
একদিন আমি গলির মাথায় টং দোকানে চা খাচ্ছিলাম। টং দোকানের পাঁচ ছয় টাকা চায়ের যে স্বাদ সে স্বাদ ভালো কোন রেস্টুরেন্ট এর বিশ তিরিশ টাকার কাপ চায়ে পাওয়া যাবে না।
এজন্য আমি প্রায় গলির মোড়ে রাস্তার পাশে চা দোকানে চা খাই। খেতে খুব ভালো লাগে।
টং এর চা দোকান কেন্দ্র করে অনেকের জীবন ধারণের উৎস হয়ে গেছে।
এখানে যেমন পেশাদার ভিক্ষুক বসে থাকে চা খোরদের কাছ থেকে ভিক্ষা পাওয়ার জন্য ঠিক তেমনি টং দোকান কেন্দ্র করে কিছু কুকুর তার জীবন নির্বাহ করে চা খেতে আসা লোকদের দয়ায়, যদি কখনো কেক বা রুটি পাওয়া যায়।
দোকানিরা তার মেয়াদ উত্তীণ বাসি রুটি কেক সারাদিন অভুক্ত থাকা তার দোকান কেন্দ্র করে বসে থাকা কুকুর কে দেয়।
গরিব মানুষের টাকার লোভ বেশি তারা মেয়াদ উত্তীণ রুটি যতক্ষণ খাবার উপযোগী থাকে ততক্ষন ভোক্তাদের খাওয়ায়।
যখন থেকে বাসি গন্ধ বের হয় দোকানি বিরক্ত মুখে তার দোকানে সারাদিন অভুক্ত বসে থাকা কুকুর কে রাত্রে রুটিগুলো দিয়ে দোকান বন্ধ করে দেয়।এভাবেই চলতে থাকে একটা রাস্তার ভাগ্যবান লেরি কুকুরের জীবন চক্র।
এই পঁচা বাসি খাওয়া কুকুরদের কেন ভাগ্যবান বললাম কারণ এরা পঁচা বাসি যাই খাক নিয়মিত খাবার পায়, কিন্তু অনেক জায়গার ভবগুরে কুকুর তাও পায় না। তারা সারাদিন অনাহারে অর্ধাহারে থাকে মানুষ অনাহারে থাকলে চেয়ে খেতে পারে কিন্তু এসব বে-জবান প্রাণীর সেই ক্ষমতাও নেই।
অসহায় মায়াবী চোখের ইশারায় যদি কখনো কোনদিন কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি দয়াপরশ হয়ে তাদের কিছু খেতে দেয় তবেই ওদের হতভাগ্যে অন্ন জুটে।
যাইহোক এবার মূল গল্পে আসি।
কিছুক্ষন আগে আমার কাছে একটা হতদরিদ্র ছেলে কিছু সাহায্য চেয়ে টাকা নিয়ে গেলো। ছেলেটার জামা প্যান্ট অত্যান্ত নোংরা, দেখে মনে হয় হিরোইন খোর। আমার কাছে ভাত খাবার কথা বলে টাকা নিয়ে গেলো। যেহেতু ভাত খাবার কথা বলেছে, আমি তাকে বিশ টাকা দিলাম।
এবার তাকে টাকা দেওয়া দেখে কাছে বসে থাকা ভিক্ষুকের চোখ পূর্ণিমা রাত্রের হিংস্র নেকড়ের মতো লোভে জলজ্বলিয়ে উঠলো। সেও আল্লাহ বিল্লাহর নাম বলে অনেক নীতি কথা বলে ভিক্ষা চাইলো।
তাকে আমি পকেট থেকে দশ টাকা বের করে দিলাম।
পরক্ষনেই আমার চোখ গেলো দোকানের কোনায় বসে থাকা হাড়জিরজিরে একটা কুকুরের দিকে।
সে মুখ ফুটে আমার কাছে কিছুই চায়নি তার চোখের মায়াবী চাহুনির শব্দহীন ভাষা যেন আমি পড়তে পারলাম। সেই ভাষায় যে অসহায়ত্ব, বেঁচে থাকবার তীব্র আকুলতা সবই যেন আমার সামনে অকপট অকৃত্রিম স্বীকার উক্তির মতো ভেসে উঠলো।
প্রথম দুইজনের বিনয় এবং অসহায়ত্বের অভিনয়ের মাঝে যেমন কপটতা আর কৃত্রিমতা দেখেছি তৃতীয় জনের চোখের ভাষায় তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখলাম।
আমি পাঁচ টাকা দিয়ে একটা রুটি কিনে কুকুর টাকে দিলাম। কৃতজ্ঞ চিত্তে সে আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকার পর সে তৃপ্তি সহকারে বহুদিনের ক্ষুদা নিবারণ করলো।
এর কিছুদিন পর অনেক রাত্রে সেই গলি দিয়ে আমি বাসায় ফিরছিলাম। আজ ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেছে রাস্তার টং দোকানটাও বন্ধ। হটাৎ আমার ঘাড়ের পাশে শীতল অনুভব আসলো। বিচ্ছিরি গলায় কেও একজন বললো সঙ্গে যা আছে সব দিয়া দেন নইলে ফুটা কইরা দিমু।
ওই অদূরে সেই ভিক্ষুক টাকে দেখলাম সেদিন যাকে দশ টাকা ভিক্ষা দিয়েছিলাম সে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম চাচা বাঁচান সে না বোধক মাথা ঝাকালো।
বোধহয় ভয় পেয়েছে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর এখন আমার কাছে মূর্তমান হলো। এতো সেই ভবঘুরে ছেলে! সেদিন যে ভাত খাবার কথা বলে আমার কাছ থেকে বিশ টাকা নিয়েছিল।
আমি বিস্ফারিত চোখে বললাম তুমি তুমি না সেদিন আমার কাছ থেকে বিশ টাকা নিলে?
ছেলেটা ফিক ফিক করে অট্টহাসি দিয়ে বললো এটাই আমগো গরিবদের ব্যবসা সকালে আপনাগো সামনে হাত পাতি আর রাইত্রে সেই হাত দিয়েই লুটি।
ওই বুড়া তুমি চুপ থাকবে তোমারেও ভাগ দেব ধমক মাখা নির্দেশ এর সুরে বললো ছেলেটা।
একথা শুনে বুড়া ফকিরের লোভকাতুর মুখে এখন আতঙ্কের জায়গায় বিস্ময় মাখা তৃপ্তির হাসি।
আমি মনের অজান্তে অকৃতজ্ঞ ছেলেটার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। শুরু হলো আমাদের মাঝে ধস্তা ধস্তি টানা টানি।
যে বুড়ো ফকিরটার কিছুক্ষন আগেও সাহায্য প্রার্থনা করেছিলাম সেও এসে যোগ দিলো এই ধস্তাধস্তিতে।
হটাৎ সেই ছেলেটা তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে আমার হাতে পোচ বসিয়ে দিলো। সাথে সাথে আমার হাত বেয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়তে থাকলো।
হঠাৎ লক্ষ করলাম সেদিন যে কুকুর টাকে রুটি খাইয়েছিলাম সে ঘেউ ঘেউ করতে করতে উপস্থিত।
কুকুরের উচ্চস্বরে ঘেউ ঘেউ চিৎকারে ছিনতাইকারী ওই ছেলে আর বুড়ো ফকির দুইজনই অপ্রস্তুত আর বিব্রত।
কুকুরটা আমাদের জটলার চারপাশ ঘিরে ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। হঠাৎ কুকুর থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে ছেলেটা যেইনা আমার দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আমার পেট বরাবর চাকু মারার জন্য তাক করেছে।
অমনি কুকুরটা তার হাড়জিরজিরে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার চাকুধরা হাতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো।
কুকুরের ধারালো দাঁত গুলো যেন ছেলেটার হাতের মাংস ভেদ করে হাড়ে বসে গেছে, ছেলেটা আর্তনাদে চিৎকার করে উঠলো এতক্ষন ধরে চলা কুকুরের চিৎকার।
এবার ছিনতাইকারী ছেলের আর্তনাদে কানফাটানো বিকৃত আত্মচিৎকারে ধীরে ধীরে অন্ধকার গলির বাসা গুলো আলোকিত হতে লাগলো। লোকজন হৈ হৈ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
সবাই আমাকে উদ্ধার করলো। ছেলেটার হাতে কামড়ে থাকা কুকুর টাকে ছাড়ালো, বুড়ো ফকির আর ছিনতাইকারী ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে পুলিশ এ সোপর্দ করলো।
সবাই সবিস্তরে শুনে শুনে বললো মানুষের থেকে কুকুর উত্তম। গরিবকে টাকা দিয়ে সাহায্য করার থেকে এরকম একটা কুকুরকে একবেলা খাওয়ালে তার প্রতিদান কত ভালোভাবেই না পাওয়া যায়।
এখন আমি প্রতিদিন টং দোকানে চা খাই। লাল বর্ণের সেই কুকুরটার নাম রেখেছি লালু। প্রতিদিন ওকে আমি একবাটি দুধ আর ভালোমানের পাউরুটি খাওয়াই।
এখন আর টং দোকানির পচা বাসি রুটি আর কেক ও খায়না। দোকানি দিলেও ফিরে তাকায়না। তার চোখে থাকে দোকানির প্রতি তাচ্ছিল্লের আভা আর আমার প্রতি থাকে মোহনীয় মায়া। আমার বাসায় জায়গা নেই, নইলে ওকে আমার কাছে এনে রাখতাম।
টং দোকানে লালু এখন অধীর অপেক্ষায় আমার জন্য বসে থাকে কখন আমি আসবো ওকে আমি দুধ পাউরুটি দেব। মাঝে মাঝে ভাবি মানুষের থেকে কুকুর উত্তম। মানুষকে সাহায্য করলে প্রতিদানে সে ঠকায়, ক্ষতি করে। কিন্তু রাস্তার সামান্য একটা কুকুরকে একবেলা খাওয়ালে সে জীবন বাজি রেখে তার প্রতিদান দেয়। প্রমাণতো আমার সামনে। লালু আমার ঋণ শোধ করেও যেন আমায় ঋণী করে দিলো।
একজন ভিক্ষুক বা গরিবকে ভিক্ষা দেবার থেকে একটা রাস্তার কুকুরকে একবেলা পেট ভরে খাওয়ানো অতি উত্তম। মানুষ বেইমানি করে কুকুর করে না। আজ আমি হাতে নাতে তার প্রমান পেলাম।
একজন ভবঘুরে ফকির কে ভিক্ষা দিলে সে আমাকে মনেও রাখবেনা। কিন্তু একটা সামান্য কুকুর কে খাওয়ালে সে আমাকে দেখলেই ছুটে আসবে। যদি আমি তাকে খাবার নাও দেই তবুও কৃতজ্ঞ নয়নে আমাকে ভালোবাসবে।
গরিবদের বিনয়ে থাকে লোভ লালসা কামনা। আর কুকুরদের চাওয়ায় থাকে একটু বাঁচার নির্মূল আকুতি।
এর পর থেকে আমি গরিবদের সাহায্যের থেকে রাস্তার ভবঘুরে কুকুরদের খাওয়ানোকে উত্তম কাজ বলে মনে করি। কোন পুণ্যের আশায় বা স্বর্গের লোভে নয় নিজের মানবিক মূল্যবোধ থেকে আমি এই অবলা প্রাণীদের খাওয়াই। কারণ আমি উপলব্ধি করেছি মানুষের থেকে কুকুর উত্তম। গরিবদের দানের থেকে কুকুর কে খাদ্যদান করা সর্ব উত্তম।
.
১২টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
অবাঞ্চিত কিছু ঘটনা/দুর্ঘটনা আমাদের স্বাভাবিক ভাবনা-বোধগুলোকে বিপরীত দিকে ধাবিত করে। নয়তো সৃষ্টির সেরা মানুষ, এটা সর্বজ্ঞান থাকার পরেও আমরা মানুষকে অন্যকোন প্রাণীর সাথে তুলনা করতে পারতাম না।
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়,ধনীদের বড়লোক বলে আর গরীবদের বলা হয় ছোটলোক। এই সম্বোধন যে সব সময় শুধু অর্থনৈতিক কারণে ঘটে তা নয়, নৈতিক বিশৃঙ্খলা বোঝাতেও এমন সম্বোধন দেয়া হয়। কোন কোন সময়ে পশুর বিশস্ততা মানুষের চেয়েও বেশি দেখা যায়।
সোনেলা পরিবারে আপনাকে সাদরে স্বাগত জানাচ্ছি।
নিয়মিত লিখুন, সোনেলায় থাকুন।
শুভ কামনা নিরন্তর 🌹🌹
আফসানা ইয়াসমিন পায়েল
ধন্যবাদ
আলমগীর সরকার লিটন
সুন্দর লেখেছেন অনেক শুভেচ্ছা রইল
আফসানা ইয়াসমিন পায়েল
ধন্যবাদ
রোকসানা খন্দকার রুকু
কিছু বৈপরীত্য তো থাকেই। দারিদ্রতা এমনই মনুষ্যত্ব কেড়ে নেয়। আমরা কৃতজ্ঞতা বোধ ভুলে যাই।তবে আপনার সাথে আমিও একমত মানুষ বেশি লোভী। প্রাণীরা বরাবর কৃতজ্ঞ।
সোনেলায় আপনাকে স্বাগতম। নিয়মিত লিখুন, ভালো থাকুন।।
আফসানা ইয়াসমিন পায়েল
ধন্যবাদ
মনির হোসেন মমি
প্রথম দুইজনের বিনয় এবং অসহায়ত্বের অভিনয়ের মাঝে যেমন কপটতা আর কৃত্রিমতা দেখেছি তৃতীয় জনের চোখের ভাষায় তার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখলাম।
মানবিকতা বোধ সম্পর্ন একটা লেখা দিয়ে আপনি সোনেলায় আগমন করলেন।আমরা এমন কিছু লেখাই চাই যে লেখায় মানবিকতার পথটি উম্মোক্ত হবে।
অভিনন্দন এবং শুভ ব্লগিং
কুকুর একটি পরীক্ষিত পরপোকারী প্রানী।ও দানের প্রতিদান দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।চমৎকার অনুগল্প।
আফসানা ইয়াসমিন পায়েল
ধন্যবাদ
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনার জন্য শুভকামনা রইলো।সোনেলার উঠোনে এসে প্রথমেই একটি চমৎকার শিক্ষনীয় গল্প উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। মানুষ অকৃতজ্ঞ, লোভী, হিংসাপরায়ন কিন্তু পশুদের ক্ষেত্রে তার উল্টো। উপকারের কথা মানুষ নিমেষেই ভুলে যেতে পারে কিন্তু পশুরা ঠিক মনে রাখে আমৃত্যু। তাই এসব মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা না করে রাস্তার পশুদের জন্য কিছু করলে আপনার উপকারে ঠিক চলে আসবে নয়তো আপনাকে খুঁজে নেবে কখনো। সুস্বাগতম আপনাকে আমাদের প্রিয় সোনেলায়। পরবর্তী পোস্টের অপেক্ষায় রইলাম। ভালো থাকবেন নিরাপদে থাকবেন।
আফসানা ইয়াসমিন পায়েল
ধন্যবাদ
আফসানা ইয়াসমিন পায়েল
সবাই কে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে সুন্দর সুন্দর মন্তব্য লিখছে সময়ের অভাবে সবার মন্তব্যে আলাদা করে জবাব দিয়া সম্ভব হচ্ছে না
এজন্য আপনারা সবাই আমাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি
আপনাদের সবার সুন্দর কমেন্ট গুলো আমি লাইক এবং লাভ রিএক্ট দিয়ে আমি উপযুক্ত জবাব দিচ্ছি
যারাই আমাকে লাইক কমেন্ট শেয়ার করেছেন তাদের সকলকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ
এভাবেই আপনাদের ভালোবাসা সমর্থন সাহায্য আজীবন পেতে চাই পেয়ে আপনাদের সাথে থাকতে চাই
সকলের প্রতি শুভ কামনা করে এখানেই শেষ করছি সকলে ভালো থাকবেন
খোদা হাফেজ
নবকুমার দাস
ভালো লাগলো । মনুষ্যেত্বর বিকাশ হোক । হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স মাত্রই মানুষ না । তথাকথিত ইতর প্রাণীরা সহানুভূতিশীল কিন্তু কিছু মানুষ শুধুই চেহারায় মানুষ, বাস্তবে নয় ।