পৃথিবীর পথে পথেঃ সালভারড ( Salvard) ভ্রমণ কাহিনী ,ভ্রমণের সময় ২০২০
“থাকবো না আর বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎ টাকে”
+ শ্বেত ভল্লুক !
+ রেইন ডিয়ার !
+ ছয় মাস ‘দিন’ বলে কিছু নাই , আছে শুধু রাত, আছে শুধু অন্ধকার!
+ বাকি ছয় মাস শুধুই দিন ,’রাত’ বলে কিছু নাই!
কোথাই সেটা ?
উত্তর গোলার্ধের খুব কাছের একটা দ্বীপ । নাম তার ‘সালভার্ড’।
হ্যাঁ সালভার্ডের কথায় বলছিলাম। যেখানে এই অদ্ভুত ব্যাপার টা বিরাজমান ।
কেন এই অদ্ভুত দিন আর রাতের খেলা?
কারন উত্তর গোলার্ধ যখন সুর্য থেকে উত্তর মেরু টি কাত করে সরে যায়, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তখন সূর্যের আলো আর পায়না । ছয়মাস এই ভাবেই অন্ধকার হয়ে থাকে । তারপর উত্তর মেরু আবার ঘুরে যায় সূর্যের দিকে। সূর্যের চার দিকে পৃথিবীর চলার পথটিকে বলা হয় কক্ষপথ ।এই কক্ষপথে পৃথিবী বাকি ছয়মাস সূর্যের দিকে উত্তর মেরুটি মুখ করে থাকে । তাই বাকি ছয় মাস সূর্যের আলো থাকে ২৪ ঘণ্টা । এই হল আমাদের পৃথিবী আর সূর্যের খেলা। এটাই প্রকৃতির নিয়ম ।
এই দ্বীপে কোন মানুষ ছিলনা আগে। কোন গাছ পালা তো দূরের কথা ঘাসও নাই। পানি নাই। হ্যাঁ তবে এখন কিছু মানুষ আছে শুধু ট্যুরিজম ব্যাবসার জন্য। ইদানীং একটা ছোটো খাটো এয়ারপোর্ট করা হয়েছে ,ইলেকট্রিসিটী গেছে । রিসোর্ট করা হয়েছে। মানুষ আসে শুধু এই এর জিওলজী আর জুয়োলজি বুঝতে, জিয়গ্রাফী দেখতে। আর স্নো স্পোর্টস করতে। আসে ক্রুজ করে শ্বেত ভল্লুক দেখতে ।
আমাদের পরিবার টিম রওনা দিলাম টুরিস্ট হিসেবে সালভার্ড এডভেনচারে। নরওয়ে থেকে প্লেনে যাত্রা । সে সময় ডিসেম্বর । সালভার্দ এর এয়ারপোর্ট হাজার বরফ পরিষ্কার করা হলেও সঙ্গে সঙ্গে আইস হয়ে যায়। তাই প্লেনটা নেমেই একটু স্লিপ করলো । যা হোক চেকিং করার পর বাইরে এসে দেখি সেখানে রাখা আছে বিরাট একটি শ্বেত ভলুকের রেপ্লিকা। হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় বাস থাকে । সে সময় সব সময় অন্ধকারের সময়। চারদিক দুই হাঁটু নরম বরফ।
রিসোর্টে এসে দেখলাম ভিতর খুব সুন্দর গরম। রিসোর্টের মালিক আমাদের জন্য বিরাট একটি কেক বানিয়ে টেবিলের উপরে রেখে দিয়েছে। এটা ওয়েলকাম কেক। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘড়ি তে এলার্ম দিয়ে সকাল করা হল বটে কিন্তু সকালেও রাত, দুপুরেও রাত, বিকালেও রাত ।
কুকুর টানা স্লেজ গাড়ি
আমরা অন্ধকারে বুকিং দেয়া স্লেজ গাড়িতে এডভেনচার করার জন্য রেডি হলাম। গাড়ি এসে নিয়ে গেলো । দূর থেকে কুকুরের ডাকা ডাকি শোনা যাচ্ছে। তারা নাকি স্লেজ নিয়ে দৌড়াতেই পছন্দ করে। প্রায় ১০ /১২ টি কুকুর টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি । দুই একটা বাড়ি শেষ হলেই সব ফাঁকা । শুধু বরফ আর বরফ । পাশেই সমুদ্র, আবছা আলোই দেখা যাচ্ছে সাদা সাদা বরফ ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে। তাই তীব্র শীত । উত্তর মেরুর অতি ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস যা বর্ণনার ভাষা নাই। হাত বের করে ছবি তুলবো কিন্তু হাত বের করতেই পারছিনা।যদিও ডবল করে গ্লভস পরে আছি। মাইনাস ৪০ ডিগ্রি হবে। আমাদের গাইড তার কোমরে বেল্টে ৪/৫ তা রিভালভার নিয়ে রেডি করে রেখেছে। শ্বেত ভাল্লুক কয়েক মিটার দূর থেকে আক্রমণ করতে পারে। তখন আমরাকে বাঁচাতে গাইডকে ভল্লুক মেরে ফেলতে হবে। সালভারডে মানুষের চেয়ে শ্বেত ভালুকের সংখ্যা বেশি।কিছুদিন আগে এরকম একটা ঘটনা হয়েছিলো ঠিক এই জায়গাটিতেই।গা ভয়ে ছম ছম করে উঠলো ।
গাইড কে জিগ্যেস করলাম সে শ্বেত ভল্লুক দেখেছে কিনা। সে জানালো অনেকবার দেখেছে। তার যেহেতু টুরিস্ট কে এখানে নিয়ে আসা তাই অনেক বার দেখেছে। যেহেতু ভালুকের ঘ্রাণ শক্তি এতোই বেশি, দূর থেকে ঘ্রাণ পেয়ে যায় কোন দিকে শিকার আছে ।একে তীব্র শীত তার উপর শ্বেত ভল্লুকের ভয় আর চারদিকে নিকেশ অন্ধকার । নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ি মুখে রওনা দিলাম ।
যেতে যেতে আমাদের গাইড সালভারদের অনেক গল্প করলো ।
সালভার্দের আয়তন ৬২,১৬০ sq কিমি । আয়ারল্যান্ডের সমান। উত্তর গোলার্ধের ৮১ ডিগ্রি উত্তরে আর্টিক সমুদ্রের মধ্যে। ১১৯৪ সালের আগে মানুষ জানতো না এই দ্বীপের কথা। ১১৯৪ সালের পরে মানুষ জানতে পারে এখানে একটা দ্বীপ আছে কিন্তু জানতো না এটা একটা দ্বীপ না আইসবার্গ । আইসবার্গ মানে ভাসমান বিরাট আইস।
এরপরে আরও কয়েকশত বছর পরে চীন আর ইনডিয়া যাওয়ার সর্ট কার্ট রাস্তা খুঁজতে ডেনমার্কের একটি জাহাজ নরওয়ের চারদিকে ঘুরাফেরা করছিল । সময়টা ১৫৯৬ সাল। সেই জাহাজে থাকা ‘উইলিয়াম ব্যারেন্ট’ নামক একজন নাবিক এই দ্বীপে নামে এবং অফিসিয়ালি ভাবে তাকেই বলা যায় এর আবিষ্কারক । তিনি খুব ইম্প্রেসিভ হন এর ক্যারেক্টার আর পাহাড়ি ল্যান্ড স্কেপ দেখে এবং নাম দেন “Spits bergen” ।
এখানে সমুদ্রে তিমি আছে । ল্যান্ডে আছে শ্বেত ভল্লুক, সাদা শেয়াল, রেইন ডিয়ার আর সী ঈগল ।এখানকার আইস ৬০০ মিটার গভীর। চার দিকের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ২,১০০ গ্লেসিয়ার । এখানে এখনো বরফ যুগ চলছে।
সালভার্দে কেউ জন্ম গ্রহণ করেনা । কেউ প্রেগন্যান্টে হলে বাচ্চা হতে নরওয়ে চলে যায়। সালভার্দে মৃতদেহ সমাহিত করা হয়না ,কারন মৃতদেহ পচন ধরে না। ডেড বডি বা লাস নরওয়ে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয় । একটা রাত এখানে তিন থেকে চার মাস দীর্ঘ আর একটা দিন দীর্ঘ তিন থেকে চার পাঁচ মাস দীর্ঘ । এখানে প্রায় ৩ হাজার শ্বেত ভল্লুক আছে । মানুষের চেয়ে বেশি ।
চার দিকে একটু ঘুরা ঘুরি করলাম । আর পরের দিন সকালেই ফিরে আসলাম। এক অদ্ভুত ল্যান্সকেপ দেখে। ভাবছিলাম এই পৃথিবী কতই না বিচিত্র ।
লেখকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস,লন্ডন
২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
সালভার্দে সম্পর্কে সুন্দর উপস্থাপনা।চলমান থাকুক ঐতিহাসিক পোস্ট সেই আশাই করছি আপু।
নার্গিস রশিদ
দোয়া করি সব যেন ঠিক মত চলে ভাইয়া ।