১/
কোন ভাস্করের গড়া ভাস্কর্যের মত ডান হাতে কলম নিয়ে বিছানার পাশে নিঃশব্দ দাড়িয়ে আছে অভিক। নড়ছে না একদম। কেও হঠাত করে তিন কি চার সেকেন্ড ধরে তাকিয়ে থাকলে হয়তো ধাঁধায় পরে যাবে ওর অস্তিত্ব নিয়ে। আসলেই মানুষ না কি ভাস্কর্য। জীব নাকি জড়।
মোজাইক করা মেঝেতে ওর ডান হাতের রক্ত-লাল কব্জি হতে রক্তাক্ত কলম হয়ে গড়িয়ে দু ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়লো। বিছানায় শুয়ে আছে প্রিয়তি। শুয়ে আছে বলা হয়তো বা পুরোপুরি ঠিক হবে না, বলা যায় পরে আছে। প্রিয়তির নগ্ন রক্তাক্ত লাশ!
লাশের চার হাত-পা দড়ি দিয়ে বিছানার চার কোণায় বেশ কায়দা করে টানটান করেই বাঁধা আছে। তেমন কোন বেগ পেতে হয়নি অভিকের, নড়া চড়া করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি তেমন একটা প্রিয়তির। ধীরে সুস্থেই মনোমত কাজ শেষ করতে পেরেছিল অভিক। যদিও এতটা টানটান করে বেঁধে রাখায় প্রিয়তি বেশ কষ্ট পাচ্ছিল, জ্ঞান ফেরার পর থেকেই। ওর দিকে চেয়ে ভালবাসার সবটুকু অনুভূতি কে ক্ষোভ দিয়ে চেপে রেখেছিল অভিক। যদিও প্রথমে যখন প্রিয়তির দিকে তাকিয়েছিল, ওর ভয়ার্ত আর অসহায় চোখ দেখে কেঁদেই দিয়েছিল অভিক। ডুকরে উঠেছিল কিছুক্ষণের জন্য। সামলে নিয়েছিল নিজেকে। অবশ প্রিয়তি কিছুই বলতে পারছিল না কারণ, একটা ওড়না দিয়ে ওর মুখ বেঁধে দিয়েছিল সে। আর অচেতন থাকতে থাকতেই প্রিয়তিকে নগ্ন করে নিয়ে বেঁধে ফেলেছিল এভাবে। যেভাবে পরিকল্পনা করেছিল ঠিক সেভাবেই সব কাজ করেছে অভিক।
২/
টেবিল ল্যাম্প এর আলোয় বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে প্রিয়তি। অভিকের লেখা ৩য় উপন্যাস, যার সাবজেক্ট সাইকো থ্রিলার। অভিক খাটের পাশে রাখা স্টাডি টেবিলের সামনের চেয়ারে বসা। লিখছিল ওর ১২ তম ছোটগল্প। যদিও কিছুক্ষণ ধরেই ওর হাত থেমে আছে। ঘুরে বসে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে প্রিয়তির দিকে। প্রিয়তি ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। সে গল্পের এতটাই ভেতরে ঢুকে গিয়েছে যে আশে পাশে তেমন একটা খেয়াল যাচ্ছেই না বলা চলে।
-চা খাবে?, অভিক নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো।
-হুম?, কিছু বললে?, প্রিয়তি বই থেকে মুখ ঘুরিয়ে অভিকের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল।
-বলছিলাম, চা খাবে কি না?
-হুম, এখন চা খেলে ঘুম নষ্ট হবে যে, অবশ্য তুমি চাইলে একসাথে অল্প করে খাওয়াই যায়। বানিয়ে আনবো?
-নাহ্, তুমি পড়। তোমার ওঠা লাগবে না। আমি বানিয়ে আনছি।
-কেন ? তুমি লিখছ না ? আমিই যাই ?
-নাহ্, এখন আপাতত লিখতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বই পড়। আমি
চা বানিয়ে আনি।
-ঠিক আছে।
এই বলে পড়ায় মন দিলো প্রিয়তি। অভিক উঠে দাঁড়ালো। উঠতে গিয়ে কিছুটা পা কেঁপে উঠে ওর। তবে প্রিয়তি ব্যাপারটা খেয়াল করেনি।
৩/
-এই নেও চা।
বই থেকে একটু চমকেই চোখ সরিয়ে বইটা পাশে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে অভিক এর বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে কাপটা নিলো প্রিয়তি।
-কেমন হয়েছে ? সব ঠিক আছে তো ?
-হুম, আছে।
এটা শুনে একটু স্বস্তি পেলো অভিক। সে গিয়ে টেবিল এ ডায়েরি খুলে বসে। ব্যাপারটা লিখে ফেলা উচিত দ্রুত।
প্রিয়তি আবার বই এ মনোযোগ দিয়েছে ততক্ষণে।
লেখা শেষ হতেই প্রিয়তির দিকে ফিরে চাইলো অভিক। বই টা পাশে রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে সে। ঘুমিয়ে যায়নি। অভিক জানে প্রিয়তির এই ঘুমের রহস্য। এক ঘণ্টার আগে এই ঘুম ভাঙ্গবে না। কোনভাবেই না।
#এই পর্যন্ত লিখে থেমে গেলো বিখ্যাত থ্রিলার গল্প লেখক অভিক রায়। এই প্রথম নিজের কোন গল্পের চরিত্রের নাম নিজনামে দিচ্ছে সে। গল্পটা মাথায় বেশ কিছুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্য একটা উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এর পেছনে সময় দেওয়া হয়নি, আর তাছাড়া উপযুক্ত দিন-তারিখ বা সুযোগ ছাড়া এ গল্প লেখাটাও সম্ভব হচ্ছিল না। আজ সন্ধ্যায় উপন্যাসের কাজ টা শেষ করেছে। এ কারণেই আজ রাতে এই ছোটগল্প টা নিয়ে বসার সুযোগ হল। রহস্য পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় ওর একটা সাইকো থ্রিলার অবশ্য কিছুদিন আগেই চেয়েছে।
হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা যোগ থেকে পানি ঢেলে নিলো অভিক রায়। পানি খেয়ে রাখতে রাখতে গ্লাস টা একটু জোরেই শব্দ করে রাখে। প্রিয়তির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো ওর আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাকি শব্দে। নাহ, ভাঙেনি। সাধারণত পড়ার ঘরে যে টেবিল আছে সেখানেই বসে সে। আজকে বিশেষ একটা কারণেই শোবার ঘরের টায় বসেছে। ঘরের বাতি নেভানো। শুধু টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বলছে। পুরো ঘরে একটা আলোছায়ার খেলা চলছে। হাত ঘড়িতে বর্তমান সময় টা দেখে নিলো সে। প্রায় পৌনে দুটো বাজে। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ডায়েরীর উপর রাখা কলম এর দিকে চেয়ে শুয়ে পরবে নাকি ভেবে পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেরে ফেললো। কলম হাতে নিয়ে আবারো লিখতে শুরু করলো।
৪/
প্রিয়তি অজ্ঞান হয়েছে বুঝতে পেরে, উঠে গিয়ে দড়ি নিয়ে এলো অভিক। তারপর ধীরে সুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় প্রিয়তি কে নগ্ন করে নিলো। দড়ি দিয়ে প্রিয়তির চার হাত পা খাটের চার কোনায় শক্ত করে বেঁধে নিলো।
পাশের পড়ার টেবিলে বসে কলম টা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো প্রিয়তির জ্ঞান ফেরার সময় হওয়ার জন্য। বেশিক্ষণ নেই, আর ১৫ মিনিট পরেই জ্ঞান ফেরার কথা প্রিয়তির। এখন অপেক্ষা করার পালা। জ্ঞান ফিরলেই শুরু হবে মূল কাজ।
প্রিয়তি ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের অবস্থা দেখে আতংকে আঁতকে উঠলো। কিন্তু, মুখে ওড়না দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখার কারণে চিৎকার করতে পারছে না। অভিক উঠে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়তরি ভয়ার্ত চোখ জোড়ার দিকে তাকালো। সে চোখে ভয়, আতংক আর আছে ক্ষমা, আছে আকুতি। মুক্তি পাবার আকুতি। আর কৌতূহল মেশানো ভয়। অভিকের ঠোঁটে বিদ্রূপ মেশানো মুচকি হাসির আবির্ভাব আর চোখের নির্লিপ্ত দৃষ্টি দেখে প্রিয়তির ভয় যেন আরও নতুন মাত্রা পেলো। অভিক নির্লিপ্ত ভাবেই বিছানায় উঠে, প্রিয়তির কপাল থেকে শুরু করে তলপেট পর্যন্ত চুমু খেলো। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলো,
## ঐ কুত্তাটা তোমাকে অনেক আদর করতো বুঝি সোনা ? তাই সুযোগ পেলেই ওর কাছে চলে যেতে ? তোমার কি একটুও বাঁধেনি আমার সাথে প্রতারণা করতে ? এই ভালবেসেছিলে আমায় ? বিয়ের বছর না পেরুতেই পরপুরুষের সান্নিধ্য প্রয়োজন পরেছে তোমার ? অনেক তেষ্টা তোর ? তাই না ? অনেক ক্ষুধা ?? আমি সেই তেষ্টা, সেই ক্ষুধা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছি, নারে ??
এই বলে ডান হাতে ধরে রাখা কলম দিয়ে প্রিয়তির যোনিতে একের পর এক আঘাত করে যেতে থাকে অভিক। ক্লান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আঘাত করেই যাচ্ছে সে। রক্ত এদিক সেদিক ছড়িয়ে পরছে, ওর গায়েও ছিটে আসছে, পড়নের পাঞ্জাবিটাও রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। প্রিয়তির শরীর ভয়ংকর ব্যথায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাগলের মত ঘাড় নাড়াচ্ছে প্রিয়তি। চিৎকার করতে পারছে না একবিন্দু। মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে। অভিকের এসবের দিকে খেয়াল নেই। অভিকের উপর ভর করেছে এক অক্লান্ত অসুর। সে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে, তাঁর মনে হচ্ছে, এমন সুখ সে আগে কখনো পায়নি। সুখের ধাঁধায় হারিয়ে অন্ধ, কালা হয়ে অভিক আঘাত করেই যাচ্ছে। যে মানুষটার গায়ের একটা আঁচড় অভিক নিতে পারতো না। ভেঙ্গে পড়তো। আজ সে মানুষ টাকে পাশবিকতার চূড়ান্ত রূপ দেখাচ্ছে সে, কি করে পারছে। তা ভাবার সময়টুকু ও নেই তাঁর। সে হারিয়ে গিয়েছে, পাশবিক সুখের স্রোতে।
#এই পর্যন্ত লিখেই থমকে গেলো অভিক রায়ের কলম, দ্বিতীয় বারের মত। এ থমকে যাওয়া পাশবিকতা কল্পনা করে নয়, এ থেমে যাওয়া পাশবিকতা কল্পনা করে কেন তাঁর বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছে না সেজন্যই। এটাই তাকে খুব বেশি অবাক করেছে। চরিত্রের এত গভীরে আর কখনো ঢুকেছে বলে মনে হয় না সে। গল্পের প্রিয়তি চরিত্রের জন্য মায়া হচ্ছে না তাঁর বিন্দুমাত্র। এক গ্লাস পানি খেয়ে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবারো লিখতে শুরু করলো সে।
অবশেষে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলো অভিক। প্রিয়তির ক্ষত বিক্ষত যোনি দেখে নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত হাসি যেন জায়গা করে নিলো ওর ঠোঁটে। প্রিয়তি ব্যথায় কখন জ্ঞান হারিয়েছে বলতে পারবে না সে। একটু শিউরে উঠলো প্রিয়তির নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে, মরে যায়নি তো !! টেবিলে রাখা যোগ থেকে পানি নিয়ে প্রিয়তির মুখে পানির ছিটা দিল অভিক। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরলো ওর। রক্তক্ষরণ হচ্ছে খুব বেশি, দ্রুতই মৃত্যু হতে পারে ওর। তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রিয়তির পেটের উপর বসলো অভিক। প্রিয়তির ক্লান্ত ভয়ার্ত চোখ বিন্দুমাত্র বিচলিত করলো না তাকে। সে ডান হাতে ধরে রাখা রক্তাক্ত কলম টা নিয়ে আবারো শুরু করলো পাশবিক আঘাতের পালা, এবার প্রিয়তির স্তন্যজোড়ায় উপর, ব্যথায় প্রিয়তির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে আবারো, গোঙানির শব্দ বেরুচ্ছে প্রিয়তির মুখ দিয়ে ক্রমাগত, তবুও থামছে না অভিক। সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে, নিয়েছে খুব ঠাণ্ডা মাথায়। বেশ কিছুদিন ধরে যে মানসিক নির্যাতন অভিক কে হতে হয়েছে প্রিয়তির পরকীয়ার কথা বুঝতে পেরে, আজ সব সে একেবারে শেষবারের মত শারীরিক নির্যাতন রূপে ফিরিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তি কে।
অজ্ঞান হয়ে পরে আছে প্রিয়তি। বেশিক্ষণ বাঁচবে না, রক্তক্ষরণ খুব বেশি হচ্ছে, রক্তশূন্য হয়ে মারা যাবে খুব দ্রুতই। কিন্তু অভিক সেটা নিয়ে ভাবছে না, সে হঠাতই অট্টহাসি তে ফেটে পড়লো। নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে এখন, সকল মানসিক যন্ত্রণার ইতি টানতে পেরেছে সে আজ। একেবারে।
হাসির শব্দে প্রিয়তির নড়ে উঠলো, চোখ খুলে ধীরে ধীরে অভিকের দিকে চেয়ে দেখ, সে হাসিটা ধীরে ধীরে কান্নায় রূপ নিচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে অভিক, প্রিয়তির চোখে এখন শুধুই ক্ষমা আর করুণা, অভিকের জন্য। অভিক কাঁদছে আর প্রিয়তির চোখের দিকে তাকিয়ে ওর ক্ষমার দৃষ্টি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে দেখছে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তি, চিরতরে।
#গল্প শেষ করে উঠে দাঁড়ায় অভিক রায়। ডায়েরীর পাতা বন্ধ করে ঘড়ি তে দেখে ৪ টা বাজে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে, এক গ্লাস পানি খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো তাঁর সহধর্মিণী প্রিয়তির পাশে, কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভালোবাসি বলেই অন্য পাশ ফিরে ঘুমের রাজ্যে হারাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অভিক রায়, অভিক রায়ের দুচোখ।
৮টি মন্তব্য
খসড়া
অভিক রায়ের জন্য দুঃখ হচ্ছে বেচারা লেখক। গল্প সুন্দর হয়েছে।
রাতুল
দুঃখ কেন ?
যাযাবর
(y) (y) ++++++
রাতুল
(y) -{@ -{@
জিসান শা ইকরাম
অনেক দিন পরে সোনেলায় পেলাম ।
ভালো হয়েছে লেখা ।
স্পেস গুলো একটু বেশী হয়ে গিয়েছে ।
রাতুল
ধন্যবাদ, হুম। লেখালেখি বন্ধ আছে বেশ কিছুদিন ধরে।
অলিভার
কল্পিত রহস্য গল্পে জীবনকে জুড়ে দিয়ে তারপর লেখক নতুন কিছু নিয়ে এসেছে। ক্ষোভে অন্ধ হিংস্রতা আর ভালবাসার বিসর্জন একই সাথে এগিয়ে গিয়েছে।
ভালো লাগলো 🙂
রাতুল
ভাল লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম 🙂
ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল। 🙂