে সময় অন্য কারও বাগদত্তা, যার সাথে তার হাজারো স্মতিবিজরিত সকাল, দুপুর, রাত।
বিয়ের পরও তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি।First love never die আসিফও পারেনি। একসাথে সে দুটো সংসার চালিয়েছে। একটা লোকদেখানো ভালোবাসাহীন সংসার অন্যটা তার মনে পড়ে থাকা প্রেম। কোম্পানির বহু দায়িত্বের মাঝে অরুনিমা ডুবে গিয়েছিলো। আসিফের অমনোযোগের হিসেব ছিলো না বা একটু ব্যস্ত মানুষরা এমনই হয়, এই ভেবে নিয়ে সংসার চালিয়ে গেছে। আসিফের মন পড়ে থাকতো প্রাক্তনের কাছে, তার সঙ্গ পাবার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকলেও ভদ্রবেশী মানুষটা পাকা অভিনেতা।
দুজনের কাউকেই সে নিজের প্রয়োজনে ছাড়েনি। অন্যজন আসিফের জন্য এতটাই পাগল যে বিয়ে পর্যন্ত করতে পারেনি। বাগদত্তা বা আশ্রিতা হয়েই জীবন কাটিয়েছে!!
ছবি- নেটের
১৪টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
অনেক ভাল লাগল রুকু আপু
রোকসানা খন্দকার রুকু
অনেক ধন্যবাদ লিটন ভাই। শুভ কামনা রইলো
আরজু মুক্তা
শুকনো ফুল টিকে বেশিদিন। এই থিউরি কাজ করছে।
ভালোবাসা কারও কাছে প্রয়োজন। কারও কাছে লোক দেখানি।
সবচেয়ে ভালো মেনে নেয়া। জীবনে উত্থান পতন থাকে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সবসময় মেনে নেয়া যায় না।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল।
হালিমা আক্তার
খুব ভালো লাগলো। আসিফ নিজের প্রয়োজনে নিজেকে ঠকালো । বাস্তবতার সুনিপুণ চিত্র। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো
সাবিনা ইয়াসমিন
সমাজে এমন আসিফদের অভাব নেই। ভদ্র মানুষের খোলশে এরাই আসলে সেরা অভিনেতার দাবীদার। যেহেতু এরা নিজেরাই নিজেদের পুরস্কৃত করে তাই এদের আসল চেহারা সহজে প্রকাশিত হয় না। সহজ সরল অরুনিমারা জীবন পাড় করে দেয় এদের সাথে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে। গল্পের অরুণিমার পদক্ষেপ ভালো লেগেছে।
আরেকটু যোগ না করলেই নয়,
“সব সম্পর্কই এক সময় শিথিল হয়ে যায় হোক সে বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার সম্পর্ক। যদিও মনে করি আমরা এর উর্ধ্বে আসলে তা নয়। অধিকাংশ মানুষই একসময় আর জোড়াতালি দিতে পারে না। নতুনত্বের জন্ম দিতে পারে না। এজন্যই শেষ বয়সে এসে ডিভোর্স হয়। গোছানো সংসার ভেঙ্গে যায়।”
আপনার সব লেখার মতোই এখানেও এই বিশেষ লাইন গুলো প্রশংসা যোগ্য।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা অবিরাম 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ অসাধারণ মন্তব্যর জন্য। আপনাদের মতামত আমার অনুপ্রেরণা।
শুভ কামনা রইলো
রেজওয়ানা কবির
আগেই বলে নিচ্ছি কপি পেস্ট করছি না, এভাবে যদি সত্যি কাউকে প্রপোজ করা যায় সে যদি এর মর্ম না বুঝে তবে এর চাইতে আর দুঃখ নেই বললেই চলে।
“তোমাকে আমার শেষ সূর্যাস্তে শুধু আমার করে চাই। আমার পাহাড় সম অনেক জমে থাকা কথার পাহাড় বলতে চাই। তোমার সাথে মুখোমুখি বসতে চাই গোধুলীতে। একটা শিশির কণাকে ভাগাভাগী করে গালে মাখতে চাই। প্রচন্ড শীতে নিজের পকেট রেখে তোমার পকেট থেকে ওম নিতে চাই। কিছু না দেবার বেলায়ও তোমার ঝুলন্ত গালে যৌবনা চুম্বন এঁকে দিতে চাই। বলো তুমি রাজী।”
অসাধারন বাক্যগুলো। তবে আমার মনে হয় যখন সম্পর্ক মেকি হয়ে যায় তখন আলাদা হওয়াই ভালো,এর চাইতে একা থাকাও ভালো। আর যতদিন আমরা যেকোনো সম্পর্কে সব রহস্য জানি না ততদিন আমাদের সেই সম্পর্ক চালাতে ভালো লাগে কিন্তু যখনি একজন আরেকজনকে পুরোটা জানি তখনি শুরু হয় সমস্যা এটা আমার ধারনা। সেটা যেকোনো সম্পর্কই হতে পারে। এই লেখায় অনেক মেসেজ পেলাম।ভালো লিখেছো আপু শুভকামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সম্পর্ক মেকি হলে আসলেই আলাদা হওয়াই ভালো।
ধন্যবাদ ও শুভকামনা আপুনি।
জিসান শা ইকরাম
অভিনয় দিয়ে সম্পর্ক চালিয়ে নেয়া প্রতারনারই নামান্তর,
স্বার্থের জন্য প্রেম অতপর বিয়ে! এতো নিজের জীবনের সাথেও প্রতারনা।
অরুনিমার মত মেয়ের সংখ্যাই বেশি, যারা অভিনয়কে বুঝতে পারে না।
লেখার মাঝে চিন্তা করার অনেক খোরাক আছে।
সুন্দর লেখা। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বুঝতে না পেরেই জীবন চালায়। ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
লেখার মত চাইলেই যদি সব কিছু পাওয়া যেত তাহলে জীবনটা শেষে এসেও অনেক রঙ্গীন হয়ে যেত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সেটাই ভাইয়া। ভালো থাকবেন।